ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পিন্টু রহমান

গল্প ॥ বিভাজন

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ২৩ মার্চ ২০১৮

গল্প ॥ বিভাজন

যাত্রীসঙ্গ প্রাসঙ্গিক হিসেবে আলোচিত হলে বহুমুখী ভাবনা তাদের চৈতন্যে রেখাপাত করে; দূর অতীত থেকে নিকট পর্যন্ত বর্তমান হয়ে ওঠে! ভেবে ভেবে হয়রান, তথাপি ভাবনার কিনারা হয় না, আরও বেশি ডালপালা গজায়। কারও কারও কৌতূহল লাশ বিষয়ে- ট্রেনে কি তবে মুসলমানদের লাশ আসছে! নাহ, যুঁতসই উত্তর নেই। কেউ কেউ বলাবলি করছে, সেই ট্রেনের মতো এই ট্রেনটাও ভুতুড়ে আর অপয়া! অবশ্য ভূত বিষয়ক উপাখ্যানে তরুণদের অনীহা; তারা একজন ম্যাজিশিয়ানকে নিয়ে ভাবিত- শেষতক লোকটি আসবে তো? পিপুল গাছের ছায়ায় ছেলে-বুড়ো-শিশু ও মেয়েদের উপস্থিতি বাড়তে থাকলে ভাবনার পরিধিও বেড়ে যায়। ম্যাজিশিয়ানকে নিয়ে বিবমিষা। লোকটি নিশ্চয় ছেলেধরা! শতদ্রু নদীর ওপর ধুঁকতে থাকা জরাজীর্ণ ব্রিজ সংস্কারের জন্য যে মাথার প্রয়োজন, লোকটি হয়ত সেই মাথা সংগ্রহে আসছে! খুবই ভয়াবহ ব্যাপার! ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রিজটিকে মুহূর্তে অপয়া বলে মনে হয়। বড় বড় ব্রিজ নির্মাণ ও মেরামতে যে মানুষের মাথা লাগে এ কথা মিথ্যা নয়- কম-বেশি তারাও শুনেছে! বয়স্ক মেয়েরা একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে; নেংটো শিশুদের কোলের মধ্যে জড়িয়ে ধরে; মাথা-মুখে পরম মমতায় হাত বোলায়; কেউ কেউ বুকে থুঁতু ছিটায়। ভয়ার্ত পরিবেশ দূর করতে জুগ্গাত সিং বার কয়েক গুরুর নাম উচ্চারণ করে; মায়েদের উদ্দেশ্য করে বলে, ভয় নেই; এসব সত্যি নয়, ওরা যা জানে না তাই আমাদের শোনাচ্ছে। নিশ্চয় আমাদের ভয় দেখাচ্ছে! তোমরা কেউ ভয় পেয়ো না! মিত সিং প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে, সত্য-মিথ্যার তুমি কি জানো জুগ্গাত; গুরুর নাম করে বলতে পারোÑ লোকটি যে আমাদের অনিষ্ট করতে আসছে না, তার নিশ্চয়তা কি? তাছাড়া দিল্লী ছেড়ে পাঞ্জাবের এই অখ্যাত গ্রামে আসবে কেন! সে কী আমাদের আত্মীয়, নাকি আমরা তাকে নেমতন্ন করেছি? মিত সিংয়ের সন্দেহ অমূলক নয়। অন্য আরেকজন শিখ যুবক হাত নেড়ে নেড়ে জানায়, ওদের মতলব ভাল না ভাইজি। নতুন করে দিল্লী শহর ও শহরতলিতে দাঙ্গা শুরু হয়েছে; হিন্দু যুবকরা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করছে আর তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আগুনে জ্বালিয়ে দিচ্ছে; তো, আগুনের ওই শিখা আমাদের যে স্পর্শ করবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়! তাছাড়া... জুগ্গাত সিং বিস্মিত। শিক্ষিত ছেলেটিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে, ছেলেটির কথা থামিয়ে দিয়ে জুগ্গাত সিং বিস্ময় প্রকাশ করে, আবারও দাঙ্গা! হা জি; দাঙ্গাবাজরা মুসলিম নিধনে নেমেছে। হিন্দুস্থান থেকে তাদের সমূলে উৎখাত করতে চায়। প্রশাসনও নির্বিকার, যা কিছু ঘটছে তাদের নাকের ডগায়! পুরোদস্তুর রায়োট, উভয় পক্ষ খুনের নেশায় মত্ত। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। উগ্রবাদী সংগঠনের ইন্ধনে পরিস্থিতি দিনকে দিন অবনতির দিকে। এ বিবেচনায় দিল্লী থেকে যে ট্রেন আসছে তাতে মুসলমানদের লাশ থাকা স্বাভাবিক; শতদ্রু নদী পার হয়ে লাশগুলো হয়ত পাকিস্তানের দিকে চলে যাবে! জুগ্গাতের মধ্যে অস্থিরতার মাত্রা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলছে সে। কাঁপা-কাঁপা গলায় উচ্চারণ করে, এসব কী বলছ তুমি? ইতিহাস থেকে কী ওরা শিক্ষা নেয়নি! নাকি সব ভুলে গেছে! হুম, ভুলে গেছে; তা না হলে পুনরায় এই ফাঁদে পা দিত না! নতুন করে রায়োট ফিরিয়ে আনত না। তাছাড়া রায়োট কোন সমাধান নয়, সভ্য সমাজে বেমানান। তোমাদের মনে নেই, আমরা কি হারিয়েছি; তোমরা কী হারিয়েছো! পিপুল গাছের নির্জনতা যেন আরও ভারি হয়ে ওঠে! সকলের চোখে মুখে ভয়ের চিহ্ন। নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে হয়। ব্রিজের ওপারেই পাকিস্তানী সীমান্তরক্ষীদের আস্তানা। উস্কানি ছাড়াই হঠাৎ হঠাৎ গুলি ছোড়ে; সীমান্তরেখা অতিক্রম করে গরু-ছাগল ধরে নিয়ে যায়, জেলেদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে- কিন্তু দাঙ্গার খবর নিশ্চিত হলে হুলুস্থূল বাঁধিয়ে দেবে; প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠবে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় আশপাশের গ্রামগুলো ধ্বংস করে দেবে। নতুন করে আর ধ্বংসের কথা ভাবতে পারে না; ইতিমধ্যে অনেক ধ্বংসের সাক্ষী তারা। সাতচল্লিশ পরবর্তী সময়ে প্রতিবেশী দেশ দুটি কাশ্মীর ইস্যুতে তিন-তিনবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। অসংখ্য প্রাণহানি ঘটেছে। গ্রাম ছেড়ে সাধারণ জনগণ পালিয়েছে- যাদের অধিকাংশই এখন উদ্বাস্তু; খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিমানের শব্দ শুনলে কাঁচকি মাছের মতো ছুটে পালায়। জুগ্গাত নড়েচড়ে বসে। সর্দার তাদের সাহস যোগায়, ভয় নেই সিংজি, একটুও ভয় নেই; ওই ট্রেনে নাকি একজন ম্যাজিশিয়ান আছে! ম্যাজিশিয়ান! ম্যাজিশিয়ানের কথায় নতুন কৌতূহল সৃষ্টি হয়। কৌতূহলী চোখে সম্মুখে তাকায়- পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী মনো মাজরা গ্রাম, ছোট্ট রেলস্টেশন, স্টেশন সংলগ্ন রেস্ট হাউজ, অস্ত্র হাতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী, রক্ষীরা তৎপর; এদিক-সেদিক হাঁটাহাঁটি করছে। স্টেশনের পাশ ঘেঁষে বিশালাকায় যে কিকার গাছ, তার ছায়ায় ছড়ানো-ছিটানো চেয়ার-টেবিল ও শামিয়ানা। গ্রামবাসী হতাশার দৃষ্টিতে সেদিকে তাকায়। জুগ্গাতের চোখ আরও ওপরে, গাছের শাখা-প্রশাখায়। দুরন্ত যৌবনে অসংখ্যবার গাছটিতে চড়েছে সে। বাদুরের মতো শাখা-প্রশাখায় বিচরণ করেছে। কিকার গাছটি অন্য সব গাছের তুলনায় প্রাচীন ও ছায়াময়। পাতার ফাঁক গলে নদীর ওপারে তাকালে পাকিস্তানের গ্রামসমূহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্টেশন সংলগ্ন এলাকাটি রণক্ষেত্র। ভারি অস্ত্রসমূহ পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে তাক করা রয়েছে। অঘটন ঘটলে সমুচিত জবাব দেবে। ঘটন-অঘটন বিষয়ে জানার অধিকার আর সবার চেয়ে সর্দারের বেশি। কেননা, কারণে-অকারণে সে স্টেশনে যায়, যত্রতত্র ঘুরতে পারে। মাঝে মাঝে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ডেকে পাঠায়, গ্রামবাসীর করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দেয়। তাছাড়া স্টেশনে দায়িত্বরত সৈনিকরা তাকে চেনে; হাসি হাসি মুখ করে কুশল বিনিময় করে। অতএব, গ্রামবাসীর ধারণা, ট্রেন বিষয়ে সর্দার নিশ্চয় অবগত! তারা তাকে ঘিরে ধরে বলে, দোহাই সর্দারজি, আমাদের সব খুলে বলুন; কথা দিচ্ছি এ কথা আমরা কাউকে বলব না। গুরুদুয়ারার প্রতি ইঙ্গিত করে বুকে থাপ্পড় মেরে জুগ্গাত সিং কসম কাটে, বলুন সর্দারজি, বলুন আমাকে; গুরুর নামে কসম কাটছি, জীবন গেলেও গোপন ফাঁস করব না। প্রত্যয়ী জুগ্গাত সিংকে দেখে কেমন অচেনা মনে হয়। তার শরীরে যেন অশুরের শক্তি! গুরুদুয়ারার সেবক মিত সিং কয়েক পা এগিয়ে সর্দারের পাশে এসে দাঁড়ায়, আলত করে কাঁধে হাত রাখে- বল সর্দার, কোন অনিষ্ট হওয়ার আগে সত্য জানাও আমাদের; প্রয়োজন হলে গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাব, তবুও আমাদের সত্য জানাও! না ভাইজি, এক চুল নড়ব না; ভিটেমাটি ছেড়ে কোথায় যাব আমরা! মিত সিং ইতিহাসের পথ ধরে- জুগ্গাত, মুসলমানদের কথা মনে নেই? মনে নেই, রাতের অন্ধকারে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কিভাবে তারা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে! এই গ্রামে তাদেরও ভিটেমাটি ছিল; বাপ-দাদার কবর ছিল, একটি মসজিদ ছিল। গুরুদুয়ারার পাশের ওই পরিত্যক্ত ফাঁকা জায়গাটার কথাই বা কেমন করে ভুলে যাচ্ছ? মুসলমানরা ভুল করেছে ভাইজি, আমরা ভুল করতে চাই না। ভুল ওদের না, ভুল আমাদের অদৃষ্টের; তা না হলে ইংরেজ সাহেবরা পাঞ্জাবকে এভাবে ভাগ করবে কেন! তোমরাই বল, ধড় থেকে দেহ আলাদা করলে কি মানুষ বাঁচে; নাকি বাঁচতে পারে! পরাধীনতার ইতিহাস আমাদের অস্থিমজ্জায়। মুঘল-পাঠান, সেন-পাল অসংখ্য শাসক শোষণ করলেও ইংরেজদের মতো ধূর্ত ছিল কী না সন্দেহ। যে তত্ত্বের তাত্ত্বি¡কতায় ভারত ভাগ করা হয়েছে তা ছিল অন্তঃসারশূন্য। পাঞ্জাব ও বাংলার ক্ষেত্রে তো রীতিমতো প্রহসন। পরাজয়ের গ্লানি মানতে না পারা এবং আঞ্চলিক অস্থিতীশিলতা জিইয়ে রাখতে পাঞ্জাব প্রদেশকে দু’টুকরো করা হয়েছে। এটা এমন এক সমস্যা, যা সমাধানের অযোগ্য। কাঁপা কাঁপা গলায় সিংজি পুনরায় বলে, জীবন কেন এমন হয়; কেন বার বার স্বপ্ন হারায়! এপারের মুসলমান আর ওপারের শিখগুলো বোধহয় খ-িত কপাল নিয়ে জন্মিয়েছে! একসঙ্গে বেশ তো ছিলাম; কারও সঙ্গে কোন বিবাদ ছিল না, হানাহানি ছিল না। যে যার মতো ধর্ম পালন করতাম। উৎসবে মেতে উঠতাম। মাঠে-ঘাটে গল্প-গুজব করতাম। মাঠের কাজকর্ম অসমাপ্ত রেখে আর কয়েক যুবক পিপুল গাছের নিচে জমায়েত হয়। মাথার পাগড়ি খুলে রেখে রুমালে মুখ মোছে। ঢকাঢক শব্দে পানি পান করে। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে একজন কৃষক বলে, আহ, শান্তি! শান্তির কথায় মিত সিং খানিকটা বিরক্ত। তীর্যক চোখে মানুষগুলোকে নিরীক্ষণ শেষে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কি মশকরা করছ, এই বিপদের মধ্যে শান্তির কি দেখলে! নাকি তোমরা নিশ্চিত যে আগত ট্রেন আমাদের জন্য মৃত্যুর পরোয়ানা বয়ে আনছে না! অস্থির চিত্তে সর্দার পুনরায় বলে, লেকিন ভাইজি, উস ট্রেন মে এক আচ্ছি চিজ হ্যায়; বো আদমি ম্যাজিশিয়ান। ম্যাজিশিয়ান! হ্যাঁ, জি। মিত সিংয়ের ভ্রু জোড়া আরও কুঁচকে যায়; শরীর ও মুখের চামড়াও কুঁচকানো। চোখে যেন আগুনের প্রজ্বলিত শিখা! টেুন ও ম্যাজিশিয়ানের আগমন কিছুতেই শুভ হিসেবে ভাবতে পারে না। জুগ্গাত সিংকে উদ্দেশ্য করে বলে, জুগ্গাত, হ্যামিলন শহরের ওই বাঁশিওয়ালার কথা কি ভুলে গেছো? হ্যামিলন শহরে ঘটে যাওয়া ঘটনা বিষয়ে মহিলারা অবগত নয়। কেউ একজন জিজ্ঞেস করে, ভাইজি, ওখানে কি হয়েছিল, বলুন কী হয়েছিল ওখানে? মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে ভাইজি বলে, একজন বাঁশিওয়ালা তার বাঁশির সুরে শহরের সকল শিশুকে বিমোহিত করে পাহাড়ের ওপারে নিয়ে গিয়েছিল- যাদের একজনও আর ফিরে আসেনি। এই প্রথম সর্দারকে ভীতসন্ত্রস্ত মনে হয়। এমন কিছু ঘটলে সৈন্যদের সঙ্গে সখ্যতা করেও নিষ্কৃতি মিলবে না। তা ছাড়া আড়ালে আবডালে কান পেতে যা শুনেছে, লোকটা না কি খতরনাখ; তার মতো ম্যাজিশিয়ান দিল্লীবাসী দ্বিতীয়টি দেখেনি। তার সংস্পর্শে আম-আদমীরাও জেগে উঠেছে। নিজেদের অধিকার বিষয়ে সচেতন। জান দেবে, প্রাণ দেবে তবু আত্মসম্মান হারাতে নারাজ। হারজিতের খেলায় পারিবারিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় উগ্রবাদ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছে। ঝাঁড়ুর তোপে রাজকীয় চিহ্নসমূহ ধুলায় লুটিয়ে পড়েছে। তাদের লক্ষ্য এবার পাঞ্জাব; পাঞ্জাব অধিকার করতে উদগ্রীব। তাছাড়া ট্রেনে সে একা না অসংখ্য মানুষ আসছে! আচ্ছা, আগত মানুষগুলো জ্যান্ত না মৃত? সর্দার দ্বিধান্বিত। লাশের বিষয়টি উড়িয়ে দিতে পারে না; তার সন্দেহের পালে ক্রমশ হাওয়া লাগে। জুগ্গাত সাহসী, ন্যায়পরায়ণ; মুসলমানরা ফিরে আসুক বা না আসুক মন্দির ও গুরুদুয়ারার পাশের ওই পরিত্যক্ত জমি সে দ্বিতীয়বার দখল হতে দেবে না; প্রয়োজনে পুনরায় খুন করবে, জেলে খাটবে। এক টুকরো জমি শুধু জমি নয়, গ্রামের ঐতিহ্য; পবিত্র ভূমি। দেশভাগের সময় মুসলমানদের ফেলে যাওয়া মসজিদকে শিখরা অত্যন্ত পবিত্র মনে করে। উগ্রপন্থী কিছু হিন্দু জমির দখল নিতে মসজিদ ভাংচুর করলে জুগ্গাত ও তার দলবল রুখে দাঁড়িয়েছিল। শরীরে এক ফোটা রক্ত থাকতে মসজিদেও জমি বেদখল হতে দেবে না! জুগ্গাত ভরসার উৎস; সে আছে বলেই গ্রামবাসী ভরসা পায়; চোর-ডাকাত পর্যন্ত এ-পথ মাড়ায় না; কেউ কারও জমির ফসল লুট করে না। অথচ অজানা আশঙ্কায় জুগ্গাত সিং আজ শঙ্কিত- ভাইজি, আমাদের তকদির এমন না হয় যে, শতদ্রু নদীর স্রোতে আমরা ভেসে যাচ্ছি! দূর থেকে বাঁশির শব্দ ভেসে আসলে স্টেশনে কর্তব্যরত শিখ সৈন্যদের কর্মচঞ্চলতা বৃদ্ধি পায়। ছোট্ট প্লাটফর্মের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত পায়চারী করে; মাঝে মাঝে ঘড়ির পানে তাকিয়ে সময় দেখে। উঁচু চৌকির ওপর একদল সৈন্য অবস্থান নিয়েছে। বাইনোকুলার দিয়ে তারা পাকিস্তানী সৈন্যদের গতিবিধি পর্যালোচনা করে। ওপার থেকে আক্রমণ হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিআক্রমণ হবে। নিñিদ্র নিরাপত্তা বলয়। অথচ নিরাপত্তাহীনতা দূর হয় না। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম চাঁদ কয়েক দফা হুকুম জারি করেছে, তবু গ্রামবাসী দূরে দাঁড়িয়ে- সৈনিকদের সংস্পর্শে তাদের অনীহা। মাথার ওপর চক্কর দিতে দিতে দুটি জঙ্গী বিমান অদৃশ্য হয়ে যায়। মিত সিং নির্বিকার; ধ্যানমগ্ন; স্মৃতিকাতর। বিমানের গোঙানি হয়ত সে খেয়ালই করেনি। জুগ্গাত সিং তার কাঁধে ঝাকি দেয়। নাহ, কোন নড়াচড়া নেই। লোকটি যেন অতীতের পথে! দূরতম অতীত নিকটবর্তী হতে থাকলে ইমাম বকশের মুখচ্ছবির পাশাপাশি স্টেশন সংলগ্ন কিকার গাছটিও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে! হিন্দু-মুসলমান-শিখ সম্মিলিতভাবে সুখী ছিল এখানে; সম্প্রীতির অভাব ছিল না। ইমাম বখশের কণ্ঠে ধ্বনিত হতো আজানের মধুর স্বর; সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে ভেসে আসত উলুধ্বনি আর শিখরা জমায়েত হতো সকালের প্রার্থনায়। উর্দু বা হিন্দী নয় পাঞ্জাবী ভাষায় কথা বলত। ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে বিশেষ একটি পরিচয় ছিল- পাঞ্জাবী। অভিন্ন ইতিহাস-ঐতিহ্য ছিল; ছিল সার্বজনীন কিছু উৎসব। ওপারে রাওয়ালপিন্ডি, মুলতান, গুজরানওয়ালা, শেখপুরা এবং এপারে পাতিয়ালা, আম্বালা, কাপুরতলায় বিক্ষিপ্ত দাঙ্গার কথা শুনলেও মনো মাজরার জীবনে তার কোন প্রভাব ছিল না এবং প্রভাব না পড়ার প্রত্যাশায় উপাসনালয়ে নিয়মিত প্রার্থনা হতো। কিন্তু লাহোর থেকে একটা ভুতুড়ে ট্রেন এসে থামলে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়। মনো মাজরা ছোট্ট স্টেশন। দু’মিনিটের বেশি কোন ট্রেন থামত না; ওই ভুতুড়ে ট্রেনটি থেমেছিল, দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছিল। কেন এই অপেক্ষা! কি আছে ওখানে! জানালা-দরজাই বা বন্ধ কেন! গ্রামবাসীর পক্ষে কোনকিছু জানার উপায় ছিল না। ট্রেনের আশপাশে ভিড়তে সৈনিকরা বাধা দিচ্ছিল। কিন্তু রাত গভীর হলে, স্টেশনের পাশে আগুন জ্বলে উঠলে, কেরোসিন তেলের সঙ্গে মানুষ পোড়ার গন্ধ ভেসে এলে বুঝতে অসুবিধা হয় না- ট্রেনে লাশ ছিল! ট্রেনটি প্রায় ১৫০০ শিখ ও হিন্দুর লাশ বয়ে এনেছিল। মুসলমানদের আক্রমণে তারা প্রাণ হারিয়েছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে গভীর জঙ্গলে ঠাঁই নিয়েছিল, তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। মনো মাজরা গ্রামের মানুষ অনেক লাশের সাক্ষী। দেশভাগের সময় ওই পথ দিয়ে আরও অনেক লাশ যাতায়াত করেছে। এপার থেকে ট্রেন ভরে মুসলমানের লাশ গেছে আর ওপার থেকে এসেছে শিখ ও হিন্দুদের ছিন্ন ভিন্ন মরদেহ। বাঁশির শব্দ পুনরায় উজানের পথ ধরে; স্টেশনের কর্মচঞ্চলতা দ্বিগুণ হয়। ট্রেনটি সম্ভবত কাছাকাছি। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পেছন পেছন ভীতসন্ত্রস্তভাবে সর্দারজি হাঁটাহাঁটি করে। লাল ও সবুজ পতাকা হাতে স্টেশন মাস্টার অপেক্ষারত। গ্রামবাসী উদ্বিগ্ন। শঙ্কার আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। এমন না হয় যে, ঘরবাড়ি ফেলে রাস্তায় নামতে হবে, নতুন করে দাঙ্গার কবলে প্রাণ যাবে! নিজের প্রাণ নিয়ে জুগ্গাত সিং ভীত নয়, অনেক দিনের মরচে ধরা বল্লমটি হাতে তুলে নেয়। গুপ্তচরের মুখে জেনেছে, শতদ্রু নদীর ওপারেও উত্তেজনা! পাকিস্তানী সৈন্যরা সতর্ক অবস্থায়। ট্রেনের টানা হুইসেল আরও নিকটবর্তী হলে বুকের মধ্যে ধপাধপ শব্দ অনুভূত হয়; আর কিকার গাছ থেকে তিনটি পাখি নদীর ওপারে উড়াল দেয়!
×