সত্তর দশকের কবি সৈয়দ আবদুস সাদিক। এক প্রত্যাশিত সন্ধিক্ষণে বাংলা কবিতার মঞ্চে হাজির হয়েছেন গ্রহণ পূর্ণিমার ছায়াচারী হিসেবে। তাঁর কবিতার শরীর শব্দ সম্পদে ভরপুর। উপমা, শিল্প-সৌন্দর্যবোধ ও মিথ মিলে কাব্যমাঠ যেমন উর্বর, গড়ন-কৌশলেও ভাষা হয়ে উঠেছে তেমনি অনন্যমাত্রার। তাঁর কবিতায় মন-ময়ূখজুড়ে সমাজ ও স্বদেশ প্রেমের ক্যানভাস আবার বিষয়বস্তুর নিরীখটা জুড়ে যেন প্রেমই প্রধান। প্রেমই প্রকৃতি এই আকুতি, এই উচ্চারণ সর্বোপরি রসমগ্নতাও গভীরভাবে বিম্বিত। কোথাও বিশুদ্ধ নৈয়ায়িক দুর্বোদ্ধতা থাকলেও, পাঠস্বাদে তা প্রতীকী কাব্যানুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। তিনি এ কাব্যর এ মাঠে রোপণ করেছেন বিভিন্ন স্বাদের ফ্রয়েডীয়, পরাবাস্তব কবিতাসহ সনেট, রুবাই এবং গজল। তবে, নিশ্চয় পাঠক কবির এই কারিশমায় দ্রবীভূত হলেও দ্রোহ আর প্রেমের নানান সমাসবদ্ধ শব্দের উতরোলে, বিরহের ব্যঞ্জনধ্বনিতে, এইসব কবিতার বাহারি রূপ, রস, গন্ধ কবিতাঞ্চলকে করে তুলেছে মন্ময় ও তন্ময়। গ্রন্থের ভিন্ন স্বাদ, বিভিন্ন বোধ ও বিচিত্রতা পাঠ করা গেলে সহজেই সে আবহাওয়া অনুধাবন করা যায়। কবি শব্দ, স্বর ও ধ্বনিকে জানা অথচ অজানা মাত্রায় বিচিত্র অ্যালিগোরির মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন এতে করে সাধারণ পাঠকও কোনরকম বিরক্তি ছাড়া রসাক্রান্ত হয়ে পড়েন।
‘অনাথ অন্ধকার’ কবিতায় সিক এ্যান্ড হাইডের খেলা কবিতার সমঝদার পাঠককে মনোরঞ্জন করেন এভাবে।
‘এতোকাল কুহকের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে
জেনে গেলাম গন্ধ-বর্ণময় সময়ের ভেতর
অনাথ অন্ধকার খেলা করে;’...
‘চাঁদের পূর্ণিমা’ গজলের মধ্যে শব্দের কারিকুরি মূলত গভীর প্রেমের বুনোট উপাখ্যান ও আক্ষেপের আখ্যান ধ্বনির আওয়াজ ভেসে ওঠে-
‘কেন দিলে প্রেম কেন রাঙিয়ে দিলে এ-মন
ও-দুটি চোখ মহুয়া-অশোক এত নিবেদন’
মানুষ প্রকৃতপক্ষে নির্জন আবার একাকিও, সে কথার আভাস ভাষার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে এভাবে :
‘এই পরবাসে আমি বড় একা সঙ্গহীনতায়,
স্মৃতির জীর্ণ মলাটে সঙ্গীহীন, কেবলি বিদীর্ণ নিঃশ্বাসে
হারিয়ে ফেলেছি বিনম্র দিনের উচ্ছ্বাস;’
আবার সমাজ-সংকট সময়েও কবি বলতে দ্বিধা করেননি, উত্তরণের আলাদা উপায় নিমিষেই বাতলে যান কবি যা তাকে অন্যসুর থেকে স্বতন্ত্র সুরে আগলে রেখেছে-
‘মানবিক বিষয়গুলো ভুলে গিয়ে স্বার্থসিদ্ধির মোহে
উৎকট সন্তুষ্টি খোঁজে অশুদ্ধ সমাচারে ও বিভাজনে;
পাপে আকৃষ্ট হলে যে কোন সময়ে পাপ আক্রমণ করে সেই ইকোয়েশনেও কবি ‘কেদারনাথ’ কবিতায় মিথস্ক্রিয়ায় মাধ্যমে তাঁর মরমী উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন-
‘অন্ধকার মাতামাতি করে ঝড়-বৃষ্টির তা-ব নৃত্যে,
মন্দাকিনী আর সরস্বতীর জোয়ারের জল
এলোপাতাড়ি ভেঙে ফেলে কেদারনাথের উরুসন্ধি;’
মনের মধ্যে মনের ভাঙচুর, মনোদ্বন্দ্বের আন্দোলন ও উলম্ফন কবিকে ফ্রয়েডিয় প্রভাব আক্রান্ত করে। শিল্পের উপমা-সৌন্দর্য ও ভাবরসে বিনির্মাণ করেন
পরাবাস্তব কালের করতলে তুমি ভাঙছোÑ দ্রাবিড় রমণী,
শব্দের আলাপচারিতায় প্রবল জ্বরে তুমি কাঁপছো,
তোমার নীল শাড়ি ভিজে গেলো, কাঁচুলী ভিজে গেলো ঘামে,
তুমি সাঁতার কাটাছো...সাঁতার কাটছো...আদিম অন্ধকারে!
প্রকৃত কবির একটা স্বাপ্নিক কিম্বা বাস্তবিক জগৎ থাকে বলেই তাতে নাম-শিরোনামের কবিতার প্রকাশও বেশি মাত্রায় দেখা যায়। তাকে আবৃত করেই কবির সাহসী উচ্চারণ-মগ্নতা বিভিন্ন কবিতার বন্ধনীর ভেতর লক্ষণীয় হয়ে ওঠে।
‘কাব্য ঘরণী’ কবিতায় কবি সেই চর্যাপদ থেকে আধুনিককাল তুলে এনে উপমা-শোভিত সেলাই করা শব্দ দিয়ে কবিতার ফসল কাব্যগৃহে তুলেছেন সহজ, সাবলীল বর্ণনা ভঙ্গিতে যেখানে কাব্যরস, গদ্য ছন্দের গরিমা এতটুকুন ম্লান হয় না। এবং কত বিচিত্রভাবে শব্দ নিয়ে খেলা করা যায়, শব্দ ভেঙে নতুন শব্দের জোড়বাংলা নির্মাণ করা যায় তার ঝলমলে ঐশ্বর্য প্রত্যক্ষ করা যায় :
‘সেই চর্যাপদ থেকে তুমি, কাব্য-নদীর জোয়ারের জলে ভেসে ভেসে...
সাঁতার কেটেছো তুমি প্রেমের পলি-বিধৌত, সকাল-সন্ধ্যার চৈতন্য-নগরে।’
মূহূর্তেই প্রেম মগ্নতাকে পিছে ফেলে বাস্তব জীবনের জয়গানে স্বদেশের সমস্যা ও সমকালকে উপেক্ষা না করে বরং স্বদেশের সমস্যা কবিকে ভারাক্রান্ত করেন এবং আমরা এও লক্ষ্য করি যে, কবিতার উপলব্ধিতে উত্তপ্ত প্রাণিক সংযোগের সঙ্গে গদ্যের বাণীশিল্পেরও সাক্ষাৎÑ
‘কোন বোধ কাজ করে না,
আলোর গতির মতো শৃগাল দৌড়ে আসে
মাথার খুলির ভেতর-কামড় দিয়ে তুলে নেয় মগজ’
আবার একই সঙ্গে কবি অসীম শূন্যতার উপলব্ধিতে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সমর্পিত করেন অবলীলায় :
‘হয় না হয় না হয় না
কোন কিছুই পৃথিবীতে রয় না
সেই কথা কেউ মোটে কয় না।’
‘তুমি শ্রমণ, আমি ভিক্ষু’ গ্রন্থের প্রত্যেক কবিতার স্বতন্ত্র পরিচয় মেলে-পাঠস্বাদে সে রসোপলব্ধির প্রভাব প্রকট; পাঠক মাত্রই তা অনুধাবন করবেন নিশ্চয়। আইয়ুব আল আমিনের প্রচ্ছদে অনুপ্রাণন প্রকাশন ২০১৮ তে প্রকাশ করেছে সাড়ে তিন ফর্মার এ গ্রন্থ তাতে দাম রাখা হয়েছে একশত পঞ্চাশ টাকা।
শীর্ষ সংবাদ: