ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

শীঘ্রই একনেকে উঠছে, পাস হলেই ১৪শ’ আদালত রূপান্তরিত হবে ই-কোর্টে

মামলাজট নিরসনে চালু হচ্ছে ই-জুডিসিয়ারি

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৩১ জুলাই ২০১৮

মামলাজট নিরসনে চালু হচ্ছে ই-জুডিসিয়ারি

বিকাশ দত্ত ॥ আইন মন্ত্রণালয় বিচার প্রক্রিয়াকে আরও সহজ, গতিশীল ও মামলা জট নিরসনে ই- জুডিসিয়ারি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। শীঘ্রই প্রকল্পটি একনেকের বৈঠকে তোলা হবে। একনেকে প্রকল্প পাস হওয়ার পরপরই এর কার্যক্রম শুরু হবে। এ প্রকল্পের ফলে জনগণ আগে যে সুযোগ-সুবিধা পায়নি তা পাবে। একই সঙ্গে পাহাড়সম মামলা জট অনেকাংশে কমে যাবে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জনকণ্ঠকে বলেছেন, ই-জুডিসিয়ারি বাস্তবায়িত হলে দেশের আদালতের বিচার প্রক্রিয়া আরও সহজ, স্বচ্ছ এবং গতিশীল হবে। ই-জুডিসিয়ারি হলে অনেক কিছুরই উপকার হবে। প্রথমত আদালতগুলো সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজড হয়ে যাবে। ৬৪ জেলায় ১৪০০ আদালত কক্ষ ই-আদালতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। ১৬৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে বিচার ব্যবস্থার জন্য প্রশাসনিক এবং বিচার কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় করা। উল্লেখ্য, প্রকল্পটিতে ১৬ বিষয়ের উপর মূল কার্যক্রম রাখা হয়েছে। সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতীয় সংসদে বলেছেন, দেশের আদালতসমূহে এ বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৩ লাখ ৯৫ হাজার ৬৪৯। ই-জুডিসিয়ারি প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এই সংখ্যা অনেকাংশে কমে যাবে। ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেছেন, বিচার ব্যবস্থার জন্য প্রশাসনিক এবং বিচার কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় করা হবে, ই-আদালত কক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং আইসিটির জ্ঞান ও দক্ষতা দ্বারা বিচারক, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করাসহ নানা ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হবে- যা বাস্তবায়িত হলে দেশে ‘আইনের শাসন’ প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক উন্নতি সাধিত হবে বলে আমি মনে করি। একটি কথা আমাদের মনে রাখা উচিত যে, বাংলাদেশের সৃষ্টিই হয়েছিল সাধারণ মানুষের জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও তার ভৌগোলিক পরিচয় নির্বিশেষে সকলের আইনের আশ্রয় লাভের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আশা করি, এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিচারক এবং আইনজীবীই শুধু নয়, প্রতিটি আদালতের নাজির-পেশকার-পিয়ন-আইনজীবীর সহকারীসহ সংশ্লিষ্ট সকল কর্মচারী ই-জুডিসিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ লাভ করবেন। কেননা, বিচারাঙ্গনের সকলেই যদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করেন, তাহলে বিচারপ্রার্থী সাধারণ মানুষ ই-জুডিসিয়ারি প্রকল্পের সুফল ভোগে ব্যর্থ হবেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে আইন ও বিচার বিভাগ। আর সহায়তায় রয়েছে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিবি)। এ বছরের জুলাইতে শুরু হয়ে শেষ হবে ’২১ সালের জুনে। দেশের ৬৪ জেলাই এই প্রকল্পের আওতায় রয়েছে। প্রকল্পটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো, দক্ষ ও স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। বিচার ব্যবস্থার জন্য প্রশাসনিক এবং বিচার কার্যক্রমের স্বয়ংক্রিয় করা। ই-আদালত কক্ষ প্রতিষ্ঠা করা। আইসিটির জ্ঞান ও দক্ষতা দ্বারা বিচারক, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা। প্রকল্পটির মূল কার্যক্রম করা হয়েছে ১৬ ধাপে। যার মধ্যে রয়েছে বিচার ব্যবস্থার জন্য এন্টারপ্রাইজ আর্কিটেকচার উন্নয়ন। এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ইআরপি) সফটওয়্যার উন্নয়ন। বিচার ব্যবস্থাধীন সকল অফিসের জন্য ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) স্থাপন। আইন ও বিচার বিভাগের ডেটা- সেন্টার আপগ্রেডেশন এবং নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার স্থাপন। সুপ্রীমকোর্টের ডেটা সেন্টার আপগ্রেডেশন এবং নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার স্থাপন। ৬৪ জেলায় মোট ১৪০০ আদালত কক্ষকে ই-আদালত কক্ষে রূপান্তর। ঢাকা ছাড়া ৬৩ জেলায় ৬৩ মাইক্রো ডেটা সেন্টার স্থাপন। আইন ও বিচার বিভাগ এবং সুপ্রীমকোর্টের কেন্দ্রীয় ডেটা। বিচারকদের জন্য ২০০০ ট্যাব/ ল্যাপটপ কম্পিউটার সরবরাহ। রেকর্ডরুম স্বয়ংক্রিয়করণ এবং পুরান রেকর্ডরুমসমূহ ডিজিটালাইজড করা। পূর্বের মামলা রেকর্ড এবং সংশ্লিষ্ট রায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ। ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেমের মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ এবং ডিজিটাল এভিডেন্স রেকর্ডিং। বায়োমেট্রিক এ্যাটেনডেন্স সিস্টেম স্থাপন। ই-কোর্ট রুম বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট নতুন আইন প্রণয়ন করা । বিচার ব্যবস্থার কর্মকর্তাদের ডেস্কটপ কম্পিউটার সরবরাহ। বিচার এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান। জনবল নিয়োগ (১৭০)। আইন ও বিচার বিভাগের আইসিটি সেল এবং অন্যান্য দফতরের আইসিটি সেল / অনুবিভাগ শক্তিশালীকরণ। ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বলের মতে ’৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের আইন-আদালত অঙ্গনে ডিজিটাল প্রযুক্তি সম্পৃক্ত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। উদ্দেশ্য ছিল- বাংলাদেশের আদালতে চলমান মামলার দীর্ঘসূত্রতা এবং মামলার জট কমানো এবং চলমান মামলার তথ্য বিচারপ্রার্থী মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে দেয়া। বিভিন্ন কারণে এই উদ্যোগ শুরু হতে সময় নেয় এবং পরবর্তীতে ২০০১ সালের পর প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালকে প্রধান করে একটি পাইলট প্রজেক্ট গ্রহণ করা হলেও, প্রজেক্টটির সাফল্য বা ব্যর্থতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কিছুই জানতে পারেনি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার গত ’১৬ সাল থেকে আবারও বেশ জোরেশোরে বাংলাদেশের আইন-আদালত অঙ্গনে ডিজিটাল প্রযুক্তি সম্পৃক্ত করার নীতিগত কাজ শুরু করেছে। সরকার ২০১৬ সালে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে দেশের ১০ জেলায় শুরু করে। এর সফলতা অভূতপূর্ব। ঢাকা জেলা কোর্টে এই প্রকল্পের আওতায় অনলাইনে বেশ কয়েকটি আদালতের দৈনিক কজলিস্ট দেখা যাচ্ছে এবং এক বিচারপ্রার্থী ঘরে বসেই তার মামলায় গৃহীত আদেশের সংক্ষিপ্তসার বা তার আইনজীবী কর্তৃক গৃহীত দৈনিক পদক্ষেপ দেখতে পারছেন। বেশ কয়েকটি জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কক্ষের বাইরে টেলিভিশন স্ক্রিনে তাদের মামলায় গৃহীত সিদ্ধান্ত স্বচক্ষে দেখতে পারছেন, এর ফলে সংশ্লিষ্ট আদালত কক্ষের ভিড় অনেক কমে গেছে। আইনজীবীদের মতে, ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেমের মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ এবং ডিজিটাল এভিডেন্স রেকর্ডিংয়ের জন্য আমাদের বিদ্যমান সাক্ষ্য আইন, দেওয়ানি এবং ফৌজদারি আইনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে এবং এই পরিবর্তনের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহকে অতিসত্বর বেজ লাইন সার্ভে শুরু করা প্রয়োজন, যাতে করে তৃণমূল মানুষের যে বিচারিক সংস্কৃতি তা যেন প্রতিফলিত হতে পারে। রেকর্ডরুম স্বয়ংক্রিয়করণ এবং পুরাতন রেকর্ডরুমসমূহ ডিজিটাইজ করা ও পূর্বের মামলার রেকর্ড এবং সংশ্লিষ্ট রায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ- আইনজীবী ও বিচারকদের বহু দিনের দাবি। রেকর্ডরুম স্বয়ংক্রিয়করণ এবং পুরাতন রেকর্ডরুমসমূহ ডিজিটাইজ করা হলে মামলা জট এবং মামলার দীর্ঘসূত্রতাজনিত সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে।
×