ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

ফিকে হয়ে যাচ্ছে সৌদি যুবরাজের সংস্কার

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ৯ জানুয়ারি ২০১৯

ফিকে হয়ে যাচ্ছে সৌদি যুবরাজের সংস্কার

রিয়াদের চারপাশে মোটরগাড়িতে ঘুরে বেড়ালে সৌদি আরবের অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত মনে হবে। রাজধানীর শপিং মলগুলোতে ক্রেতার ভিড়। বিনোদনের পিছনে তরুণরা বেশ অর্থব্যয় করছে। নগরীতে নির্মাণকাজ চলছে। নতুন নতুন হোটেল, বিপণি কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। এ বছর সৌদি আরবের শেয়ারবাজার স্ফীত হয়েছে ৯ শতাংশ। জিডিপি আগামী বছর ১.৯ শতাংশ ও তেল বহির্ভূত খাতে ২.৩ শতাংশ বাড়বে বলে ধরা হয়েছে। এ থেকে মনে হতে পারে যে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ‘ভিশন ২০৩০’ অর্থাৎ অর্থনীতিকে বিভিন্নমুখী করার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনায় কাজ হচ্ছে। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিনিয়োগ আকর্ষণ ও পর্যটনের মতো শিল্পের বিকাশ সাধন। কয়েক দশক ধরে তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলো একই ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছে। সৌদি আরবের ক্ষমতাধর যুবরাজ তার দেশকে পূর্বসূরিদের তুলনায় উন্নততর পথে নিয়ে এসেছেন। তবে অগ্রগতিটা মরীচিকার মতো। এ যাবত তার সংস্কার কার্যক্রমের ফলাফল হতাশাব্যঞ্জক। শেয়ারবাজারের কথাই ধরা যাক। শেয়ারবাজারকে বাহ্যিক চেহারায় তেজী দেখাবে। তবে আসল কারণ হলো সরকার কেনাকাটার বিশাল বিশাল অর্ডার দিয়ে গোপনে এর তেজীভাব রক্ষা করছে। জিডিপির হিসাবটাও বিভ্রান্তিকর। অর্থনীতি এখনও তেলের সঙ্গে আবদ্ধ। তেলের ভাল দাম এখনও সকল খাতকে তেজী রেখেছে। তবে অর্থনীতির সামগ্রিক চেহারাকে মোটেই ভাল বলার উপায় নেই। তিন বছর আগে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪ শতাংশ। যুবরাজ মোহম্মদ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মনে এই বিশ্বাস জন্মাতে চান যে বিনিয়োগের জন্য সৌদি আরব নিরাপদ। কিন্তু তার খামখেয়ালী নীতির কারণে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছে। ২০১৭ সালে ধনাঢ্য সৌদিদের কারাগারে নিক্ষেপ করা থেকে শুরু করে কানাডা ও জার্মানির সঙ্গে কূটনৈতিক বিবাদে জড়িয়ে পড়া তার এসব খামখেয়ালী নীতির পরিচায়ক। এর ফলে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ ২০১৬ সালে যেখানে ৭৫০ কোটি ডলার ছিল ২০১৭ সালে তা হ্রাস পেয়ে ১৪০ কোটি ডলার অর্থাৎ জিডিপির শূন্য দশমিক ২ শতাংশে নেসে আসে। গত অক্টোবরে রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলন হয়। কিন্তু তার আকর্ষণ ঢাকা পড়ে যায় সৌদি সাংবাদিক জামান খাশোগীর নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের ঘটনায়। ধনী সৌদিরা তাদের অর্থসম্পদ বিদেশে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। গত বছর ৮ হাজার কোটি ডলার এইভাবে বাইরে চলে গেছে। অবশ্য বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তার মধ্যে সৌদি দেউলিয়াত্ব পদ্ধতিতে শৃঙ্খলা আনার জন্য নতুন একটা আইন করা হয়েছে। যেসব প্রকল্পে একদা রাষ্ট্রের আধিপত্য ছিল সেগুলো এখন সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে চালিত হবে বলে পরিকল্পনা করা হয়েছে। ১৫ লাখেরও বেশি সৌদি ভর্তুকি মূল্যে আবাসন লাভের জন্য ওয়েটিং লিস্টে রয়েছে। তাদের জন্য ১০ লাখ আয় ও যোগ্য বাড়ি তৈরির প্রয়োজনে প্রাইভেট ফার্মগুলোতে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে এবং এজন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ১০ হাজার কোটি ডলার। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে গিয়ে যুবরাজ মোহম্মদ নিওমের মতো রাষ্ট্র পরিচালিত মেগা প্রকল্পগুলোতে তাদের টেনে আনতে চাইছেন। নিওম হলো উত্তর-পশ্চিম উপকূলে ৫০ হাজার কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য ভবিষ্যতের নগরী যেখানে বিভিন্ন কাজে রোবোটের ব্যাপক ব্যবহার হবে। অথচ এ পর্যন্ত সেখানে নির্মাণকাজ হয়েছে যৎসামান্য। যুবরাজ গত ১০ ডিসেম্বর পূর্বাঞ্চলে ‘স্পার্ক’ নামে একটি এনার্জি সিটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৬০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মীয়মাণ এই নগরীতে ১ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হওয়ার কথা। কিন্তু কথা হচ্ছে এ ধরনের স্কীম কদাচিৎই কাজ করে। রিয়াদে কিং আবদুল্লাহ ফিনান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্ট নামে এক হাজার কোটি ডলারে একটি প্রকল্প আছে। সেখানে যত না ব্যাংক তার চেয়ে বেশি রয়েছে দালান কোঠা। তেল রাজস্ব বৃদ্ধি, ভর্তুকি হ্রাসের মতো ব্যয়সঙ্কোচ ব্যবস্থা এবং নতুন ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের ফলে বাজেট ঘাটতি যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। তবে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা হলো কর্মসংস্থান। ২০১৭ সাল থেকে রিটেইল চাকরির সংখ্যা ১ লাখ ৭৭ হাজার কমেছে। এর ফলে সেলসের অনেক চাকরিতে বিদেশীদের নিয়োগ। নিষিদ্ধ করে সৌদিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে সরকারের উদ্যোগ মার খেয়েছে। সৌদি নাগরিকদের বেকারত্বের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার টার্গেট রয়েছে সরকারের। সেই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ২০২২ সালের মধ্যে ১২ লাখ সৌদির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সেজন্যই বিদেশী কর্মী নিয়োগ নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। বিদেশী কর্মী নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর লেভী ধার্য করা হচ্ছে। ২০১৭ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১০ লাখ বিদেশী শ্রমিক সৌদি আরব ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু সেই শূন্যস্থানের অনেকগুলোই সৌদিদের দিয়ে পূরণ হচ্ছে না। নির্মাণকাজ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই খাতে কর্মরত সৌদিদের সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে। সামগ্রিকভাবে ২০১৭ সালের জানুয়ারির পর থেকে কর্মজীবী সৌদিদের সংখ্যা ১ লাখেরও কম বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বেকারত্বের হার ০.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১২.৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তরুণ সৌদিদের মধ্যে স্বহস্তে কাজ করার ব্যাপারে অনীহা আছে। তাছাড়া তারা যে পরিমাণ বেতন দাবি করে থাকে সেই বেতনে তাদের নিয়োগ দেয়া কোম্পানিগুলোর পক্ষে সম্ভব হয় না। স্বল্প দক্ষ বিদেশী শ্রমিক প্রতি মাসে বেতন পায় দেড় হাজার রিয়েল। অন্যদিকে সৌদি নাগরিকদের ন্যূনতম মজুরি ৩ হাজার রিয়েল। এটা তাদের কর্মসংস্থানের পথে এক মস্ত বাধা। সামগ্রিক বিচারে সৌদি যুবরাজের সংস্কার পরিকল্পনা কতদূর কার্যকর হবে তা আজ প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×