ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচন বানচালের চেষ্টা! ॥ সোহরাওয়ার্দীর জনসভা থেকে সহিংসতা হতে পারে

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৬ নভেম্বর ২০১৮

নির্বাচন বানচালের চেষ্টা! ॥ সোহরাওয়ার্দীর জনসভা থেকে সহিংসতা হতে পারে

শংকর কুমার দে ॥ সরকার যখন দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেয়ার চেষ্টায় একের পর এক সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে এবং নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার তারিখ নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে তখনই লাশ ফেলা তথ্য পলিটিক্যাল কিলিংয়ের উদ্বেগজনক খবর দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। তারা বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ঐক্যফ্রন্টে যোগদানকারী অন্যতম দল বিএনপিকে বাঁচাতে নির্বাচন বানচাল করতে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার উদ্দেশ্যে নানা ধরনের ছক কষতে শুরু করেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নানা ধরনের চক্রান্ত শুরু করেছে পর্দার অন্তরালে থাকা একটি অদৃশ্য মহল। একাদশ নির্বাচনের আগে নির্বাচনের চেয়েও দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিকে প্রাধান্য দিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নাশকতা, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সরকারের উপর দায়-দায়িত্ব বর্তানোর জন্য ষড়যন্ত্র করছে দেশে-বিদেশে থাকা বিএনপি-জামায়াত, যুদ্ধাপরাধীর দোসর ও উগ্রপন্থী গোষ্ঠী। এর আগে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ও যুক্তরাজ্যে অবস্থানকারী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার ফোনালাপে প্রয়োজনে ২/৩টি লাশ ফেলতে হবে, ‘বিশেষ বৈঠকে’ আগ্রহী সেই অডিও টেপটি এখন আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য আনা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার টেবিলে। সরকারের উচ্চপর্যায়ে দেয়া এক প্রতিবেদনে এই ধরনের আশঙ্কার কথা উল্লেখ করা হয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, গত বৃহস্পতিবার ১ নবেম্বর রাতে গণভবনে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে সংলাপে বিশেষ সুবিধা আদায় করতে পারেনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচনের পূর্বে আন্দোলন জমিয়ে তুলতে ৬ নবেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের ডাক দিয়ে জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে ব্যাপক জনসমাগমের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে বিএনপি। সমাবেশের মাধ্যমে দেশব্যাপী সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে একাধিক ভয়ঙ্কর মাস্টারপ্ল্যান সামনে নিয়ে আসছে বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট। জনসমাবেশে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের নারী নেত্রীদের পুলিশের উপর লেলিয়ে দেয়ার মতো সহিংসতায় উস্কানি দেয়া, কর্মীদের মাঝে সংঘর্ষ বাধিয়ে কর্মীদের প্রাণের বিনিময়ে সহিংসতা ছড়িয়ে নির্বাচনী তফসিল পিছিয়ে দেয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে রক্তক্ষয়ী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ঘাপটি মেরে থাকা উগ্রপন্থী গোষ্ঠী। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি দলের একাধিক নেতা মনে করছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে সরকারী দলের সঙ্গে বহুল প্রত্যাশিত সংলাপ করেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে বিএনপি নেতৃবৃন্দকে। চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে সরকারের সঙ্গে নরম সুরে আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছে দলটির নেতাকর্মীরা। এজন্য সরকারকে তাদের দাবি মানতে বাধ্য করার জন্য ২০১৪ সালের মতো সহিংস কর্মসূচী ঘোষণা দিতে আগ্রহী বিএনপির বিশেষ একটি গ্রুপ। সহিংস কর্মসূচীর ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করার প্রস্তুতি নিতে ৪ নবেম্বর সন্ধ্যায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতার বাসায় বৈঠকে বসেন বিএনপির স্থায়ী কমিটিসহ প্রায় অর্ধডজন কেন্দ্রীয় নেতা। বৈঠকে ৬ নবেম্বরের সমাবেশে সহিংসতা উস্কে দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য একাধিক কৌশল সমন্ধে আলোচনা করা হয়। আলোচনার একপর্যায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, জনসভায় কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ওপর বিএনপির নারী কর্মীদের ব্যবহার করে পুলিশের সঙ্গে হট্টগোল বাধানোর পরামর্শ দেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতার বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে নানা ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তার সংস্থান নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়। অর্থের সংস্থানের জন্য নাম প্রস্তাব করা হয় আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে যোগদানকারী এক ধনাঢ্য শিল্পপতি বিএনপি নেতার। ধনাঢ্য শিল্পপতি এই বিএনপি নেতার পুত্রও একজন বিএনপি নেতা যিনি দলীয় কাজে ব্যাপক সময় দিচ্ছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, বিগত বিএনপি সরকারের সময় ব্যবসায়ীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পয়সা আয় করেছেন ওই ধানঢ্য শিল্পপতি বিএনপি নেতা। দলের বিপদের দিনে খরচ করে বিএনপির ঋণ শোধ করার জন্য তার অর্থ ব্যবহার করার পক্ষে নিজের মতামত দেন বৈঠকে উপস্থিত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। বৈঠক শেষে বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা ফোন করে ৬ নবেম্বরের সমাবেশে অর্থ বিনিয়োগের জন্য নির্দেশ দেন বিএনপির ধনাঢ্য ব্যবসায়ী নেতাকে। আগামীতে ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় এলে এখনকার বিনিয়োগ সুদ আসলে শোধ করা হবে এমন আশ্বাস দেয়া হয়। এতেও বিএনপির ওই ব্যবসায়ী নেতা গড়িমসি করলে একপর্যায়ে লন্ডনে অবস্থানকারী বিএনপি নেতা তারেক রহমানের দোহাই দেয়া হয়। আলোচনার এক পর্যায়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থিতা বাছাইয়ের নামে চাঁদা সংগ্রহ করে লন্ডনে তারেক রহমানের কাছে অর্থ পাঠানের বিষয়ে উপস্থিত নেতাদের তাগিদ দেন বৈঠকে উপস্থিতি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা লন্ডনে পাঠানোর টার্গেট নির্ধারণ করে দেন বৈঠকে উপস্থিত বিএনপির নেতৃবৃন্দ। প্রয়োজনে বিএনপির শাসনামলে আঙুল ফুলে কলা গাছ বনে যাওয়া ব্যবসায়ী নেতাদের কাছে ধরণা দিয়ে চাপ দিয়ে হলেও টার্গেট পূরণ করা বিষয়ে জোর দেয়া হয়। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন এক নেতার ঘনিষ্ঠ মহল বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলীয় সমন্বয়হীনতায় ভরাডুবির শঙ্কায় সমাবেশের দিন প্রয়োজনে দলীয় কর্মীদের মাঝে কৌশলে বিবাদ বাধিয়ে লাশ ফেলে দেয়ার পক্ষে মতামত দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা। লাশের রাজনীতি করে দেশব্যাপী সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে পারলে সরকার অন্তত নির্বাচন পিছিয়ে দিতে বাধ্য হবে। নির্বাচন পিছিয়ে গেলে বিএনপি সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাবে। কারণ বিএনপির বর্তমান অবস্থা ভাল না। এ অবস্থায় নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির ভরাডুবি হবে তা প্রায় নিশ্চিত। বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতার বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব সম্পর্কে নেতিবাচক আলোচনা হয়। বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা বলেন, তারেক রহমান সাহেবও ড. কামালকে অবিশ্বাস করেন। তিনি বিএনপিতে ভাঙ্গন ধরানোর চেষ্টা করছেন। তারেক সাহেব ৩ নবেম্বর রাতে ফোন করে বিএনপিকে বাঁচাতে নির্দেশ দিয়েছেন। বৈঠকে উপস্থিত বিএনপির কোন কোন নেতা ড. কামালকে একজন বিদগ্ধজন হিসেবে উপস্থাপন করে তার কাছ থেকে বিএনপি নেতাদের রাজনীতি শেখার পরামর্শ দেন। এক পর্যায়ে ড. কামালের সততা ও নিষ্ঠা দেখে তারেক স্যার ইমেজ সঙ্কটে পড়েছেন এমন কথাবার্তাও হয়। আবার বৈঠকে কোন কোন নেতা বলেন, ড. কামাল বিএনপির ক্ষতি করছেন, বিএনপির কর্তৃত্ব কেড়ে নিতে চান। বিএনপি না বুঝেই ড. কামালকে ভুল বুঝছে। আলাপ আলোচনার মধ্যেই বৈঠকে উপস্থিত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বাগ্বিত-ায় জড়িয়ে পড়েন। তখন উপস্থিত বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ বলেন, ৬ নবেম্বরের সমাবেশে সহিংসতা ছাড়ানোর আরও নতুন নতুন পরিকল্পনা করারও পরামর্শ দেন। লাশ ফেলতে হবে গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার ফোনালাপের একটি অডিও টেপ এখন গোয়েন্দা সংস্থার টেবিলে। গোয়েন্দা সংস্থা কথোপকথনটি রেকর্ড করেছে। ইতোমধ্যে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে রেকর্ডের কপি পৌঁছে দেয়া হয়েছে। টেলিফোনে মান্নাকে বলতে শোনা যায়, ‘ঢাকার বাইরে আমাদের অবস্থান দুর্বল। ঢাবিতে দুই তিনটি হল দখল করে অবস্থান শক্ত করতে হবে। সরকারকে ফেলতে হলে পেট্রোল বোমার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ-গোল পাকিয়ে ২/৩টি লাশ ফেলে দিতে হবে। রেকর্ডটি ফাঁস হওয়ার পর তুমুল আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় সংলাপের অন্যতম উদ্যোক্তা রাজনীতিবিদ মাহমুদুর রহমান মান্নার অবস্থান ও কর্মসূচী নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। অডিও টেপে ২০১৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সোমবার বিকেলে রাজধানীতে মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য আয়োজিত গণমিছিলের পরিকল্পনা নিয়ে দুই নেতাকে কথা বলতে শোনা যায়। বিএনপি-জামায়াত জোটের চলমান আন্দোলন নিয়ে দুই নেতার দীর্ঘ কথোপকথন রয়েছে ওই টেপে। বিএনপি নেতা খোকা আট মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। এক সময়ের বামধারার ছাত্রনেতা ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না আশির দশকে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আওয়ামী লীগের সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিতি পান। ওই সময় তিনি ছিলেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক। ২০০৮ সালে নির্বাচনের পর দল থেকে পদ হারান মান্না। এরপর গঠন করেন নাগরিক ঐক্য। এরপর বিএনপির টানা হরতাল-অবরোধের মধ্যে সুশীল সমাজের একাংশকে নিয়ে ‘উদ্বিগ্ন নাগরিক’ নামের একটি মঞ্চ গঠন করেন ড. কামাল হোসেন ও মাহমুদুর রহমান মান্না। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, রাজধানী ঢাকার আশপাশের পেট্রোল পাম্পগুলোতে অস্বাভাবিক মাত্রায় পেট্রোল ও অকটেন বিক্রির খবর শুনে কিছুটা চিন্তায় পড়েছে পুলিশ। এই অতিরিক্ত পেট্রোল ও অকটেন ৬ নবেম্বর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশে আগুন সন্ত্রাসের জন্য ব্যবহার করা হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের চেয়েও দুর্নীতির দায়ে আদালতে সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিকে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টিকে সামনে এনে রাজনৈতিক আন্দোলনের আড়ালে বিএনপি-জামায়াত, যুদ্ধাপরাধীর দোসর ও উগ্রপন্থীদের সংগঠিত করে শক্তি প্রদর্শনের মহড়া দেয়ার চেষ্টা করাচ্ছে অদৃশ্য মহলটি। এই চক্র আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করতে তৈরি করছে নীলনক্সা। অতীতে দেশের ভেতরে যত নাশকতা, নৈরাজ্য, জ্বালাও-পোড়াও করা হয়েছে তার খবর সরকারের নীতি নির্ধারক মহলে অবহিত করার পর শক্ত হাতে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
×