ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ক্যাপ্টেন মোঃ হাবিবুর রহমান

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সামাদ

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২ এপ্রিল ২০১৮

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সামাদ

আজ ২ এপ্রিল, আমার পিতা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সামাদের মৃত্যুদিবস। তিনি প্রিয় মাতৃভূমিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করার দৃপ্ত শপথে ১৯৭১ সালের এই দিনে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আজ গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যাঁর সঠিক নির্দেশনা ও সফল নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রামের বিনিময়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে সল্ডিয় অংশ নিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিতে আমার বাবার বিরোচিত আত্মদানের মাধ্যমে শহীদ হওয়ার গৌরবের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আমার বিধবা মা ইয়ারজান বিবিকে বঙ্গবন্ধুর সমবেদনা জ্ঞাপনসহ ও আর্থিক অনুদান প্রদান করে আমাদের পরিবারকে চিরকৃজ্ঞতার বাঁধনে আবদ্ধ ও গৌরবান্বিত করেছে। বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত আমার পিতার শহীদি স্বীকৃতি ও সমবেদনাপত্র আমি এবং আমার মাসহ আমাদের পরিবারের এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে আমরা বিশ্বাস করি। মহামূল্যবান সেই প্রাপ্তিটুকু ১৯৭২ সাল থেকে অদ্যাবধি সযতেœ লালন করে চলেছি এবং সেই প্রাপ্তির বদৌলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু’বার আমার সরকারী চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে শহীদ পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও আমার পরিবার চিরকৃতজ্ঞ। বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে জাতীয়, আন্তর্জাতিক বহু স্বীকৃতি ও পদক পেয়েছেন, যার মধ্যে সর্বশেষ হচ্ছে ‘মেডেল অব ডিশটিংশন’। আমার বাবা শহীদ আবদুস সামাদ ২ এপ্রিল ১৯৭১ পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। ২৭ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন লোকালয়ে ঢুকে পড়ে এবং তখন আমার পিতা নিজ উদ্যোগেই শহরের ঝাউতলা, সেগুনবাগান, সরদারনগর ও টিকেট প্রিন্টিং প্রেস এলাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে তার নেতৃত্বেই শুরু হয় অসম যুদ্ধ। ৭ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর চট্টগ্রামের রেলওয়ে এলাকায় বসবাসরত বাঙালী ও অবাঙালী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে এক যুদ্ধংদেহী মনোভাব সৃষ্টি হতে থাকে। আমাদের পরিবারের অজান্তেই আমার বাবা পাক হানাদারদের প্রতিহত করতে সংগঠিত হচ্ছিলেন এবং তার বহির্প্রকাশ ঘটে ২৬ মার্চ ১৯৭১ বিশাল এক লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে উনি প্রতিহত করলেন সেগুনবাগান কলোনি থেকে আসা অবাঙালী গু-াদের। ঠিক তেমনিভাবে রেলওয়ে কলোনিতে অবস্থানরত অবাঙালীদেরও সুরক্ষা দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ঊষালগ্নে তার নেতৃত্বাধীন সেই যুুদ্ধে আমিও অংশ নিই এবং দেশকে শত্রুমুক্ত করার দীপ্ত শপথে বলীয়ান হয়ে উঠি। ২ এপ্রিল কিছু অবাঙালী বিশ্বাসঘাতকদের সহায়তায় পাক সেনাদের হাতে আমার বাবা শহীদ হন। বাবার অস্থির গতিবিধি উনাকে ইঙ্গিত দিয়েছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এবং শেষ মুহূর্তে উনি আমাদের পরিবারের সব সদস্যদের তুলে দিয়েছিলেন উনার এক সহকর্মীর (অবাঙালী) হাতে। আমরা বেঁচে গেলাম বাবার আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে। তারপরের ঘটনা অনেক লম্বা। দীর্ঘ ৫ দিন হেঁটে, ট্রেনে, রিক্সায় ও লঞ্চে করে শরীয়তপুরের গ্রামের বাড়িতে যাওয়া। পরবর্তীতে নিজে নারায়ণগঞ্জ সেক্টরে ছোটখাটো অপারেশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করলাম। চট্টগ্রামে ফিরলাম ৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর। পেলাম না বাবার লাশের কোন হদিস। বাবার সেই সহকর্মী বললেন উনার লাশ ট্রাকে করে নিয়ে গেছে পাক আর্মিরা। আমি ও আমার পরিবার অত্যন্ত সৌভাগ্যবান এ জন্য যেÑ ১৯৭২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আমরা বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে গিয়েছিলাম। শুধু সান্নিধ্যে নয় বঙ্গবন্ধু আমাকে ও মাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সেই দুর্লভ মুহূর্তের সাক্ষী ছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। সেদিনের ২০ মিনিটের দুর্লভ মুহূর্তের কিছু স্মৃতি এখনও আমার হৃদয়ে অম্লান। রমনা পার্কের উল্টোদিকে গণভবনের নিচতলায় আমি আর আমার মা একটি সোফায় বসে আছি। এক কোণে জিল্লুর রহমান সাহেব। বঙ্গবন্ধু দোতলা থেকে নেমে আসলেন। আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। কোন কথা না বাড়িয়ে আমার মাকে ‘মা’ সম্বোধন করে আমাদের দুজনকে দুপাশে জড়িয়ে ধরলেন। আমরা বসলাম। বঙ্গবন্ধু জিল্লুর রহমানকে বললেনÑ সনদপত্র আর দুহাজার টাকার চেকটা দিতে। সনদপত্র স্বাক্ষর করে তুলে দিলেন আমার মার হাতে। এ সময় উনি জানতে চাইলেন আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা এবং কে কি করছে। একপর্যায়ে জিল্লুর রহমানকে বললেন, উনার ছোট মেয়ে (খালেদা স্বপ্না) বিবাহযোগ্য না হওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রামের বাসভবন উনাদেরই থাকবে। মা তখন খুব আবেগাপ্লুত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে বললেন ‘বাবা চট্টগ্রামে আমার স্বামী শহীদ হয়েছে পারলে অন্য কোথাও আমাকে একটা থাকার জায়গা দেন।’ সেই তখন থেকেই ৭/৪, আউরঙ্গজেব রোড, মুহম্মদপুর, ঢাকা ছিল আমার মা’র বাসস্থান ও ঠিকানা। আজ মাও নেই, বাবা আমার মানসপটে প্রতিদিন আসে। দুই চোখে দেখছি স্বাধীনতার আনন্দ। কিন্তু তার মাঝে যে শূন্যতা, তা পূরণ করব কি দিয়ে? কোথায় পাব বাবার লাশ কোথায় গেলে দেখতে পাব তার বুলেটবিদ্ধ বুক? দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে খুঁজছি বাবাকে। কিন্তু বুকের শূন্যতা পূরণ করতে পারছেন না কোন কিছুই। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বাবাকে হারানোর বেদনা কেন জানি আরও তীব্র হচ্ছে আমার মনে। প্রতিবছরে এপ্রিল মাস এলেই বাবার শাহাদাতবার্ষিকী পালন করি। কিন্তু কোথাও মিলে না তার দেখা। আমার ভালবাসার এ মানুষটিকে হয়ত দেখব মৃত্যুর পর। তখন কি আমি বলতে পারব, বাবা তোমার বুকের কোন দিকটায় বিঁধেছিল ওই তিনটি বুলেট। লেখক : প্রাক্তন প্রিন্সিপাল অফিসার, নৌ-বাণিজ্য অধিদফতর, চট্টগ্রাম
×