ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

হকিকে ভালবেসে প্রবাসী মনিরুলের উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ২৩ মার্চ ২০১৮

হকিকে ভালবেসে প্রবাসী মনিরুলের উদ্যোগ

রুমেল খান ॥ পুরুষ ফুটবলে বাংলাদেশ কবে বিশ্বকাপ খেলবে এ নিয়ে বোধকরি কেউ ভুলেও দুঃস্বপ্নও দেখেন না। কিন্তু পুরুষ হকিতে বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপ খেলবেÑ এমন স্বপ্ন দেখেন অনেকেই। কারণ জাতীয় হকি দলের পারফর্মেন্স। অপার সম্ভাবনাময় দল তারা। কদিন আগেই তারা এশিয়ান গেমস হকির বাছাইপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। বিশ্বর‌্যাঙ্কিংয়ে তারা আছে ৩০ নম্বরে। সঠিক পরিকল্পনা, প্রয়োজনীয় অর্থ, উন্নত প্রশিক্ষণ পেলে একসময় র‌্যাঙ্কিংয়ের আরও উন্নতি ঘটবে এবং আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্বকাপ হকির বাছাইপর্বে খেলে মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে লাল-সবুজরা, এমনটাই স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন (বাহফে)। হকি খেলতে বিভিন্ন সরঞ্জাম লাগে। এগুলো কিনতে অনেক অর্থ প্রয়োজন। পৃষ্ঠপোষক ছাড়া এগুলোর সংস্থান করা মুশকিল। বাহফে তাই বিভিন্ন সময় পৃষ্ঠপোষক সংগ্রহ করে সরঞ্জামগুলো কিনে থাকে। কিন্তু এক হকিপাগল ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে, যিনি অনেক বছর ধরেই বিনা স্বার্থে, স্রেফ হকিকে ভালবেসে জাতীয় দল ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার হকি দলগুলোকে নিয়মিত হকি সামগ্রী উপহার দিয়ে থাকেন। নীরবে-নিভৃতে কাজ করা এই ব্যক্তির নাম মনিরুল ইসলাম। তার বাবা আফজাল হোসেন নাটোর সুগার মিলে চাকরি করেন। মা মনোয়ারা বেগম গৃহিণী। মনিরুলরা তিন ভাই। তিনি মেজ। নাটোরের সদর থানায় মনিরুলের জন্ম ১৯৯১ সালের ২ সেপ্টেম্বর। জীবিকার প্রয়োজনে মালয়েশিয়ায় চলে যান ২০০৭ সালে। সেখানে একটি কোম্পানির স্টোরে চাকরি করেন। পাশাপাশি ব্যবসাও করেন। বিভিন্ন খেলার ক্রীড়া সামগ্রী বিক্রি এবং ডেলিভারির ব্যবসা। এগুলোর মধ্যে ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির সরঞ্জামের ক্রেতাই বেশি। এই ক্রীড়া সামগ্রীর বেশিরভাগই (স্টিক, শিং গার্ড, হকি বল ও হ্যান্ডগ্লোভস) নিজেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই তৈরি করে থাকেন তিনি। এই ব্যবসার জন্য বৈধ ট্রেড লাইসেন্সও আছে তার। ২০১৫ সাল থেকে এই ব্যবসা শুরু। বলে রাখা ভাল, বিকেএসপির শিক্ষার্থী ছিলেন মনিরুল। ছিলেন হকি খেলোয়াড়। খেলতেন রাইট হাফ এবং উইং ব্যাকে। ২০০৬ সালে বিকেএসপিতে আয়োজিত যুব চ্যাম্পিয়নশিপ হকিতে অংশ নিয়েছিলেন। এ পর্যন্ত তিনটি জেলা ক্রীড়া সংস্থাকে হকি স্টিক, শিংগার্ড, হকি শু, হকি ট্রেনিং বল, বাস্কেটবলের কেডস, ফুটবল বুট, বাঁশি ও জার্সি দিয়েছেন মনিরুল। শুধু তাই নয়, জাতীয় হকি দলের অনেক খেলোয়াড়েরও তিনি বিনামূল্যে হকি সরঞ্জাম দিয়ে থাকেন। এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপনে মনিরুল জানান, ‘এই তো কদিন আগে ওমানে খেলতে যাবার আগে জাতীয় দলের ছয় খেলোয়াড় সারোয়ার হোসেন, মাঈনুল ইসলাম কৌশিক, মিলন হোসেন, ফরহাদ আহমেদ শিটুল, সোহানুর রহমান সবুজ এবং হাসান যুবায়ের নিলয়কে হকি স্টিক, কেডস, টি-শার্ট, হ্যান্ড গ্লাভস উপহার দিয়েছি। এছাড়া দলের হেড কোচ মাহবুব হারুন ভাইকে এবং জাতীয় দলের সাবেক সহকারী কোচ আশিকুজ্জামান ভাইকে টি-শার্ট উপহার দিয়েছি।’ এই যে এভাবে বিনামূল্যে বা উপহার হিসেবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ক্রীড়া সামগ্রী এভাবে দিয়েই যাচ্ছেন এতে ব্যবসায়িক ক্ষতি হয় না? হলে কেন এটা করেন? এই প্রশ্নের জবাবে মনিরুল বলেন, ‘পুরোটাই ভাই লস প্রজেক্ট। কিন্তু আমি জেনেশুনেই এমনটা করি। কারণ আমার ভাল লাগে, আমি হকিপ্রেমী। নিজেও একসময় হকি খেলেছি। আমার এমন কাজে আমার পরিবার আমাকে মোটেও বাধা দেয় না বা রাগ করে না। বরং উৎসাহ দেয়। কারণ আমি তো কোন খারাপ কাজ করছি না। সৎভাবে কাজ করলে আল্লাহ্ নিশ্চয়ই আমাকে একদিন লাভের মুখ দেখাবেন। যতদিন আমার সামর্থ্য থাকবে ততদিনই হকিকে ভালবেসে এমনটা করে যাব।’ এই ছয় খেলোয়াড়ের সঙ্গে যোগাযোগটা হলো কিভাবে? ‘সারোয়ার তো আমার এলাকারই ছেলে। ফেসবুকে আগেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। বাকিরাও আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। মাস তিনেক আগে আমার মাথায় আসে ওদের কিছু উপহার দেয়ার। এই হচ্ছে কাহিনী।’ কিন্তু এভাবে যে কোচ-খেলোয়াড়দের হকি সরঞ্জাম দিচ্ছেন, বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন জানলে আবার কোন সমস্যা হবে না তো? ‘কিসের সমস্যা। আমি তো এগুলো ওদের উপহার দিয়েছি। স্পন্সর করিনি। আর যদি কোন সমস্যা থাকতো, তাহলে ওরা নিশ্চয়ই এগুলো নিত না।’ তবে হকি ফেডারেশন চাইলে অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় হকি দলকে অফিসিয়ালি এসব সরঞ্জাম দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করতে চান মনিরুল। তবে এ বিষয়ে তার কোন ধারণা নেই বলে জানালেন। তবে অচিরেই বিষয়টি নিয়ে ফেডারেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন তিনি। সেই সঙ্গে জনকণ্ঠকে তিনি জানান, তার পরবর্তী পরিকল্পনার কথাও, ‘আগামীতে আমি অ-১৬ জাতীয় হকি দলকেও ক্রীড়া সামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা করতে চাই। ফেডারেশনকে প্রস্তাব দেয়ার কথা ভাবছি।’ জাতীয় হকি দলের খেলোয়াড় সারোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, ‘মনিরুল ভাইয়ের মতো এ রকম হকিপাগল লোক খুব কমই দেখেছি। আমাদের তো বটেই, জাতীয় দলের বাইরেও অনেককেই তিনি অনেক ক্রীড়া সামগ্রী উপহার দিয়ে থাকেন বলে শুনেছি। তার এই উদ্যোগ একজন নবীন-তরুণকে হকি খেলতে অনুপ্রাণিত করবে এবং খেলোয়াড়দের আরও ভাল খেলতে উজ্জীবিত করবে। তার মতো এমন অনেকেই যদি এগিয়ে আসেন তাহলে দেশের হকি নিঃসন্দেহে অনেক এগিয়ে যাবে।’ মনিরুলের মতো নিঃস্বার্থ হকিপ্রেমী-দাতা আরও এগিয়ে আসবেন হকির উন্নয়নে এটাই হকিপ্রেমীদের নিগূঢ় প্রত্যাশা।
×