ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ হাসিনা বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

রাজনীতির নামে কেউ যেন আর মানুষ পুড়িয়ে না মারতে পারে

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২৫ অক্টোবর ২০১৮

রাজনীতির নামে কেউ যেন আর মানুষ পুড়িয়ে না মারতে পারে

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভবিষ্যতে কেউ যেন আর রাজনীতির নামে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করতে না পারে সেজন্য দেশবাসীকে সজাগ থাকার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি সরকারও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। বিএনপি-জামায়াতের আগুন সন্ত্রাসের নৃশংস ভয়াবহতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এই ধরনের ঘটনা আর ঘটুক, আমি চাই না। ভবিষ্যতে এই ধরনের কাজ যারা করবে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং আমরা এ ব্যাপারে যা যা করণীয়, আমরা তা করব। বুধবার রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাশে ‘শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের আগুন সন্ত্রাসের সহিংসতার সমালোচনা করে বলেন, আমরা একদিকে গড়ে তুলি আর ওরা ধ্বংস করে। বিএনপি-জামায়াতের কাজ হচ্ছে ধ্বংস করা। সেই সময় এই পোড়া মানুষগুলোর চিকিৎসা দিতে হয়েছে। অনেককে আমরা বিদেশে পাঠিয়েও চিকিৎসা করিয়ে নিয়ে এসেছি। উদ্বোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নামে দেশের প্রথম বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরু হলো, যেখানে একসঙ্গে পাঁচ শতাধিক পোড়া রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার সুবিধা থাকছে। ১২ তলার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট-এ ৫০০ শয্যা, ৫০টি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) এবং ১২টি অপরাশেন থিয়েটার রয়েছে। ইনস্টিটিউটের তিনটি ব্লকে থাকবে বার্ন ইউনিট, প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট এবং একাডেমিক ভবন। সারাদেশের কয়েক লাখ পোড়া রোগীকে সেবা দিতে দেড় হাজার বিশেষজ্ঞ সার্জন তৈরির লক্ষ্য নিয়েই এই ইনস্টিটিউটটি চালু করা হলো। উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু একবার নয়, এরপর আবার ২০১৫ সালে। সরকার উৎখাত করবে। খালেদা জিয়ার বাসা গুলশানে, তার অফিসও গুলশানে। অফিসে এসে বসে পড়ে বললো আমাদের সরকার উৎখাত না করা পর্যন্ত নাকি ঘরে ফিরবেন না। এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে বসে পড়ল। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, খালেদা জিয়ার আন্দোলন কি? তার আন্দোলন মানেই মানুষ পুড়িয়ে মারা। এইভাবে আগুন দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে তারা পুড়িয়েছে। প্রায় ৪ হাজারের কাছাকাছি মানুষকে তারা পুড়িয়েছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রায় ৫শ’ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। প্রায় ৩ হাজার ৮ গাড়ি পুড়িয়েছে। আমি আমার সাধ্যমতো সবাইকে সাহায্য করেছি এবং যারা আহত তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। ওই সময় আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় এগিয়ে এসে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে সেবা দেয়ার জন্য বার্ন ইউনিটের সবাইকে ধন্যবাদও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মানুষের জন্য আমরা রাজনীতি করি। কিন্তু মানুষকে পুড়িয়ে মারা এটা কোন ধরনের আন্দোলন? কোন ধরনের রাজনীতি। সেটা আমার কাছে বোধগম্য না। কিন্তু বাংলাদেশে এই ধরনের ঘটনা আর ঘটুক, আমি চাই না। তবে বাংলার জনগণ এটা প্রতিরোধ করেছে, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা গোয়েন্দা সংস্থা সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় এই সন্ত্রাসী ও জঙ্গী কর্মকা- আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি। ভবিষ্যতে যেন আবার কেউ এই ধরনের মানুষকে পুড়িয়ে মারতে না পারে সেজন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানোর পাশাপাশি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, এ ধরনের কাজ যারা করবে সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং আমরা এ ব্যাপারে যা যা করণীয়, আমরা করব। আমরা দেশের মানুষের শান্তি চাই। কারণ শান্তিপূর্ণ অবস্থা থাকলেই দেশের উন্নয়নটা করা সম্ভব। এত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও আজকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ। আজকে বিশ্বে বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল বলা হয়। এই ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, মারাত্মক দগ্ধ রোগীর আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা বাংলাদেশে ছিল না। অনেক সময় শ্বাসনালীও পুড়ে যায়, তেমন রোগীর চিকিৎসার ভাল ব্যবস্থাও আগে করা হয়নি। আর যারা অগ্নিদগ্ধ হয়, তাদের চিকিৎসা করার ভিন্ন পদ্ধতি থাকে। অনেক ধরনের যন্ত্রপাতি, বেড সবকিছুই আলাদা লাগে। কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। যেখানে রেখে গিয়েছিলাম (২০০১ সালে), সে অবস্থাই ছিল। আর উন্নতি হয়নি। এই ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়কারী সামন্ত লাল সেনই যে এ ধরনের একটি চিকিৎসা ও শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সামনে এনেছিলেন, সে কথাও প্রধানমন্ত্রী বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বার্ন ইনস্টিটিউট তৈরি করার জন্য স্বাভাবিকভাবেই আমরা আমাদের সেনাবাহিনীর ওপর দায়িত্ব দিয়েছিলাম। এই সেনাবাহিনী তো আমাদের জনগণের সেনাবাহিনী। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের যে কোন দুর্যোগের সময়, যে কোন দুঃসময়ে তারা পাশে দাঁড়ান এবং মানুষের সেবা দেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ইঞ্জিনিয়ারিং চীফ যিনি, তাকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ অতি দ্রুত এই কাজগুলো তারা করেছেন। যারা এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে একটি দেশ এত দ্রুত উঠে যেতে পারে অনেক দেশের কাছে এটা দৃষ্টান্তস্বরূপ। আমি যখনি যেখানে যাই, অনেকে প্রশ্ন করে- স্বল্প সময়ে কীভাবে এত উন্নয়ন করতে পারলাম। জবাবে আমার একটাই কথা, আমার তো কিছু করতে হয়নি। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি পেয়েছি আমার বাবা (বঙ্গবন্ধু) দেখিয়ে যাওয়া পথ, যার ভিত্তিটাও তিনি তৈরি করে দিয়ে গেছেন। আমি শুধু সেই কাজগুলো সম্পন্ন করে যাচ্ছি এবং দিনরাত এদেশের মানুষের জন্যই পরিশ্রম করি। আমার আর কোন কাজ নাই। একটাই কাজ দেশের উন্নয়ন করে মানুষকে একটা সুন্দর জীবন দেব, উন্নত জীবন দেব। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামমুখর জেলজীবনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বাবার (জাতির পিতা) সঙ্গে তো দেখা হতো কাছেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখানেই দেখা হতো। এটা হলো বাস্তবতা। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন এদেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষও যেন দু’বেলা পেট ভরে খেতে পারে, তাদের বাসস্থান হয়, চিকিৎসা হয়, সুন্দরভাবে জীবন পেতে পারে। ঠিক সেই লক্ষ্যটা পূরণ করাই আমার একমাত্র কাজ এবং সেটাই আমি করে যাচ্ছি। আর এটা করতে পেরেছি বাংলাদেশের জনগণ নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে তাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে। সেজন্য এটা করা সম্ভব হয়েছে। আগামী প্রজন্মের জন্য ভবিষ্যতে কিভাবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চাই সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই ডেল্টা প্লান-২০১১ দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। অনেক বাধা ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই আমাদের এগুতে হচ্ছে। তবে জাতির পিতা যে কথাটি ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলে গিয়েছেন, সেটাই সবসময় মনে করি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাঙালী জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। কেউ দাবায়ে রাখতে পারে নাই, দাবায়ে রাখতে পারবে না। এটাই হলো বাস্তবতা। বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসা সেবা দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য সরকারের বিভিন্ন গৃহীত পদেক্ষপ ও কর্মসূচীর কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে এবং তাদের সুন্দর স্বাস্থ্য ও উন্নত জীবন হবে, এটাই আমাদের লক্ষ্য। বার্ন ইনস্টিটিউটের সাফল্য কামনা করে এটা মানুষের সেবায় নিবেদিত প্রাণ হয়ে বিশ্বে একটা শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠুক সেই প্রত্যাশা করেন। পাশাপাশি জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলব সেই অঙ্গীকার করে ‘শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক ডাঃ সামন্ত লাল সেন ও সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের প্রধান মেজর জেনারেল সিদ্দিকুর রহমান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব সিরাজুল হক খান। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল এই ইনস্টিটিউটটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং মূল ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল। জোড়া লাগা রাবেয়া-রোকাইয়াকে দেখলেন প্রধানমন্ত্রী ॥ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জোড়ার মাথার শিশু রাবেয়া ও রোকাইয়াকে দেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের উদ্বোধন করতে এসে বহির্বিভাগে জোড়া মাথার শিশু দুটিকে দেখেন এবং তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী। বুধবার শিশু দুটিকে দেখার সময় প্রধানমন্ত্রী তাদের হাত ধরে আদর করেন এবং ¯েœহের পরশ বুলিয়ে দেন। একইসঙ্গে শিশু দুটির চিকিৎসার খোঁজ খবর নেন। জোড়া মাথার প্লাস্টিক মডেলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা শিশু দুটির চিকিৎসার পরিকল্পনা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। চিকিৎসরা জানান, শিশু দুটিকে ধাপে ধাপে আলাদা করতে হবে। আলাদা করার অগ্রগতি হিসেবে ১৮ মাস বয়সে রাবেয়া ও রোকাইয়ার মাথায় যুক্ত রক্তনালী অপারেশন করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যাতে দু’জনের জন্য আলাদা রক্তনালী চালু হয়। এ সময় শিশু দুটির বাবা-মা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গেও কথা বলেন। তাদের সান্ত¦না ও সাহস দেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা।
×