ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

২৫ কিমি জিরো পয়েন্ট অরক্ষিত

মিয়ানমার সীমান্তের ১৫ পয়েন্ট দিয়ে আসছে ইয়াবা

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ২০ অক্টোবর ২০১৮

   মিয়ানমার সীমান্তের  ১৫ পয়েন্ট দিয়ে আসছে ইয়াবা

এইচ এম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ বাংলাদেশ-মিয়ানমার দুই দেশের সীমানা চিহ্নিত খাল নাফ নদীর ২৫ কিলোমিটার জুড়ে জিরো পয়েন্ট অরক্ষিত থাকায় প্রতিনিয়ত ইয়াবার চালান নিয়ে আসছে চোরাচালানিরা। ওপারের সীমান্ত এলাকা জুড়ে কাঁটাতারের ঘেরা থাকলেও এপারে তা নেই। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির ১৫টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবার চালান দেশে প্রবেশ করাচ্ছে তারা। ইয়াবার চালান খালাসের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে মাদককারবারিদের হাতের মুঠোফোন। সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত থাকায় বাংলাদেশে ইয়াবার চালান আসা রোধ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন অভিজ্ঞ মহল। সূত্র জানায়, সীমান্তের বাংলাদেশ অভ্যন্তরে স্থাপিত একাধিক মোবাইল কোম্পানির টাওয়ারের ফ্রিকোয়েন্সি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রায় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এ জন্য চোরাচালানিরা নাফ নদীর একাধিক জিরো পয়েন্টকে টার্গেট করে মুঠোফোনের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে প্রতিনিয়ত। মিয়ানমার থেকে নিষিদ্ধ পণ্য নিয়ে দেশে আগন্তুকদের জানান দিচ্ছে টহলরত সীমান্তরক্ষী বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে। সীমান্ত অঞ্চলে (মিয়ানমার অংশে) মুঠোফোনের ফ্রিকোয়েন্সি থাকায় চোরাচালানিরা তাদের রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে আসছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন কোন না কোন সীমান্ত পয়েন্টে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করছে ইয়াবার চালান। গত তিনদিন ধরে টেকনাফ ও কক্সবাজারে টাস্কফোর্সের সাঁড়াশি অভিযানও চলছে। তিনদিনে ২৪ জন তালিকাভুক্ত মাদককারবারির বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে। গডফাদার কাউকে পাওয়া না গেলেও একজন চিহ্নিত ইয়াবা কারবারির ছেলেকে আটক করেছে টাস্কফোর্স। জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত কয়েকজন ইয়াবা গডফাদার গ্রেফতার হচ্ছে না বলে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান ঠেকানো যাচ্ছে না মোটেও। র‌্যাব, কোস্টগার্ড ও বিজিবি সদস্যরা নিরলস টহল জোরদার এবং তৎপরতা অব্যাহত রাখলেও ওইসব চিহ্নিত গডফাদার কর্তৃক গঠিত সিন্ডিকেটের কারণে ইয়াবার চালান আসছে দেশে। বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ ইয়াবা ডিলারের বাড়ি টেকনাফে হলেও তিনি বর্তমানে অবস্থান করছে ঢাকায়। কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে তার সহোদরকে ইয়াবার চালানসহ আটক করেছে পুলিশ। তার ছোটখাট চালান ধরা পড়লেও ওই ডিলারের মুঠোফোনের গ্রীন সিগন্যালে বড় বড় ইয়াবার চালান জব্দ করা সম্ভব হচ্ছে না। ইন্টারনেটের মাধ্যমে মিয়ানমারের ইয়াবা কারখানা মালিকদের সঙ্গে হরদম যোগাযোগ রয়েছে ওই ইয়াবা ডিলারের। ওপারের ফ্যাাক্টরি থেকে বাংলাদেশে কৌশলে চালান পাঠিয়ে থাকে তার আপন মামা। ইন্টারনেটে ভাগিনার সিগন্যাল পেলেই ইয়াবার চালান নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বুঝিয়ে দেয় তার মামা। সীমান্ত এলাকা ঘুরে বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এ তথ্য। সূত্র জানায়, টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপের বদর মোকাম হতে হ্নীলা ওয়াব্রাং পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার নাফ নদীর জিরো পয়েন্ট অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। মিয়ানমারের পেশাদার চোরাচালানিরা জেলের ছদ্মবেশে নাফ নদীতে অবস্থান নেয় নির্দিষ্ট সময়ে। বাংলাদেশের চোরাচালানিরা নদীর মধ্যখানে পৌঁছলে মিয়ানমারের অসাধু ব্যক্তিরা শুধু হাতবদল করে থাকে। ওই সময় বুঝে নেয়া হয় ইয়াবা চালানের মূল্য বাবদ একটি ছোট টোকেন। ওই টোকেনটি নিয়ে ফিরে যায় ওদেশের নাগরিকরা। ওপারে পৌঁছে তারা মুঠোফোনে টোকেনের সাঙ্কেতিক চিহ্ন-নম্বরটি বললে চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে হুন্ডির মাধ্যমে মিয়ানমারে ইয়াবা এজেন্টদের কাছে সহজে পৌঁছে যাচ্ছে টাকা। এদিকে দেশের পেশাদার ইয়াবা কারবারিরা নাফ নদীর কিনারায় এসে মোবাইল ফোনে জেনে নিয়ে থাকে বিজিবি-কোস্টগার্ডের অবস্থান সম্পর্কে। পরে ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা সুবিধা মতে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে কৌশলে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে আসে ইয়াবার চালান। চোরাচালানি ও নিষিদ্ধপণ্য বহনকারী রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারের জিরো পয়েন্টে নিরাপদে ইয়াবা চালানের জন্য অপেক্ষা করতে পারে- এজন্য সে দেশের সীমান্ত রক্ষীর কতিপয় কর্মকর্তার সঙ্গে সাপ্তাহিক চুক্তিও রয়েছে বলে সূত্রটি দাবি করেছে। সূত্র আরও জানায়, মিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড় চালান অভিনব কৌশলে উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ি ও টেকনাফের ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে দেশে প্রবেশ করানো হচ্ছে। পয়েন্টগুলো হলো- শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, সাবরাং নয়াপাড়া ঘাট, নাজিরপাড়া আড়াই নম্বর সøুইসগেট, নাইট্যংপাড়া, জাদিমুড়া, হ্নীলার একটি প্রসিদ্ধ মৎস্য প্রজেক্ট এবং ওয়াব্রাং এলাকা। উখিয়ার বালুখালী, রহমতের বিল, দরগাবিল, টাইপালং, ঘুমধুম ও তুমব্রু। এছাড়াও টেকনাফ স্থলবন্দর হয়ে মিয়ানমার থেকে আমদানি হয়ে আসা পণ্যের আড়ালে ইয়াবার বড় বড় চালান কৌশলে খালাস এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ইতিপূর্বে স্থলবন্দরে অভিযান চালিয়ে বিজিবি প্রায় ৫ কোটি টাকার ইয়াবা উদ্ধার ও দু’দেশের ২ চোরাচালানিকে আটক করেছিল। ওই সময় আটক ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তি মতে ইয়াবার গডফাদারের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেছিল বিজিবি। কিন্তু ক্ষমতার দাপট ও নগদ টাকার জোরে পুলিশী তদন্তে ওই গডফাদার পার পেয়ে গেছে চার্জশীট থেকে।
×