ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বাজার অস্থির

চাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার না করে কমানো হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২৪ জুন ২০১৮

চাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার না করে কমানো হচ্ছে

এম শাহজাহান ॥ চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার না করে কিছুটা কমানো হচ্ছে। প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট পাসের সময় চাল আমদানিতে শুল্ক কমানোর বিষয়ে ঘোষণা দিতে পারেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। চলতি মাসের ৭ জুন বাজেট ঘোষণার পর সব ধরনের মোটা চালের দাম কেজিতে ২-৩ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা আমদানিকৃত মোটা চালের মজুদ বাড়াতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে ধানের দাম। এই বাস্তবতায়, চাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা কিছুটা কমিয়ে বহাল রাখা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে পূর্বের মতো ২৮ শতাংশ শুল্ক পুনর্বহালের ঘোষণার পরপর সরবরাহ পর্যায়ে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বড় ব্যবসায়ীরা। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটচক্র পরিকল্পিতভাবে সরবরাহ চেইনে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে কেজিতে ২-৩ টাকা বেশি দাম নিচ্ছেন। খুচরা পর্যায়ে স্বর্ণা ও ইরি জাতের মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৪-৪৫ টাকায়। শুধু তাই নয়, ভালমানের মোটা চাল কোন কোন দোকানদার প্রতি কেজির দাম রাখছেন ৫০ টাকা পর্যন্ত। ঈদের ছুটি শেষে অনেকে চাল কিনতে গিয়ে বাড়তি দাম দিচ্ছেন। চাল ব্যবসায়ীদের মতে, আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা পুনর্বহাল না হলে মোটাসহ সরু চালের দামও বাড়বে। ২৮ শতাংশ শুল্কারোপের ফলে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানি প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমন্বয় রাখতে ব্যবসায়ীরা সারাবছর প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে নিয়মিত চাল আমদানি করে থাকেন। তবে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা চালের দাম বৃদ্ধির হুজুগে দেশে উৎপাদিত চালের দামও বাড়ছে প্রায় একই হারে। এর প্রভাব পড়েছে সারাদেশে চালের পাইকারি বাজারে। খুচরা বাজারে দামের উত্তাপ আরও বেশি। এদিকে, গত ৭ জুন ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের সময় চাল আমদানির ওপর ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী। ওই সময় তিনি বলেন, কৃষকের উৎপাদিত ধান চালের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে চাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করে সর্বোচ্চ আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ এবং রেগুলেটরি ডিউটি ৩ শতাংশ পুনঃআরোপ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত গম, ভুট্টা, আলু ও কাসাভা থেকে উৎপাদিত স্টার্চের শুল্ককর যৌক্তিকীকরণ করে আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ এবং রেগুলেটরি ডিউটি ১০ শতাংশ হারে নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। মূলত অর্থমন্ত্রীর এই ঘোষণার পরই চালের বাজারে অস্বস্তি বিরাজ করছে। রমজান ও ঈদ সামনে রেখে বাজেট ঘোষণার পর একটু একটু করে চালের দাম বাড়ে। তবে ঈদের ছুটির পর ঢাকা ফিরে যারা চাল কিনতে বাজারে যাচ্ছেন, তাদের বাড়তি দাম দিতে হচ্ছে। শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ঢাকার বাদামতলী বাজারে নাজিরশাইলের বস্তা ২৭৫০-২৯০০ টাকা, মিনিকেট ২৬০০-২৭৫০ টাকা, বিআর-২৮ চাল ২১০০-২১৫০ টাকা এবং বিআর-২৯ হাসকি (অর্ধসিদ্ধ বিআর-২৮ চাল) ২০০০-২১০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। তবে পুরান ঢাকার কাপ্তান বাজারে ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা নাজিরশাইল ২৮০০-৩০০০ টাকা, মিনিকেট ২৭০০-২৮০০ টাকা এবং বিআর-২৮ চাল ২১০০-২২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, শনিবার ঢাকায় উন্নতমানের নাজিরশাইল ও মিনিকেট চাল ৬০-৬৬ টাকা, পাইজাম ও লতা ৪৮-৫৪ টাকা এবং স্বর্ণা ও চায়না ইরি ৩৮-৪২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। কাপ্তান বাজারের নূরু রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী নূরু মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, বাদামতলীর পাইকারি বাজারে চালের দাম বেশি। আর এ কারণে খুচরা বাজারেও চালের দাম বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি বাড়ছে আমদানিকৃত চালের দাম। বাজেটে সরকার নতুন করে কর বাড়ানোর ফলে চালের দাম বাড়ছে বলে জানান তিনি। প্রসঙ্গত, গত বছর এপ্রিলের শুরুতে আগাম বৃষ্টি ও বন্যার কারণে ফসলহানি ও মজুদ তলানিতে নেমে আসায় চাল আমদানিতে শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছিল। এর ফলে শুল্ক সুবিধার আওতায় সরকারী-বেসরকারী খাতে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি হয়েছে। কিন্তু সেই চাল বেশি দামে বিক্রি করতে এখন অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজির আশ্রয় নিচ্ছেন বলে বাজারে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে ক্রেতাদেরও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তারা বলছে, শুল্ক সুবিধার আওতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ চাল আনা হয়েছে। সেই চাল গেল কোথায়? বাজেট ঘোষণার পর কেজিতে ২-৩ টাকা বেড়ে গেছে দাম। কাপ্তান বাজারের জামশেদ স্টোরের কর্মকর্তা কাঞ্চন মিয়া চালের দাম বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করে জনকণ্ঠকে বলেন, চালের দাম বেড়ে গেছে। সামনের দিকে দাম আরও বাড়বে। তিনি বলেন, বাজেট পাসের আগে এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া উচিত। তা না হলে ভোক্তাদের বেশি দাম দিয়ে চাল কিনতে হবে। এদিকে, ধানের দাম বাড়ার কারণে মোটা চালের পাশাপাশি ভাল মানের সরু চালের দাম বাড়তে পারে বলে আভাস দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ অটো মেজর এ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী জানান, কৃষকদের দিক বিবেচনায় নিয়ে সরকার আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করেছেন। সরকার চায় কৃষক ধানের দাম পাক, কৃষক দাম পেলে চালের দাম তো বেশি হতেই পারে। নতুন করে শুল্ক আরোপের পর আর চাল আমদানি হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, এই সময়ে ধানের দাম মণ প্রতি ১০০-১৫০ টাকা বেড়ে গেছে। আর এ কারণে বাড়ছে চালের দাম। এদিকে, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চালের বাজার অস্থির করতে সরকার বিরোধী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বড় ধরনের অপতৎপরতা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশে জিনিসপত্রের দাম যখন কমতির দিকে তখন চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠছে। এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে চাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা কিছুটা কমিয়ে পুনর্বহাল করা হবে। অর্থমন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থমন্ত্রী কৃষকদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করেছিলেন। কিন্তু বাজেট পাসের আগেই চালের দাম বেড়ে গেছে এটা চিন্তার বিষয়। তিনি বলেন, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে, রেয়াতি সুবিধা পুরোপুরি প্রত্যাহার না করে কিছুটা কমানো হতে পারে। এতে করে অসাধু ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা বন্ধ হবে। এদিকে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এ বছর সব কটি ধানের মৌসুমে দেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি লাখ টন ধান উৎপাদিত হবে। এরই মধ্যে ৬৫ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। এছাড়া খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, সরকারের খাদ্য গুদামে এখন ১০ লাখ টনের বেশি চাল মজুদ আছে। স্থানীয় বাজার থেকে আরও কেনা হচ্ছে ৯ লাখ টন চাল ও ১ লাখ টন ধান। অন্যদিকে গত এক বছরে সব মিলিয়ে ৮০ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯ লাখ টন দেশে বাজারজাত পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুন পর্যন্ত সময়ে আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৪৬ দশমিক ৪৩ লাখ টনের। এসব চাল শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং ব্যাংক ঋণের সুবিধা নিয়ে আমদানি করা হয়েছে। এই অবস্থায় চালের দাম বাড়ার কোন যৌক্তিকতা নেই।
×