ভোর হওয়ার আগেই প্রচার হয়ে গেল দিল্লীর লাল কেল্লার কাছে এক ভবঘুরে মারা গেছে। লোকটা কেল্লার কাছে এক ঝুপড়িতে থাকত। কোথায় বাড়ি, কি কাজ করে কেউ জানত না। পথে পথে ঘুরত আর বিড়বিড় করত বয়স খুব বেশি হয়েছিল বলে মনে হয়নি। তবে চুল দাড়ি সাদা হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সংবাদটি এক কান দু’কান করে এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ল।
-একজন বলল
- লোকটা পাগল ছিল।
-লোকটা সুফি ছিল
-না, গুপ্তচর ছিল।
আলোচনাকারীদের মধ্যে যার যা ইচ্ছা বলে গেল শুধু একজন চুপ করে রইল। তার দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে দাড়ি ভিজে গেল- কেউ লক্ষ্য করেনি। ইতোমধ্যে আরও লোকজন এসে পড়েছে। কযেকজন ইংরেজ সৈন্যও ঘোড়া নিয়ে হাজির হয়েছে। বৃদ্ধ লোকটার কান্না তখনও থামেনি। এবার যে শব্দ করে কাঁদছে। ইংরেজ সৈন্য দেখে তার কান্না বেড়ে গেছে।
একজন একজন সৈন্য সওয়ার বলল-
-এ বুড্ডা তুম রুতা হায় কিউ?
লোকটি উত্তর দিল না। সে মনে মনে বলল- তোমাদের জন্যই নবাব এভাবে আত্মগোপন করে ছিল- জীবিত কালে তাকে তোমরা শান্তি দাওনি।
কথা বলছ না কেন? ভিড়ের মধ্য থেকে একজন জিজ্ঞেস করল।
লোকটা এবারও নিরুত্তর। নবাব মীর কাসেমের সামান্য একজন সৈনিক ছিল সে। সবাই যখন বক্সাসের যুদ্ধে নবাবের পরাজয়ের পর পালিয়ে যায়- তখনও সে নবাবের সঙ্গে ছিল। তারপর থেকেই সে মীর কাসেমের সঙ্গে আছে। ছায়ার মতো আছে। মীর কাসেম নিজেও জানতেন না- তার একজন সামান্য সৈনিক তাকে সর্বক্ষণিক পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। মীর কাসেমের সামনে সব সময় সে বলেছে- আমি একজন গোলাম। সবার গোলাম। মীর কাসেম আর কিছু জানতে চাননি। বেশি কথাবার্তা বললে যদি শেষে নিজের পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়।
-আরে কথা বল। তুমি মাইয়েতকে চিনতে?
-বৃদ্ধ লোকটি বিড়বিড় করে বলে-
-বলব না।
সমবেত লোকজন ইংরেজ সিপাহীরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে।
-আমরা তোমাকেও সন্দেহ করছি।
-কি সন্দেহ করছ সাহেব?
-তুমি একজন গুপ্তচর আর যে লোকটা মারা গেছে সে তোমার সহযোগী।
এবারও লোকটা চুপ করে রইল। তার সামনে ভেসে উঠল ১৭৬০ সালে মীর কাসেমের নবাব হওয়ার দৃশ্য। এ জন্য অবশ্য শ্বশুর মীর জাফরকে সরিয়ে দেয়ার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে তাকে সাময়িক আপোস করতে হয়েছিল। সেটা ছিল দেশ রক্ষার কৌশল। নবাব হয়েই তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধের আগুন জ্বালতে চেয়েছিলেন তার সঙ্গে এই সামান্য সিপাহী জমির উদ্দিনও ছিলেন। জমির উদ্দিনের চোখ দিয়ে এখন পানি নয় যেন আগুন বেরুচ্ছে সে মাথা নিচু করে রইল- শিমলার কোনা দিয়ে চোখ ঢেকে রাস্তার ওপর বসে পড়ল।
ইংরেজ সৈনিকদের মঞ্চে একজন সর্দার কিসিমের অন্যদের হুকুম দিল একে এ্যারেস্ট কর, আর ঘৃণিত স্পাই মাইয়েতের ঘর তল্লাশি চালাও।
তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া গেল একটা পোঁটলা আর একজেল কোরান শরীফ ইংরেজ সৈন্যরা পোঁটলাটি নিয়ে গেল। কোরান শরীফ যেখানে রাখা ছিল সেখানেই রয়ে গেল। চাটাইয়ের বিছানা ময়লা গুদরির দিকে সৈনিকরা ফিরেও তাকাল না।
জমির উদ্দিনকে কোমরে রশি বেঁধে নিয়ে গেল পোঁটলার সঙ্গে। রাস্তায় উৎসুক মানুষের ভিড় তখন কমে গেছে। জমির উদ্দিন চিল্লাচিল্লি করছে। ইংরেজ সিপাইরা বলছে চুপ রও।
-না না আমি চুপ করব না। আমি মীর কাসেমকে ছেড়ে কোথাও যাব না। রাস্তার দু-একজন পথচারী বোধ হয় এ কথা শুনেছিল- মীর কাসেম-
কোথায় তিনি?
তিনি কি ওই ঝুপড়িতে থাকতেন।
হায়। আমরা তাকে চিনতে পারিনি।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাকে চিনতে পারল হাতের আংটি দেখে মায়েতের আংটিতে ফার্সি ভাসায় লেখা ছিল নবাব মনসুউল মূলক মীর কাসিম আলী খান বাহাদুর।
শীর্ষ সংবাদ: