ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিথুন আশরাফ

নরেন্দ্র মোদির কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা’

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ১৬ এপ্রিল ২০১৮

নরেন্দ্র মোদির কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা’

‘কেমন আছ, আমার সোনার বাংলা।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি যখন শুরুতেই কথাগুলো বললেন, মনটা জুড়িয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রতিনিধি হয়ে ভারত সফর করা এক শ’ তরুণের কণ্ঠে বেজে উঠল জাতীয় সঙ্গীতের সুর, ‘আমি তোমায় ভালবাসি।’ প্রধানমন্ত্রী ভবনের যে ঘরে ভারত প্রধানের সাক্ষাত হলো, সেই ঘরটি যেন ভালবাসার প্রতীক হয়ে দাড়াল। তার সঙ্গে কাটানো কিছু সময় যেন চিরদিনের পুঁজিও হয়ে থাকল। অপলক তার দিকে শুধু তাকিয়েই থাকতে মন চাইল। তার কথাগুলো যেন মনকে ছুয়ে গেল। ধন্যবাদ জানাই বাংলাদেশে ভারতীয় হাই কমিশনকে। তাদের মাধ্যমে প্রতি বছর দেশের এক শ’ তরুণ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে ভারত সফরের সুযোগ পেয়ে থাকে। ভারতের ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার সুযোগ পেয়ে থাকে। যেখানে শেখার, জ্ঞান আহরণের, স্বাবলম্বী হওয়ার, নতুন বন্ধু তৈরি করার, আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যত পথ চলার শিক্ষাও হয়। এবার সেই এক শ’ জনের মধ্যে একজন ছিলাম আমি (মিথুন আশরাফ)। দৈনিক জনকণ্ঠের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার (স্পোর্টস)। বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতিকে (বিএসপিএ) ধন্যবাদ না দিলেই নয়। এ সংস্থাটিই আমাকে দেশের প্রতিনিধি হয়ে ভারত ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছে। এ সংস্থাটির যুগ্ম সম্পাদকও আমি। এরপর ইন্টারভিউ থেকে শুরু করে বাংলাদেশে ভারতীয় হাই কমিশনে ফ্ল্যাগশিপ প্রোগ্রামের পর আট দিনের ভারত সফরও হয়ে গেছে। দিল্লী হয়ে আগ্রা, মুম্বাই, পুনে ঘুরে আসার সুযোগও হয়েছে। এক শ’ তরুণের সঙ্গে গভীরভাবে মেশার সুযোগ হয়েছে। অনেক কিছু শেখার, বোঝার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদির দর্শন এখনও চোখে ভাসে। আর তার বলা, ‘আমার সোনার বাংলা’ এখনও আনমনে গুনগুন করতে থাকি। আট দিনের ভারত সফরের প্রতিটি দিনই মনে থাকার মতো। নতুন বন্ধু তৈরি হয়েছে। আনন্দ হয়েছে। সুখী একটি পরিবারের মতো মনে হয়েছে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব বিশেষ পরিচয় আছে। নিজের আঙ্গিনায় প্রত্যেকেই সেরা। প্রত্যেকেই প্রতিভাবান। প্রত্যেকেই নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সবার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়েছেন। এক সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করেছেন। সবার সঙ্গে মিশে জ্ঞান নেয়ার চেষ্টা করেছেন। কয়েকজন ছাড়া বাকিদের সঙ্গে পূর্বের কোন পরিচয় ছিল না। একেক জন একেক স্থানের, একেক পেশার। এ সফরে ছিলেন দেশের গণমাধ্যমকর্মী, চিকিৎসক, আইনজীবী, খেলোয়াড়, আম্পায়ার, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, আর্টিস্ট, চিত্রশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, ব্যবসায়ী, বেসরকারী চাকরিজীবী, সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব। সবাই যেন একটি ‘পরিবার’ হয়ে ওঠে। একটি ‘বাংলাদেশ’ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের প্রতীক হয়ে ওঠে। প্রতিটি দিনই খুব সূচী মেনে চলতে হয়েছে। দিল্লী, আগ্রা, পুনে, মুম্বাইয়ের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে ঘুরতে গিয়ে কখনো সূচীর এদিক-ওদিক হয়েছে। তবে যে সূচী ছিল, তার বেশিরভাগই ঘুরে দেখা গেছে। আর সব সময়ই এই এক শ’ তরুণের সঙ্গে অভিভাবক হয়ে ছিলেন বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাসের প্রথম রাজনৈতিক সচিব রাজেশ উইকা এবং সফরের সমন্বয়ক ভারতীয় হাই কমিশনের মিডিয়া ও কালচার কো-অর্ডিনেটর কল্যাণ কান্তি দাশ। সঙ্গে ছিলেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ‘রশিকতার ভান্ডার’ মাদান মোহান এবং সদা হাস্বোজ্বল পুনাম জি। চব্বিশে মার্চ শুরু হয় ভারত ভ্রমণ। ঢাকা থেকে দিল্লী গিয়ে শুরুতে ইন্দিরা গান্ধী সেন্টার ফর আর্টসের (আইজিএনসিএ) সৌন্দর্য্য উপভোগ করা হয়। এখানে ভারতের সংস্কৃতি ধরে রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। এরপর ইন্ডিয়া গেট ঘোরা হয়। এখানে ১৯১৫-২১ সালে যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়, সেই সময় ৭০ হাজার ভারতীয় আর্মি মারা যান। তাদের স্মৃতি ধরে রাখা হয়েছে। ‘ইন্ডিয়া গেট’ ঘোরা শেষে হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম নেয়া হয়। পরের দিন তাজমহল ও আগ্রা ফোর্ট ঘুরে দেখা হয়। ভালবাসার নিদর্শন মেনে নেয়া হয় আগ্রার তাজমহলকে। স¤্রাট সাহাবুদ্দিন মুহাম্মদ শাহজাহান ১৬৩১ সালে দ্বিতীয় সহধর্মিণী আর্জুমান্দ বানু বেগম মমতাজের প্রতি তার ভালবাসা বোঝাতে তাজমহল তৈরি করেন। তাজমহলের ভেতরেই মমতাজের কবর রয়েছে। তার পাশেই শাহজাহানকে কবর দেয়া হয়। এ তাজমহল সপ্তম আশ্চর্য্যে স্থান করে আছে। তাজমহলের সৌন্দর্য উপভোগ করার পর আগ্রা ফোর্টে যাই। মুঘল রাজবংশের প্রতীক এ দুর্গ থেকে তাজমহলও দেখা যায়। এ দুর্গেই আওরঙ্গজেব তার বাবা শাহজাহানকে মার্বেলের ঘরে বন্দী করে রেখেছিলেন। এ ঘর থেকেই তাজমহল দেখে মুগ্ধ হতেন শাহজাহান। যা সত্যিই চোখকে জুড়িয়ে দেয়। শেষে মৌসাম্মান বুর্জ নামে ঘরটিতেই মৃত্যুবরণ করেন শাহজাহান। তাজমহল ও আগ্রা ফোর্ট ঘুুরে আবার হোটেলে ফেরা হয়। চোখের পলকে যেন দিনটি শেষ হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ। এই দিনটি শুরুই হয় কেক কেটে। এক শ’ তরুণ কেক কাটার সময় উপস্থিত থাকেন। ভারতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে যাওয়া ১০০ তরুণের স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়। সবার কণ্ঠে বেজে ওঠে জাতীয় সঙ্গীত, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’ দিনের শুরুতেই স্বাধীনতা দিবস পালনের পর প্রধানমন্ত্রী কৌশল কেন্দ্রে এক শ’ তরুণকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিভাবে দেশের তরুণদের, উচ্চ শিক্ষিত না হয়েও তরুণরা স্কিলে উন্নতি করতে পারে, পরবর্তীতে নিজের যোগ্যতায় জীবন কাটাতে পারে, এখানে তাই দেখানো হয়। যা খুবই অনুপ্রাণিত উদ্যোগ। প্রধানমন্ত্রী কৌশল কেন্দ্র ঘুরে লেডি শ্রীলাম কলেজ ফর উইমেনে গিয়ে জানা যায় দিল্লীর মহিলা কলেজ এটি। যেটি কিনা আর্টস এন্ড এডুকেশনের দিক দিয়ে এক নম্বর, কমার্সের দিক দিয়ে ২ নম্বর এবং গণযোগাযোগ শিক্ষায় ভারতের তিন নম্বর স্থান দখল করে আছে। ১৯৫৬ সালে লালা শ্রী রামের তৈরি করা এ কলেজটি ২০১৪ সালে সেরা আর্টস কলেজে ভূষিত হয়। যেটি এখন লালা শ্রী রামের স্ত্রী ফুলন দেবীর তত্ত্বাবধানে আছে। তাকে ‘লেডি শ্রীরাম’ও বলা হয়। এই কলেজ ঘুরে দিল্লী হাট হয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপস্থিত হন সবাই। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সান্নিধ্য মেলে। সুষমা স্বরাজের সঙ্গে থাকেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. এ. কে. দুবে। সুষমা বক্তব্য রাখেন। মন মুগ্ধকর বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণরা এই সফরের মাধ্যমে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করছে। আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ সুষমা স্বরাজের বক্তব্য শেষে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারক উপহার দেন চিত্রশিল্পী বিপুল মল্লিক। সুষমা স্বরাজের প্রোগ্রাম শেষে যুব মন্ত্রণালয়ের দেয়া কালচারাল প্রোগ্রামে অংশ নেন ১০০ তরুণ। সেখানে সন্ধ্যা হয়ে রাতে আনন্দঘন মুহূূর্তের তৈরি হয়। সবাই নেচে, গেয়ে স্মৃতিমধুর সময় কাটান। দুর্দান্ত সময় উপভোগ করেন। স্মৃতিতে যা গেথে থাকে। পুরো সফরে এ সময়গুলোই যেন সবচেয়ে আনন্দময় কেটেছে। সবাই মিলে একটা সময় নাচতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্য বিভাগের অধ্যাপক মনিরা পারভিন ও শাস্ত্রীয় নৃত্যের ফর্ম ভরতনাট্যম নিয়ে ধ্যানজ্ঞানে থাকা অর্থী আহমেদ নেচে মঞ্চ মাতান। বাংলাদেশ আদিবাসী কালচারাল ফোরামে কর্মরত মং মারমা সাচিংও নৃত্য পরিবেশন করেন। শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কান্তা রেজা গান গেয়ে সবাইকে যেন পাগল করে তুলেন। পরের দিন ২৭ মার্চ গুরুত্বপুর্ন দিনের যেন দেখা মেলে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাত মেলে। যে সাক্ষাতের জন্যই অধীর আগ্রহে ছিলেন প্রত্যেক তরুণ। ২০১২ সাল থেকে প্রতিবছর এক শ’ তরুণকে ভারত সফর করার সুযোগ তৈরি করে দেয় ভারতীয় হাই কমিশন। এ আয়োজন সফল করে ভারতের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। সার্বক্ষণিক এক শ’ তরুণের দেখভাল তাদের তত্ত্বাবধানেই থাকে। এবার নিয়ে ষষ্ঠবারের মতো এ আয়োজন হল। কিন্তু প্রথমবারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক শ’ তরুণ দেখা করতে পারল। এর আগে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা হতো। এবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলো। এমন এক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলো, যিনি কিনা ভারত স্বাধীন হওয়ার পর জন্ম নেয়া প্রথম ব্যক্তি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেছেন। এর আগে যারাই এ আসনে বসেছেন, সবাই ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে জন্ম নিয়েছিলেন। তার ভেতর যে আধুনিক যুগের ছোয়া কী পরিমাণ আছে, তা তো কাজকর্মে পরিষ্কার। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যন্ত সক্রিয়। ফেসবুক, টুইটার, গুগল+, ইন্সটাগ্রাম, সাউন্ড-ক্লাউড, লিঙ্কড-ইন, ওয়েবিও এবং আরও কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি সক্রিয়। যখন এক শ’ তরুণ তার সঙ্গে ফটোসেশন করে, কিছুক্ষণ পরই ভারত প্রধান মোদির অফিসিয়াল টুইটার পেজে ছবিসহ পোস্টও দেখা যায়। ফটোসেশন শেষে ১০ মিনিট তরুণদের সঙ্গে কথাও বলেন মোদি। সে এক অসাধারণ সময়। মুহূর্তেই কেটে গেল সময়। তার কথাই শুধু শুনতে মন চাইলো। বাংলাদেশের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালবাসাই কথাবার্তায় ফুটে উঠল। মোদি জানতে চান, এক শ’ তরুণ কোথায় ঘুরেছে। কোথায় ঘুরতে যাবে। দিল্লী হয়ে মুম্বাইয়ে যাওয়া হবে। এ কথা শুনতেই বলেন, ‘বলিউড কা শাহার হ্যা (বলিউডের শহর)’। মোদি জিজ্ঞেস করেন, ‘দিল্লী ক্যায়সা লাগ রাহাহে (কেমন উপভোগ করছ)।’ সবাই সমস্বরে বলে ওঠেন, ‘বহত আচ্ছা লাগ রাহাতে হ্যায় (অনেক দারুণ লাগছে)।’ এরপর দিল্লী, কলকাতা সফরের অভিজ্ঞতা এর আগে আছে কিনা জানতে চান। যাদের অভিজ্ঞতা আছে, তারা হাত উপরে তোলেন। কিন্তু এবার কলকাতা যাওয়া হচ্ছে না শুনে মোদি বলেন, ‘বাংলাদেশ-কলকাতা সেম হে (একই)।’ মোদি এরপর বিদায় নেন। তরুণরা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তার নেতৃত্ব, আন্তরিকতা দেখে সবাই মুগ্ধ। যেন জাদু! জীবনের সেরা মুহূর্তও যেন মিলে গেল। প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের পর যাওয়া হয় প্রবাসী ভারতীয় কেন্দ্রে। এই পর্ব শেষেই দিনটি শেষ হয়। পরের দিন শুরুতেই গান্ধীজী মেমোরিয়ালে গিয়ে শুরুতে সমাধির সামনে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর গান্ধীজি মিউজিয়ামে গিয়ে ইতিহাস সম্পর্কে জানা হয়। এরপর হুমায়ুনের সমাধিসৌধে গিয়ে সৌন্দর্য অবলোকন করা হয়। হুমায়ুনের পত্মী হামিদা বানু বেগম এই সমাধি ১৫৬২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেন। যা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম উদ্যান-সমাধিক্ষেত্র। লাল বেলে পাথরের এত বড় মাপের স্থাপনাগুলোর মধ্যে হুমায়ুনের সমাধিসৌধই ভারতে প্রথম। দিল্লীতে গিয়ে কুতুব মিনার না দেখলে কী আর হয়? বিশ্বের সর্বোচ্চ পোড়ামাটির নির্মিত মিনার না দেখলে হয়? তাই দেখা হল। এ মিনারটি প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়। নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে। তবে মিনারের উপরের তলাগুলোর কাজ সম্পূর্ণ করেন ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৮৬ খ্রিস্টাব্দে। এটি দিল্লীর অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। কুতুব মিনার দেখা শেষে দিল্লী ভ্রমণ পর্ব শেষ হয়। এরপর মুম্বাইয়ের বিমানে চড়া হয়। বিকেলে বিমানে চড়ে রাতে নেমে অসাধারণ সম্মান পাওয়া হলো। মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন ফুল দিয়ে এক শ’ তরুণকে গ্রহণ করে নিলেন। এরপর হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম। ষষ্ঠ দিন শুরুতেই নাভি মুম্বাই মিউনিসিপিলিটি ভিজিট করার মধ্য দিয়ে মুম্বাই পর্বের শুরু হয়। যেটাকে নতুন মুম্বাই আখ্যা দেয়া হয়। সেখানে মেয়রের সঙ্গেও সাক্ষাত হয়। তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে জানা হয়। নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও শহরের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে মহারাষ্ট্রের মুম্বাইকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি মুম্বাই। আরেকটি নাভি মুম্বাই। এই নাভি মুম্বাই খারগড় থেকে উরান পর্যন্ত অবস্থিত। এর মেয়র শ্রী জাওয়ান্ত সুতার। যার কিনা বাংলাদেশে আসার অনেক শখ। নগর পরিকল্পনার সার্বিক দিকগুলো দেখানোর পর জাওয়ান্ত সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশে যাওয়ার নিমন্ত্রন এর আগে কয়েকবার পেয়েছি। কিন্তু কখনোই যেতে পারিনি। আমার সবকিছু নাভি মুম্বাইকে ঘিরে। স্বপ্নের শহর হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। সেই লক্ষ্য পূরণে ‘ক্লিন নাভি মুম্বাই, হেলথ নাভি মুম্বাই’ এই স্লোগান নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এক সময় ভারতের পরিচ্ছন্ন এবং নাগরিক সুবিধাসম্পন্ন এক নম্বর শহর হবে এটা। এই শহরে বাংলাদেশ থেকে আগত এক শ’ তরুণ অতিথিকে অভিনন্দন। সুযোগ পেলে এবার চেষ্টা করবো বাংলাদেশ ঘুরে আসার। বাংলাদেশ দেখার ইচ্ছা আমার বহুদিনের।’ এ পর্ব শেষে মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্কিমের যৌথ আয়োজনে ‘কনভারসেশন উইথ ডাইভারসিটি’ নামের ইন্টারএকটিভ সেশন ও কালচার এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে অংশ নেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কড়া রোদের মধ্যেও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নিজস্ব পোশাক ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাংলাদেশের এক শ’ তরুণকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। হাতে লেখা কার্ড ও ফুল দিয়ে উপহার দেয় তারা। পাশাপাশি অসাধারণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে। মারাঠী ভাষাভাষী হয়েও অসাধারণ বাংলা গান গেয়েছে ঐ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। সেই সঙ্গে এক শ’ তরুণের পক্ষে বাংলাদেশেরও একটি দল গানে অংশ্রগহণ করে থাকে। তবে নৃত্যশিল্পী রনবীর সাহা প্রোগ্রামের পুরো আলোই নিজের দিকে টেনে নেন। একই দিন রাতে যাওয়া হয় গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া। মুম্বাইয়ের তাজমহল বলা হয় এ স্থাপনাকে। যেটি ১৯১১ সালে নির্মাণ শুরু, শেষ হয় ১৯২৪ সালে। এই স্থাপত্যটি প্রথমে জেলে সম্প্রদায়ের স্থানীয় জেটি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে এটিকে সংস্কার করা হয়। ব্রিটিশ সরকার ও অন্যান্য প্রখ্যাত ব্যাক্তিদের অবতরণস্থান হিসেবে ব্যবহার করা হতো। প্রথম দিকে, কেউ মুম্বাই নৌকায় করে এলে এই স্থাপত্যটি প্রথমে দেখতে পেত। পর্যটকদের জন্য এটি অন্যতম একটি আকর্ষণ। নয়াদিল্লীর ইন্ডিয়া গেট দেখতে এই স্থাপত্যের মতোই। একবিংশ শতকের শুরু থেকে এই স্থাপত্যে তিনটি সন্ত্রাসী হামলা হয়। ২০০৩ সালে দুটি এবং ২০০৮ সালে চার জন বন্দুকধারী তাজমহল প্যালেস হোটেল আক্রমণ করে। এখন আর এ স্থাপনাটি আগের মতো উন্মুক্ত নয়। জনসাধারণ ঠিকই এখানে ঘুরতে যান। পর্যটকরা এর সৌন্দর্য উপভোগ করেন। কিন্তু আরব সাগর দিয়ে গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া হয়ে এখন আর কেউ শহরে ঢুকতে পারেন না। মুম্বাইয়ে গিয়ে মেরিন ড্রাইভে একটু সময় না কাটালেই নয়। আরব সাগরের হিম বাতাসের ছোয়া মেলে। মুম্বাই শহরের উচু দালান কোঠার দেখা মেলে। মেরিন ড্রাইভ (বিচ) থেকে শহরের সৌন্দর্য দুই চোখ জুড়িয়ে দেয়ার মতো। মেরিন ড্রাইভ দেখার পর শেষ হয় দিনটি। সপ্তম দিন, ৩০ মার্চ যাওয়া হয় পুনেতে। সেখানে শুরুতেই ঘুরে দেখা মাহিন্দ্র কোম্পানি। সেখানে গিয়ে জানা যায় বাংলাদেশের কৃষি, ব্যবসা এবং পরিবহনখাতে মাহিন্দ্র কোম্পানির গাড়ির চাহিদা বেড়েই চলেছে। তা মেটাচ্ছে দেশের র‌্যাংগস গ্রুপ, কর্ণফুলী গ্রুপের মাধ্যমে। ২৫ বছর ধরে চলছে তা। প্রতি তিন মিনিটে একটি প্রাইভেট কার প্রস্তুত হয়। আর সাড়ে ছয় মিনিটে একটি ট্রাক তৈরি হয়। প্রতি ঘন্টায় সব মিলিয়ে ২০টি গাড়ি তৈরি হয়। পুরো প্রক্রিয়া দেখার পর যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। মহারাষ্ট্রের পুনের চাকানে মাহিন্দ্র ভেহিকল ম্যানুফ্যাকচারার্স লিমিটেড সাত শ’ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে। মাহিন্দ্র কোম্পানি ঘুরে দেখার পর যাওয়া হয় ইনফোসিস। ইনফোসিস লিমিটেড একটি গ্লোবাল কনসালটিং, তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি। এটি ভারতের বৃহত্তম আইটি কোম্পানি। যাদের ৭০টি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার সারা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে। যারা ভারত তথা আধুনিক বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতায় সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় কাজ করে যাচ্ছে। ব্যাঙ্গালুরুতে এর হেড অফিস। এটি ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানে ২ লাখ কর্মী কাজ করে। বিশ্বের অন্যতম সফটওয়্যার কোম্পানি এটি। অসাধারণ ক্যাম্পাস। আছে সুবিশাল মাঠ, অডিটরিয়াম। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস নয় এটি। কোম্পানিতে কর্মরত কর্মকর্তাদের সুযোগ সুবিধা দেয়ার জন্যই এমন ব্যবস্থা। আবাসনসহ সকল ব্যবস্থা এ ক্যাম্পাসে রয়েছে। ইনফোসিসের মতো কোম্পানিতে বাংলাদেশীদের কাজের সুযোগ রয়েছে। এর আগেও অনেকে সেই সুযোগ গ্রহণ করেছে। ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি আছে। আছে ক্রিকেটারদের ব্যাটিং, বোলিং করার বিভিন্ন ভঙ্গির খোদাই করা রূপ। ইনফোসিস ঘোরা শেষে সপ্তম দিনের শেষ। আরেকটি দিনের অপেক্ষা। যেন দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে সময়। মুম্বাই ও ভারত ভ্রমণের শেষ দিনে শুরুতেই জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারী গিয়ে ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো দেখা। এরপর ছাত্রপতি শিবাজী জাদুঘর ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা হয়। সেখান থেকে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে গিয়ে ক্রিকেট মাঠের সান্নিধ্য নেয়া হয়। এরপর দাদা সাহেব ফালকে চিত্রানগরি ঘুরে হোটেলে ফেরা। সেই সঙ্গে শেষ ভারত ভ্রমণ। পুরো সফরটি আয়োজন করে ভারতের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। সব সময় প্রতিনিধিদের সঙ্গে ছিলেন মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা কর্মী। সেই সঙ্গে সার্বক্ষনিক রাখা হয় তিনটি বাস। এক শ’ প্রতিভাবান তরুণ দেশের প্রতিনিধি হয়ে ভারত সফরে যান। ব্যবসায়ী মোঃ আশরাফউদ্দিন সব সময় প্রতিনিধিদের মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। আটদিন দিল্লী, আগ্রা, পুনে ও মুম্বাই মিলে কাটানো হয়। এক শ’ তরুণের (একজন শেষ পর্যন্ত যাননি) সঙ্গে থেকে অনেক কিছু শেখা হয়েছে। জ্ঞান আহরণের সুযোগ মিলেছে। নিজেকে আগের চেয়েও স্বাবলম্বী মনে হচ্ছে। নতুন অনেক বন্ধু তৈরি হয়েছে। আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যত পথ চলার ক্ষেত্রে এ সফর সারা জীবনের পুঁজি হয়ে থাকবে। তবে চতুর্থদিন যে ভারত প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাত হয়, তাকে একেবারে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়, তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়, তার কথা শোনার সুযোগ হয়, সেটিই যেন মনে গেঁথে আছে। তিনি যে বললেন, ‘কেমন আছ, আমার সোনার বাংলা’। সেটিই যেন বারবার কানে বাজে। মোদিকে দেখা এবং তার কণ্ঠে শোনা ‘আমার সোনার বাংলা’ যেন এ সফরের সবচেয়ে বড় পাওয়া হয়ে থাকল। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×