ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘ঈশ্বরের পা’য়ের অধিকারী গোলরক্ষক আকিনফিভ!

প্রকাশিত: ০৭:১১, ৬ জুলাই ২০১৮

‘ঈশ্বরের পা’য়ের অধিকারী গোলরক্ষক আকিনফিভ!

রুমেল খান ॥ জিততে হলে চাই অনেক গুণের সমাহার। যেমন : সদিচ্ছা, সুষ্ঠু পরিকল্পনা, কঠোর পরিশ্রম, অর্থ, সুযোগ-সুবিধা এবং সবশেষে ভাগ্যের একটুখানি পরশ। অনেক সময় দেখা যায় খেলায় সবকিছুর সমন্বয় হলেও শুধুমাত্র ভাগ্যের অভাবেই অনেক দল হেরে যায় দুভার্গ্যজনকভাবে। আবার এই ভাগ্যই সহায় হওয়াতে অনেক দল জয় পেয়ে যায় অপ্রত্যাশিতভাবে। রাশিয়ার কথাই ধরা যাক। এবারের আসরে তারা যে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত চলে আসতে পারবে, সেটা অনুমান করতে পেরেছিলেন কজন? আর রাশিয়াকে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে শেষ আটে নিয়ে আসতে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ‘ঈশ্বরের পা’-এর। আর সে পায়ের মালিক কে জানেন? ইগর আকিনফিভ। ৬ ফুট ১ ইঞ্চির অধিকারী এবং ৩২ বছর বয়সী ইগরের নৈপুণ্যেই রাশিয়া দ্বিতীয় রাউন্ডে স্পেনকে টাইব্রেকারে হারায় ৪-৩ গোলে (নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে খেলা ১-১ গোলে ড্র ছিল)। পেনাল্টি শূটআউটে ইগর স্পেনের কোকে এবং আসপাসের দুটি শট ঠেকিয়ে দলকে অবিস্মরণীয় জয় এনে দেন। বিশেষ করে আসপাসের শটটি তিনি ঠেকান বা পা দিয়ে। শটটি ফেরানোর সময় ইগর একপাশে ডাইভ দেন। কিন্তু বলের লাইনে তিনি ছিলেন না। কিন্তু উড়ন্ত অবস্থায়ই তিনি লক্ষ্য করেন বলটি তার বা পায়ের পাশ দিয়ে অতিক্রম করতে যাচ্ছে, উড়ন্ত অবস্থাতেই ইগর দারুণ দক্ষতায় তার বাঁ পাটি বলে লাগিয়ে দিয়ে সেটা প্রতিহত করেন। আর এ বিষয়টিকেই রাশিয়ানরা মজা করে অভিহিত করেছে ‘ঈশ্বরের পা’ হিসেবে! জানা গেছে রাশিয়ায় ১০০ রুবলের নতুন একটি নোট অচিরেই ছাপা হচ্ছে, যাতে হলোগ্রাফিক ইমেজে লেখা থাকবে ‘কিপার মেকিং এ সেভ উইথ হিজ লেফট ফুট’ বাক্যটি। উল্লেখ্য, ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাঁ হাত দিয়ে ‘চাতুর্যপূর্ণ’ গোল করার পর আর্জেন্টিনার ফুটবল কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনা নিজের ওই হাতকে ‘ঈশ্বরের হাত’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। ইগরের এই নৈপুণ্য মুগ্ধ হয়ে তার ছোটবেলার ফুটবল কোচ পাভেল কোভাল বলেন, ‘ইগর স্পেনের গিয়ার চেয়েও অনেক ভাল গোলরক্ষক। আমি এর আগে দুই গ্রেট গোলরক্ষকের যুগ দেখেছি। লেভ ইয়াসিন যুগ এবং রিনাত দাসায়েভ যুগ। আর এখন দেখছি ইগর আকিনফিভ যুগ!’ উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলায় অনেক আগেই এদের (ইয়াসিন ৭৮ ম্যাচ, দাসায়েভ ৯১ ম্যাচ) টপকে গেছেন ২০০৪ সাল থেকে জাতীয় দলে খেলা ইগর (১১০ ম্যাচ)। পরের ম্যাচে রাশিয়া যদি ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে সেমিফাইনালে যেতে পারে তাহলে সাবেক রুশ কিংবদন্তি গোলরক্ষক রেভ ইয়াসিনের সমকক্ষতা অর্জন করবেন ইগর। কেননা, ১৯৬৬ বিশ্বকাপের সেমিতে খেলেছিলেন ইয়াসিন। এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপে স্বাগতিক রাশিয়া ছিল মাঝারি মানের দল। অনেকের মতে, স্বাগতিক বলে বেঁচে গেছে ‘দ্য ন্যাশনাল টিম’ খ্যাত রাশিয়া। এজন্য তাদের বাছাইপর্ব খেলতে হয়নি। যদি খেলতে হতো, তাহলে মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারত কি না সন্দেহ! যে রাশিয়া কি না এর আগে তিনবার (১৯৯৪, ২০০২ এবং ২০১৪) গ্রুপ পর্ব খেলেই বিদায় নিয়েছিল অথচ সেই রাশিয়া কি না এবার পৌঁছে গেছে শেষ আটে, অর্থাৎ কোয়ার্টার ফাইনালে! সত্যিই অবিশ্বাস্য খেলে রূপকথার জন্ম দিল দলটি। অথচ কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফিফা র‌্যাঙ্কিং তাদেরই, ৭০! রাশিয়ার ফুটবল ইতিহাস মূলত দুই পর্বে বিভক্ত। প্রথম ভাগ ১৯২২-১৯৯১ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্ব ১৯৯১-২০১৮+ পর্যন্ত। প্রথম পর্বে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন যুগ। এই নামে দলটি খেলেছে ৭টি বিশ্বকাপ (১৯৫৮, ৬২, ৬৬, ৭০, ৮২, ৮৬ এবং ৯০)। সেরা সাফল্য ১৯৬৬ আসরে সেমিফাইনাল খেলা এবং চতুর্থ স্থান অর্জন করা। সোভিয়েত-ফুটবলের স্বর্ণসময় ছিল ১৯৫৮-৭০ পর্যন্ত। এ সময় তারা প্রতিটি বিশ্বকাপেই কমপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত খেলে। এছাড়া তারা ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জেতে ১৯৬০ সালে। রানার্সআপ হয় তিনবার (১৯৬৪, ৭২ এবং ৮৮)। অলিম্পিক ফুটবলেও সফল তারা। স্বর্ণ জেতে ১৯৫৬ আসরে। এছাড়া দু’বার জেতে তাম্রপদক (১৯৭২ ও ১৯৭৬ আসরে)। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে ১৫ টুকরো হয়ে যায়। জন্ম নেয় ভিন্ন ভিন্ন স্বাধীন দেশ। এই দেশগুলোরই একটি হচ্ছে রাশিয়া (বাকি ১৪ দেশ হচ্ছে : আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, এস্তোনিয়া, জর্জিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মলদোভা, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইউক্রেন এবং উজবেকিস্তান)। নতুন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর ফুটবল-শক্তি কিছুটা হ্রাস পেলেও ১৯৯৪ ফিফা বিশ্বকাপে ঠিকই অংশ নেয়ার যোগ্যতা অর্জন করে রাশিয়া। তবে সেবার তারা বাদ পড়ে গ্রুপ পর্ব থেকেই। ১৯৯৮ আসরে বাছাইপর্ব খেলে বাদ পড়ে। ২০০২ আসরে আবারও মূলপর্বে খেলে সেবারও বিদায় নেয় গ্রুপ পর্ব থেকেই। এরপর ২০০২ ও ২০১০ আসরে আবারও ছন্দপতনÑ খেলতে পারেনি মূলপর্বে। ২০১৪ আসরে আবারও ভাগ্য সুপ্রসন্ন। তবে এবারও যথারীতি বিদায় গ্রুপ স্টেজ থেকেই। তার মানে ‘রাশিয়া’ নামে খেলা শুরুর পর থেকে যে তিনবার মূলপর্বে তারা খেলেছে, প্রতিবারই বিদায় নিয়েছে গ্রুপ পর্ব থেকেই। এবার অবশ্য ধারণা করা হচ্ছিল স্বাগতিক হওয়ার সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে অন্তত নকআউট পর্ব, অর্থাৎ দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত খেলবে দেশটি। দেশটির ফুটবল অনুরাগীদেরও তেমনটাই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে ২০১০ আসরের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে টাইব্রেকারে হারিয়ে দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে সবাইকে চমকে দেবার পাশাপাশি ইতিহাসও গড়ে রাশান দল। আগামী ৭ জুলাই কোয়ার্টারে তাদের প্রতিপক্ষ ১৯৯৮ আসরের তৃতীয় স্থান অধিকারী ক্রোয়েশিয়া। সেই ম্যাচেও কি ‘ঈশ্বরের পা’ ব্যবহার করে আবারও দলকে জিতিয়ে এবং প্রথমবারের মতো ঐতিহাসিক সেমিফাইনালে ওঠাতে পারবেন আকিনফিভ?
×