ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগ জন্মের উজ্জ্বল স্মৃতি, এখন হবে নগর জাদুঘর

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৯ আগস্ট ২০১৮

আওয়ামী লীগ জন্মের উজ্জ্বল স্মৃতি, এখন হবে নগর জাদুঘর

মোরসালিন মিজান ॥ অট্টালিকার শহর ঢাকা। কত বাড়ি এ শহরে! নতুন নতুন নক্সা। দেখে চমকিত হতে হয়। কিন্তু রোজ গার্ডেনের আলাদা সৌন্দর্য। এর স্থাপত্যশৈলী নক্সা পরিপার্শ্ব দীর্ঘকাল ধরে ঢাকাবাসীকে মুগ্ধ করে রেখেছে। পুরান ঢাকায় অবস্থিত প্রাসাদোপম বাড়ি। দীর্ঘকালের পুরনো বাড়ি বিভিন্ন সময় বহুবিধ কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এবং এখানেই গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। কত চাওয়ার আর ত্যাগের পর পাকিস্তান! সেই পাকিস্তান যখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে ঠিক তখন নতুন স্বপ্ন সামনে রেখে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বাঙালী। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মুহূর্তটির বিরল সাক্ষী রোজ গার্ডেন। ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতœসম্পদ হিসেবে এটি সংরক্ষিত হচ্ছিল। আর তার পর দারুণ খবরটি এলো। বুধবার জানা গেল, গৌরবের ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ থেকে এ বাড়ি ক্রয় করার সিদ্বান্ত নিয়েছে সরকার। অর্থমূল্য ধরা হয়েছে ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ ২ হাজার ৯০০ টাকা। এদিন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোস্তাফিজুর রহমান জানান, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন অনুসারে সরকার সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বর্তমান মালিকদের কাছ থেকে রোজ গার্ডেন ক্রয় করবে। এ খবরের মধ্য দিয়ে নতুন করে সামনে এলো বাড়িটির ইতিহাস। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, বাড়িটির ব্যাপারে অনেকদিন ধরেই নেগোসিয়েশন হচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে এখানে নগর জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হবে। জাদুঘরে বাঙালীর সংগ্রাম সংস্কৃতি ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্য ফুটিয়ে তোলা হবে। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে বলে জানান তিনি। নান্দনিক সৌন্দর্যে অতুলনীয় বাড়িটি টিকাটুলির কে এম দাস লেনে অবস্থিত। যতদূর তথ্যÑ এটি নির্মিত হয়েছিল সেই ১৯৩০ সালে। উন্নত রুচি ও অভিজাত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভবনটি নির্মাণ করেন জমিদার হৃষিকেশ দাস। সাত একর জমির ওপর বিশাল দৃষ্টিনন্দন ভবন। বাড়ির মতোই সুন্দর চারপাশ। উদ্যানে চমৎকার ফুলের বাগান করা হয়েছিল। বিশেষভাবে দৃশ্যমান হতো গোলাপ। হরেক রকমের গোলাপ ফুটে থাকত বাগানে। বাগানের জন্য চীন, ভারত, জাপান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে মাটিসহ গোলাপের চারা এনে লাগানো হয়েছিল। যতদূর তথ্য, এ কারণেই বাড়িটির নাম রোজ গার্ডেন। অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপনা উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। সাত হাজার বর্গফুট আয়তনের প্রাচীর। এ প্রাচীর টপকে এখন আর দেখা যায় না ভবনটি। কারণ সাধারণের প্রবেশ অনেক বছর ধরেই বন্ধ রয়েছে। ১৯৮৯ সাল থেকে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর স্থাপনাটি সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, বাড়িটি হৃষিকেশের সময়ই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠানের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল। ভারত বিভাগের পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সভা এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের বড় বড় নেতাদের এখানে আসা যাওয়া ছিল। এরই ধারবাহিকতায় ১৯৪৯ সালে বাড়িটি আওয়ামী লীগ জন্মের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়। বরেণ্য ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন জানান, ওই বছর রোজ গার্ডেনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় বলে জানান তিনি। নব গঠিত দলের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। পরবর্তীকালে ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে নাম রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।’ পরবর্তীতে দলটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামে পরিচিতি লাভ করে। ক্ষণজন্মা পুরুষ অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নতুন প্রাণ পায় দীর্ঘ দিনের পুরনো এই দল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আব্দুল হামিদ খান ভাসানির মতো নেতারা রোজ গার্ডেনে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করেছেন। একইভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিধন্য এই বাড়ি। বর্তমানে বাড়িটির মালিক আব্দুর রশিদের মেজ ছেলের স্ত্রী লায়লা রকীবের বর্ণনা থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি কাজী মোহাম্মদ বশিরের সঙ্গে দেখা করতে রোজ গার্ডেনে গিয়েছিলেন। সাদা গাড়িতে করে আসা নেতাকে সেদিন বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন বলে জানান তিনি। ভবনটির উপরিভাগ গম্বুজ আকৃতির। উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। ভিত্তির ওপর ছয়টি বিভিন্ন উচ্চতার থাম। প্রতিটি থামের ওপরিভাগে দৃষ্টিনন্দন নক্সা করা। পাঁচটি অংশে বিভক্ত বাড়ির সবক’টি বারান্দা থেকে বাগানের সৌন্দর্য দেখা যায়। পশ্চিম দিকে মুখ করা বাড়ির সামনের অংশ সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সুন্দর। দূর থেকে দেখেই মন ভরে যায়। ভবনের প্রবেশদ্বারগুলোতে কাঠ ছাড়াও ব্যবহার করা হয়েছে লোহা ও রঙিন বেলজীয় কাঁচ। ফুল লতা পাতার নক্সা করা হয়েছে। আছে বিভিন্ন প্রাণীর চেহারা। তিন তলা বাড়িতে মোট ১৩টি ছোট-বড় কক্ষ। দ্বিতীয় তলায় বিশাল বলরুম। শ্বেত পাথরে গড়া মেঝে। সিলিংয়ে সবুজ কাঁচ। সেখানে ফুলের নক্সা। ভবনের অভ্যন্তরে দারুণ সব ঝাড়বাতি। ছাদে যাওয়ার জন্য রয়েছে প্যাঁচানো সিঁড়ি। এটিও নক্সা করা। বাগানে সুনিপুণ হাতে গড়া ভাস্কর্য। আছে ঝর্ণা ও পুকুর। সব মিলিয়ে অপূর্ব। ইতিহাসবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৬৩ সালে বাড়িটি কিনে নেন ব্যবসায়ী খান বাহাদুর কাজী আবদুর রশীদ। ১৯৩৭ সাল থেকে বাড়িতে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন তিনি। তখন রোজ গার্ডেনের নতুন নাম হয় রশীদ মঞ্জিল। ১৯৬৬ সালে রশিদের দ্বিতীয় পুত্র কাজী আব্দুর রকিব বেঙ্গল স্টুডিও এ্যান্ড মোশন পিকচার্সের কাছে এই সম্পত্তি লিজ দিয়ে দেন। রাজা বাদশা জমিদারদের কাহিনী নির্ভর অনেক চলচ্চিত্রের শূটিং হয় এখানে। সে সময় বেঙ্গল স্টুডিও নামে পরিচিতি পায় ঐতিহাসিক ভবন। এভাবে বহুবিধ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তবে আওয়ামী লীগের জন্ম ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে বিশেষ আলোচিত হয়। আর এখন এটি হবে জাদুঘর।
×