ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পকলার বিশ্বায়ন

প্রকাশিত: ০৭:১০, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

শিল্পকলার বিশ্বায়ন

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্পধারার সাথে বিশ্বের সমকালীন শিল্পকলার সমন্বয়, বিনিময় এবং সহাবস্থান সৃষ্টিতে বিরাট ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এবারের আয়োজনে সর্বাধিক শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে। এ শিল্প-প্রদর্শনী পরিদর্শনের মাধ্যমে একজন শিল্পী বা শিল্প-সমঝদার বাংলাদেশের সমকালীন শিল্প চর্চার গতি-প্রকৃতির পাশাপাশি বিশ্ব- শিল্পের বর্তমান গতি-প্রকৃতি ও প্রবণতা সম্পর্কে একটি সম্পন্ন ধারণা লাভ করতে সক্ষম হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন- ‘শিল্প সত্য- সুন্দর, শিল্প কল্যাণ, শিল্প স্বপ্ন এবং শিল্প মানে জীবনকে উদযাপন। হিংসার উন্মত্ততা, হানাহানি, সহিংসতা, অমানবিকতা, শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে শিল্প হয় বিচলিত, হয় প্রতিবাদী। ১৮তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী বিশ্ব শিল্পের এই মহাযজ্ঞে বিশ্বশিল্পীদের শিল্পকর্মে প্রস্ফুটিত হবে মানবতার জয়গান।’ এবারের দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর বিশেষ আকর্ষণের দিক প্রচলিত প্রায় সব শিল্পধারার সমাবেশ এবং শিল্পকর্ম উপস্থাপনের নান্দনিকতা। শিল্পকর্ম পরিবেশনের নৈপুণ্যের পাশাপাশি এবারের ক্যাটালগটিও প্রকাশনার শিল্পগুণে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। ১৮তম এশীয় চারুকলার আয়োজন উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে স্মারক ডাকটিকিট, যা আয়োজনের সার্বিকতাকে শিল্পী ও সুধীসমাজের কাছে আরও অর্থবহ করে তুলবে । এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী ইতোমধ্যে বাংলাদেশের শিল্পীসমাজের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণের উপলক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে আর ১৮তম আয়োজনের সার্বিক জাগরণকে উপলব্ধি করে আমরা বলতে পারি, অদূর ভবিষ্যতে এ আয়োজন বিশ্বের শিল্পী সমাজেরও আকর্ষনের অন্যতম কেন্দ্ররূপে আদৃত হবে। দুই. এবারের দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর আয়োজনে নানাদিক থেকে সমৃদ্ধির প্রকাশ ঘটেছে। এটা যেমন অংশগ্রহণের দিক থেকে তেমনি বিষয়ানুষঙ্গের বিপুল সমাবেশ আয়োজনকে আলোকিত করেছে। ৬৮ দেশের শিল্পীদের শিল্পকর্ম এ আয়োজনে প্রদর্শীত হচ্ছে। বিদেশের ২৬৬ জন শিল্পীর ৩৮০টি শিল্পকর্মের মধ্যে ৩০০টি ছিল প্রতিযোগিতার আওতায়, বিশেষ আমন্ত্রিত শিল্পীদের কাজ রয়েছে ৬৬ টি এবং ১৪ জন শিল্পীর পারফরমেন্স আর্ট এ আয়োজনকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের ১৯৯ জন শিল্পীর রয়েছে ২০৩টি শিল্পকর্ম, তার মধ্যে প্রতিযোগিতার আওতায় ছিলো ১০৭ জন শিল্পীর ১১৪টি কাজ, বিশেষ আমন্ত্রিত শিল্পীদের ৬০টি কাজ, আমাদের বরণ্যে শিল্পীদের ১৩টি শিল্পকর্ম এবং ছিল ১৬ জন পারফরমেন্স আর্টিস্টের নান্দনিক প্রদর্শনী। ৬৮ দেশের ৪৬৫ জন শিল্পীর ৫৮৩টি শিল্পকর্মের এই মহাযজ্ঞে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে পেইন্টিং, প্রাচ্যকলা, ভাস্কর্য, মৃৎশিল্প, ভিডিও আর্ট, আলোকচিত্র, নিউ মিডিয়া, ট্যাপেস্ট্রি, পারফরমেন্স আর্ট এবং স্থাপনা শিল্প। বিশেষ সংযোজন হিসেবে রয়েছে হস্ত ও কারুপণ্য মেলা, শিশু কর্নার, আর্ট ক্যাম্প, পারফরমেন্স আর্ট ওয়ার্কসপ, বিশেষ লাউঞ্জ, ফুড কোট এবং ভাস্কর্য উদ্যান। শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামীর তত্ত্বাবধানে দেশের ১২ জন নবীন শিল্পীর অংশগ্রহণে উপস্থাপিত হয়েছে ‘ইয়াং আর্ট প্রজেক্ট : বিন্দু বিসর্গ’। এই প্রজেক্টটি এবারের আয়োজনের এটি আলোকিত অংশ। দেশের তরুণ শিল্পীরা এতে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে একটি বৃহৎ দৃশ্যপটে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ১৮তম দ্বিবার্ষিকে জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশের শিল্পী শাহাবুদ্দিন ও শিল্পী আবুল মনসুর। ফ্রান্সের অধ্যাপক ফ্রাঙ্কুইজ মোন্নিন, ভারতে কৃষ্ণা সেটি এবং স্পেন থেকে আগত মিজ ব্লাঙ্কা ডেলা তরে। পর্যবেক্ষক হিসেবে এবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছেন বিশিষ্ট শিল্পী ও লেখক উবনড়ৎধয উুবৎ ঋৎরুুবষষ, পোল্যান্ড থেকে এসেছেন আন্তর্জাতিক আর্ট ক্রিটিক এ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি গৎ. গবৎবশ ইধৎঃবষরশ এবং জাপান থেকে এসেছেন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের চৎড়ভবংংড়ৎ ঊসরৎধঃং ঞবংঃঁংুধ ঘড়ফধ. এশীয়া এবং এশীয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ১৪টি দেশ নিয়ে ১৯৮১ সালে দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর সূচনা হয়। ১৬ তম প্রদর্শনী থেকে এ আয়োজনকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয় যার ফলে ১৭তম প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিল ৫৫টি দেশ এবং ১৮তম আসরে অংশগ্রহণ করেছে ৬৮টি দেশ। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সাফল্য হচ্ছে সকল বাধা-বন্ধকে এড়িয়ে ১৯৮১ সাল থেকে এই আয়োজনকে অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাওয়া। দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী এশীয়ার সবচেয়ে প্রাচীন আয়োজন এবং এটি শিল্পকলার একটি বৃহৎ শিল্পায়োজন হিসেবে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত সাময়িকী অৎঃ রহ অসবৎরপধ এবং হংকং ভিত্তিক সাময়িকী অৎঃ ৎবারবি তে দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীর সংবাদ পরিক্রমা প্রকাশিত হয়েছে। এই সংবাদ সূত্রগুলো বিশ্বব্যাপী এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীকে ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিদেশী শিল্পীদের সম্মানে এশীয় চারুকলার এ আয়োজনে এবার আরও ছিল জরাবৎ ঈৎঁরংব এবং ঢাকা শহরের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থান পরিদর্শন। এ’দুটি কর্মসূচি বিভিন্ন দেশ থেকে আগত শিল্পীদের সামনে নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃতি এবং আমাদের কৃষ্টি ও ইতিহাসকে তুলে ধরবে। বাংলাদেশের ১৭ জন চিত্র শিল্পী এবং ৭ জন বিদেশী শিল্পীর অংশগ্রহণে হবিগঞ্জের একটি স্পটে সম্পন্ন হয়েছে আন্তর্জাতিক আর্টক্যাম্প। এই আর্টক্যাম্প দেশের সমকালীন চিত্রধারার সাথে আন্তর্জাতিক চিত্রকলা এবং শিল্পভাবনার মেলবন্ধন সৃষ্টিতে বিরাট ভূমিকা রাখবে। এবারের আয়োজনের তাৎপর্যপূর্ণ অংশ আন্তর্জাতিক সেমিনার। দুইদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সেমিনারের শীর্ষনাম ছিল দঅৎঃ ধহফ ঈড়হঃবসঢ়ড়ৎধৎু ঘধৎৎধঃরাবং’ এবং জড়ঁহফ ঃধনষব ফরংপঁংংরড়হ সম্পন্ন হয়েছিল ‘অৎঃ, চবফধমড়মু ধহফ চৎড়সড়ঃরড়হ’ বিষয়ের উপর। সেমিনারে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপনা করেছেন গঁংঃধভধ তধসধহ সেখানে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন দেশ-বিদেশের শিল্পী ও শিল্প-সমালোচকগণ। সেমিনারের মূল প্রবন্ধ, আলোচনা ও প্রেস মেটারগুলোর সমন্বয়ে এবং উৎ. ঝযধসংধফ গড়ৎঃুঁধ এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে একটি চমৎকার পুস্তিকা, যা সেমিনারের তাৎপর্য উপস্থাপনের পাশাপাশি আলোচনা ও নিবন্ধগুলোর সংরক্ষণ স্মারক হিসেবেও দীর্ঘদিন ভূমিকা রাখবে। বরাবরের মতো এবারও ৯ জন শিল্পীকে দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলার প্রদর্শনীতে পুরস্কৃত করা হয়। গ্রান্ড প্রাইজ বিজয়ী তিনজন হলেন : আতিয়া ইসলাম (বাংলাদেশ), কানদন জি (ভারত) এবং সালমা জাকিয়া বৃষ্টি (বাংলাদেশ)। সম্মানসূচক পুরস্কার বিজয়ী শিল্পীরা হলেনÑ কামরুজ্জামান স্বাধীন (বাংলাদেশ), মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম মজুমদার (বাংলাদেশ), মুনতাহের আল জাবেরি (ফিলিস্তিন), নাজমুন নাহার কেয়া (বাংলাদেশ), ত্রিরাত শ্রীবুরিন (থাইল্যান্ড) এবং উ জুন (চীন)। এবারের আয়োজনে বাংলাদেশী শিল্পীদের শিল্পকর্ম নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন : শিল্পী শহিদ কবির, শিল্পী অলক রায়, শিল্পী রণজিৎ দাস, শিল্পী রোকেয়া সুলতানা, শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য এবং শিল্পী কনকচাঁপা চাকমা। আয়োজনের জন্য বাংলাদেশী শিল্পীদের বিভিন্ন ধরন-প্রকরণ ও আধুনিক প্রবণতার শিল্পকর্মের সমাবেশ হলেও একটি বিষয় দৃশ্যমান হয়েছে সেটি হলো, দেশের নিজস্ব শিল্পধারার অর্থাৎ লোক আঙ্গিকের শিল্পকর্মের অপ্রতুলতা। জাতির শেকড় তথা অস্তিত্ব সন্ধানের বিষয়টিও শিল্পকলার একটি অনিবার্য অংশ, আশা করছি আমাদের শিল্পীরা এ বিষয়ে আরও যতœবান হবেন এবং শিল্পের মাধ্যমে নিজস্ব কৃষ্টি, প্রকৃতি ও সুকুমারশৈলীকে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করবে। তিন. শিল্পকর্মের নান্দনিক উৎকর্ষতার বিবেচনায় এবারের দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী পূর্ববর্তী আয়োজনগুলোকে অতিক্রম করেছে। পুরস্কার বিজয়ী নয়টি শিল্পকর্ম ছাড়াও অনেক কাজ গুণে-মানে-সৌন্দর্যে প্রদর্শনীকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রবন্ধের এ পর্যায়ে তেমন কয়েকটি শিল্পকর্ম সম্পর্কে স্বল্পবাক্যে কিছু ভূমিকা উপস্থাপন করছি। ঝযড়পশ ড়ভ ঃযব ঘবি অস্ট্রেলিয়ান শিল্পী চবঃবৎরং ঈরবসরঃরং এর আঁকা একটি চিত্রকর্ম। এতে বিপন্ন মানুষের এক করুণ দৃষ্টিপাত ক্যানভাসের সমগ্রসীমাকে সিক্ত করেছে যা সম্পন্ন মানুষের দৃষ্টিকে পটের চক্ষুদ্বয়ের মতোই আহত করেছে। আজ নতুনের পৃথিবীও কতিপয় মানুষের অনাচারে আর নতুনের মতো স্বচ্ছ-সতেজ থাকলো না, এই চৈতন্য শিল্পীর মননকে আকীর্ণ করেছে। সেই অন্ধ-অসহ রোদনের ব্যাঞ্জনা তাঁর চিত্রে ফুটে উঠেছে। জবফ ঝঃড়হব ভড়ৎবংঃ চীনা শিল্পী খরঁ ঔঁহলরব এর আঁকা চিত্রকর্ম। লাল পাথরের বনেও কিছু সাদা থাকে, ফুল থাকে কিছু অর্থাৎ সুন্দরের অপূর্ব সমাবশে হতে গেলে যেমন বৈচিত্র প্রয়োজন তেমন প্রয়োজন বিচিত্র বিষয়ের সমন্বয়। এই চিত্রকর্মে বিষয়ের সমন্বয় এত নিঁখুত হয়েছে যে এটিকে ঐুঢ়বৎৎবধষরংস (অতিবাস্তববাদ) ধারার চিত্র বলে গণ্য করা যায়। বাস্তবের উপস্থাপনা যখন অবিকল কোনও বস্তুনিষ্ঠতাকে প্রদর্শন করে তখন সেরূপ চিত্রকে অতিবাস্তব বলে সাব্যস্ত করা হয়। এই চিত্রকর্ম নির্দিষ্ট অবস্থানের বস্তসমষ্টিকে দারুণ নৈপুণ্যে তুলে ধরা হয়েছে। উড়ফড় ওংষধহফ ঞযৎড়ময রিহফড়-ি১ধহফ ২ মরিশাস এর শিল্পী উবা অহধহফ ঈযড়ড়ৎধসঁহ এর আঁকা দুটো চিত্রকর্ম। ছবি দুটোতে মানবশূন্য দ্বীপদেশের নিসর্গকে তুলে ধরা হয়েছে। তবে চিত্রগুলোতে নিসর্গের স্বাভাবিক প্রকৃতির বাইরে শিল্পী তাঁর নিজস্ব চৈতন্যেরও প্রয়োগ ঘটিয়েছেন যার ফলে চিত্রগুলোতে স্যুরিয়ালিস্টিক আবহ সৃষ্টি হয়েছে এবং এতে নিসর্গ ও চেতনা-প্রবাহের সংমিশ্রণে ভিন্নতর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়েছে। দৃশ্যকে আপনমতো গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় যে ভাষ্য চিত্র দুটোতে তৈরি হয়েছে তা শিল্প-পিয়াসুকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করবে। দঞযব ঐড়ৎংবসবহ’ চিত্রকর্মটি মঙ্গোলিয়ান শিল্পী ঊহশযনধঃ খশযধমাধফড়ৎল এর আঁকা। অদম্য-অবাধ্য অশ্বগুলোকে পরিচালনে অক্ষম ক্লান্ত-শ্রান্ত কিছু অশ্বারোহী এই চিত্রের পুরোভাগে রয়েছে। তবে গভীরভাবে তাকালে দেখা যায়, ওদের পশ্চাদভাগের নিচে কোন অশ্ব নেই । রয়েছে অশ্বের ভগ্নাংশ, পালক, কেশর ও উদভ্রান্ত গতির ছুটোছুটি। এই চিত্রের মধ্যে গতিবিশ্বের অনমনীয় উদ্দাম ধাবমানতাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গতির দানবিকতার সাথে মানুষ পেরে উঠেছে না, ওরা ক্লান্ত- বিধ্বস্ত পড়ে আছে। চিত্রটির মধ্যে বাস্তব ও বিমূর্ত দুই ধারার সংমিশ্রণে অধিবাস্তব প্রাণ-প্রবাহ রচিত হয়েছে। ‘ডযবহ ঃযব ঐধঃ ভধষষং’ এবং ঐরহঃ এদুটো চিত্রকর্ম তাজিকিস্তানের শিল্পী টনধুফঁষষড়বা অনফঁষষড়লড়হ এর আঁকা। তাঁর চিত্র দুটোর আকর্ষণীয় বিষয় বর্ণের তারল্য এবং অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। অবশ্য রঙের ব্যবহার ও আবহের প্রচ্ছন্নতার বিবেচনায় চিত্রগুলোকে ইমপেশ্রনিস্ট (ওসঢ়ৎবংংরড়হরংঃ) ধারার কাজে বলা যায়। কিন্তু প্রীত-মুহূর্তে যখন প্রেমিকের মাথার হেট পড়ে গেল, ঢলে পড়া দুই নবীন-যুগলের সেই ক্ষণচিত্রের দৃশ্যটি শিল্প-রসিকের কাছে বড় মূল্যবান। দুটো রোমেন্টিক চিত্র তিনি পটে তুলেছেন কিন্তু সেখানে যে সুপ্ত-সুন্দরকে স্থাপন করেছেন তাই চিত্রগুলোকে বিশেষ অলঙ্কার পরিয়েছে। দঈড়সব ইধপশ ঈধৎধাধহ’ উজবেকিস্তানের শিল্পী ঞঁৎংঁহনড়বাধ ঝযড়রৎধ এর আঁকা চিত্র-কর্ম। একটি ক্যারভান বাণিজ্য শেষে নিজ বাসভূমে ফিরে এলো। যে দৃশ্য বহুদিন ওরা ভুলেছিল, সেই দৃশ্যে এসে অশ্বারোহীদের মনে ভুলে যাওয়া স্মৃতি ভেসে ওঠল। ওরা উদ্বেলিত, আনন্দের স্বপ্নে ভেসে ওরা নিজ ভূমির দিকে যেনো আরও গতিশীল হলো। শান্ত-সুন্দর আবহে এই চিত্রে মধ্যযুগের বাস্তবতা ফুটে ওঠেছে। সেটা হয়তো সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে আজও বাস্তব, সে যাই হোক চিত্রটি আমাদের পুস্তকে লেখা ঐতিহাসিক বস্তুবিশ্বকে প্রাণবান করেছে, আমরা এখানে ধীর মনে অতীত পর্যটনে যেতে পারি। ইঁৎফবহ খরভব ১-৩ বাংলাদেশী শিল্পী অ জধযসধহ-এর তিনটি চযড়ঃড় গধহরঢ়ঁষধঃব. চিত্রগুলোকে একত্রে দেখলে অর্থ-উদ্ধারে সমস্যা হবার অবকাশ নেই। আমাদের ভারগ্রস্ত, ক্লান্ত, রক্তাক্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি এসব; জীবন যেখানে পরাধীন এবং অন্যের ভার-বয়ে ক্লান্ত সেই নাগরিক বিপন্ন জীবনচিত্র এই দৃশ্যগুলোতে ফুটে ওঠেছে। শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা ঝলসানো লাল রং চিত্রগুলোর ভাষ্য প্রকাশে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি শিল্প হিসেবে এগুলোর নান্দনিক মূল্যকেও সযতেœ সংরক্ষণ করছে। ঝঃড়ঢ় ঃযব এবহড়পরফব বাংলাদেশের শিল্পী উবনধংযরং চধষ এর একটি ইনস্টলেশন আর্ট। এতে সামগ্রী হিসেবে টেরাকোটা দিয়ে তৈরি মুখপট এবং মমি স্থাপন করা হয়েছে। এই শিল্পকর্মটির মাঝামাঝিতে বাংলাদেশের মানচিত্রকে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে শিল্পী উবনধংযরং চধষ সাম্প্রতিক বাংলাদেশের নৈরাজ্য, খুন, গুম ও হত্যাকা-ের বিষয়ে তার শিল্প-বিবৃতি উপস্থাপন করেছেন। শিল্প সর্বদা যে নিথর-নিসর্গকে অবলম্বনের মাধ্যমে সুন্দরের স্তব গাইবে তা নয়; শিল্পী সমাজের প্রতিনিধি হয়ে কখনও কখনও প্রতিবাদী উচ্চারণে, অঙ্কনে এবং চেতনাদীপ্ত-লিখনের মাধ্যমে গণমানুষকে জাগ্রত ও সম্মিলিত হতে বলে; এই শিল্পকর্ম এমনই একটি ধ্বস্ত-ব্যথিত দৃশ্যপটের মর্মান্তিক বিবৃতি। ১৮তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর আয়োজনে শিল্পকলার প্রায় সকল প্রকরণের যেমন সমাবেশ ঘটেছে তেমনি সেসব শিল্পকর্ম গুণে-মানে-নন্দনে শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালার গ্যালারিগুলোকে শিল্পের একেকটি আলোকিত পটভূমিরূপে গড়ে তোলেছে। বিশ্বায়নের অগ্রযাত্রায় যখন বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন, রূপান্তর ও বিনিময়ের জোয়ার লেগেছে তখন বাংলাদেশও এর থেকে দূরে নেই। বিশ্ব শিল্পের মহাযজ্ঞে এবার সমবেত হয়েছেন বিশ্বের ৬৮ দেশের শিল্পীরা; তাঁদের ভাব, কল্পনা ও কীর্তির সম্মিলনে বিশ্বায়ন ঘটেছে শিল্পের।
×