ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাহমান ওয়াহিদ

খাম

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ৯ মার্চ ২০১৮

খাম

‘খামটা বুঝে নিন ভাইজান। প্লিজ এখনই দেখবেন না। শুধু নিয়ে আমাকে কাইন্ডলি মাফ করে দেবেন।’ ‘কিসের খাম স্যার? কিছু তো বুঝছি না!’ ‘বুঝলেন না? ওই যে সেই বড় ব্রিজের ব্যাপারটা...’ ‘ও...সেই কালিদহের ব্রিজটা? কিন্তু স্যার, ওটা তো আপনাকে খুশি হয়েই দিয়েছিলাম। আপনি তো আর চেয়ে নেননি।’ ‘না মিলন সাহেব। না চাইলেও আমার রিজেক্ট করা উচিত ছিল। পারিনি। সবটা ফেরতও দিতে পারিনি।’- রিটায়ার্ড অফিসার আবুল হাসান কনট্রাক্টর মিলন শেখ এর হাত দুটো চেপে ধরেন। ‘আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে স্যার। নিচ্ছি। বাট অনেকেই তো নেয়। আমরাও বেনিফিটেড হই। এখানে ফেরত দেয়া নেয়ার কী আছে বলুন তো স্যার।’ ‘অনেক কারণ আছে রে ভাই। সে সব কথা থাক। আপনি মন থেকে মাফ করে দিয়েছেন তো?’ ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ দিয়েছি। বাট ব্যাপারটা ঠিক ক্লিয়ার হলো না স্যার, খচখচানিটা থেকেই গেল।’ ‘ওটা না হয় থেকেই যাক। আসি তাহলে মিলন ভাই। আল্লাহ হাফেজ।’ মেইন রোডে এসে পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করেন আবুল হাসান। তাতে এখনও পর্যন্ত তেইশ জনের নাম উঠেছে। স্মৃতি হাতড়িয়ে যখনই যার নাম মনে পড়ছে টুকে নিচ্ছেন চিরকুটে। এ সংখ্যা কততে গিয়ে ঠেকবে কে জানে। তাতে অবশ্য সমস্যা নেই। হাতে যা আছে তার থেকে কিছু কিছু করে দিয়ে মাফ চেয়ে নিলেই হবে। মালেক হুজুর তো সে রকমই বললেন। এ ছাড়া আর উপায়ই বা কি? সারা জীবন কার কাছে কত খাম নিয়েছেন সে সব তো আর লিখে রাখেন নি। লিখে রাখার কথাও না। সন্তান বলতে দুটি কন্যা। লেখাপড়া শিখেছে। একটা ভালো ঘরে পাত্রস্থ হয়েছে, আরেকটা হতে যাচ্ছে। আর কি চাই? এখন শুধু ভাবনাটা আখেরাতের নাজাত নিয়ে। ষাট পেরিয়ে গেছে। পেনশনসহ সম্পদ যা আছে, তাতে বড় কোন বিপদ না হলে বাকি দিনগুলো মোটামুটি হেসে খেলেই পার করে দেয়া যাবে। দিনগুলো যাচ্ছিলও সেভাবেই। কিন্তু পড়শি মালেক হুজুর দিলেন সব উল্টোপাল্টা করে। হুজুর খুব পরহেজগার মানুষ। মসজিদে একসাথে নামাজ পড়তে পড়তে তাঁর নেক নজরে পড়ে গেলেন আবুল হাসান। একদিন তবলিগের দাওয়াতে পনের দিনের জন্য তাঁকে বাইরে নিয়ে গেলেন হুজুর। ব্যস। পাল্টে গেল আবুল হাসানের চেহারা সুরত। ফিরলেন তিনি একমুখ সাদা কালো দাঁড়ি, গোল টুপি আর লম্বা জোব্বা গায়ে নিয়ে। মেরিনা বেগম তো রেগে মেগে কেঁদে জারেজার। তাঁর স্মার্ট স্বামীর একই হাল! সে যেন এখনই সত্তর বছরের থুরথুরে বুড়ো। বললেন, ‘ছাড়ো তো এখন এসব মুনার বাপ। তোমাকে চিনতেই পারছি না আমি। আরও পরে না হয় কোর এসব। দিন তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছে না।’ আবুল হাসান মুচকি হাসেন। মনে মনে বলেন- দিন কি আর আছে মেরিনা বেগম। মরণ তো ঘণ্টা বাজিয়ে আসবে না। সুন্নত তরিকার চেহারা সুরত ছাড়া কবরে গেলে মুগুরের ঘাই এ দফা রফা করে দেবে কবর। দুনিয়া পাগল মেরিনা বেগমের এখন এসব বুঝে আসবে না। এর ওপর ক’দিন আগে এক মাহফিলে হুজুরদের বয়ান শুনে তো তাঁর দিশেহারা অবস্থা। হুজুররা বলেছেন- খাম টামের রক্ত মাংস নিয়ে ইবাদত করলে তা কবুল হবে না। হায়! হায়! ইবাদত কবুল না হলে তো পরকাল ঝরঝরে! মাথার ভেতরে তুফান ওঠে আবুল হাসানের। তবে নাজাতের পথ দেখিয়ে ঠা-া করেন মালেক হুজুরই। তারপর থেকে স্মৃতি হাতড়ে লিস্ট তৈরি করে মাঠে নেমে পড়েছেন আবুল হাসান। তালিকার দু’নম্বরে এখন আব্দুল হামিদ মিয়া। ভাল ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু তার সেই ইলেট্রনিকসের ব্যবসার রমরমা অবস্থাটা এখন আর নেই। হামিদ মিয়া বয়সের ভারে চেয়ারে ঝিমোচ্ছিলেন। মুখে লাল মেহেদির ছোট সাইজের দাঁড়ি। আবুল হাসান সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তড়াক করে দাঁড়িয়ে যান হামিদ মিয়া। ‘আরে, স্যার আপনি! চেনাই যায় না! এ্যাত্তো চেঞ্জ স্যার! আসেন আসেন। বসেন।’ ‘বহুত শুকরিয়া হামিদ মিয়া। বসার দরকার হবে না। আপনার সঙ্গে যে দেখা হয়েছে সেটাই পরম সৌভাগ্য। একটা জরুরী কাজ সেরেই চলে যাব।’ ‘তা কি করে হয় স্যার। কতদিন পর দেখা হলো। কিছু না খাইয়ে তো ছাড়তে পারব না। গরিব হয়ে গেছি বলে ইজ্জত করতে তো আর ভুলিনি স্যার। ’ ‘না হামিদ মিয়া সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আরও কয়েক জায়গায় যেতে হবে ভাই। আপনার এ অবস্থা দেখে আমারও খারাপ লাগছে। কিন্তু কি করবেন বলুন। ধন দৌলতের সব কিছু তো ওই আল্লাহ পাকের হাতে। তিনিই আবার দেবেন ইনশাল্লাহ।’ -এই বলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা সাদা খাম বের করে হামিদ মিয়ার সামনে ধরে বললেন, ‘এতে সামান্য কিছু আছে। নিয়ে আমাকে কাইন্ডলি মাফ করে দিন ভাই।’ ‘এ আপনি কি করছেন স্যার। কিসের খাম? মেয়ের বিয়ের দাওয়াত টাওয়াত নাকি?’ ‘আরে না হামিদ মিয়া। দাওয়াতের কিছু না। ওই যে একটা প্রজেক্টের জন্যে...’ মূুহূর্তেই সব মনে পড়ে যায় ঝানু ব্যবসায়ী হামিদ মিয়ার। খাম ফেরত! তা-ও একেবারে নিজে হেঁটে এসে! এ সুযোগ তো হাত ছাড়া করা যাবে না। আসলটা ফেরত পেলেও ব্যবসাটা আবার দাঁড় করানো যাবে। আহা। আনন্দে চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে ওঠে হামিদ মিয়ার। ‘বুঝেছি স্যার। আপনি খুব ভাল মানুষ। না হলে কেউ কি এভাবে হেঁটে ফেরত দিতে আসে? কিন্তু স্যার, মনে কিছু নেবেন না। আমি তো আপনাকে তিনটে মোটা খাম দিয়েছিলাম। অনেক আগের কথা। মনে না-ও থাকতে পারে। তো আপনার দয়ায় কাজটা পেয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু ধরে আর রাখতে পারলাম না। জমি গেল। জমানো টাকা গেল। বউ এর গয়না গেল। এখন তো দেখতেই পাচ্ছেন কি করুণ অবস্থা।’ ‘বুঝতে পারছি হামিদ মিয়া। খামের কথাও জানি। কিন্তু কী করবো বলুন। অবসরে গেছি। আমার যে এর বেশি সাধ্য নেই রে ভাই। দয়া করে মাফ করে দেন। আল্লাহ আপনার অনেক ভালো করবেন।’ হামিদ মিয়ার মুখ থেকে এবার বিনয়ের পর্দাটা সরে যায়। শক্ত চোয়াল দুটো উঁচু হয়ে ওঠে। একেবারে ভিন্ন মানুষ সে এখন। দৃষ্টিটা অন্য দিকে রেখে বলে- ‘রাখেন মিয়া ওসব আলতু ফালতু কথা। সারাজীবন দুহাতে কামাইছেন। এখন হুজুর হইয়া ফাজলামো করতে আইছেন, না? আমি ছেলেপুলে নিয়া না খাইয়া মরতেছি, আর আপনি আইছেন ভিক্ষা দিতে! শোনেন সাহেব, দিলে পুরোটাই দিবেন, না দিলে সব ফাঁস কইরা দিমু। কেয়ামতেও বুঝবেন ঠ্যালাটা। আপনি মানি মানুষ। এর বেশি আর কিছু বললাম না। বাসায় গিয়ে ভাবেন। যান।’ ০২. খুব মুষড়ে পড়েছেন আবুল হাসান। হামিদ মিয়ার কথা মানতে গেলে পেনশনের প্রায় অর্ধেকটাই নেই হয়ে যাবে। এরপর বাকিদের কাছে যাওয়ার কোন উপায় থাকবে না। তখন শহরের বাড়িটা বিক্রির কথা ভাবতে হতে পারে। শেষ জীবনের সব সম্পদই যদি এভাবে তলানিতে এসে ঠেকে তাহলে বাকি নিঃশ্বাসটুকু চলবে কি করে? সারাটা রাত নির্ঘুমই কেটে গেল আবুল হাসানের। বিষয়টা যে এতটা জটিল হয়ে পড়বে তা বিন্দুমাত্র ভাবতে পারেননি তিনি। এরপর ভয়ে আর কারো কাছে যাওয়ার ভাবনাও উবে গেছে তাঁর। কারণ মোবাইলের যুগে ব্যাপারটা আর গোপন থাকবে না। সবাই তখন হামিদ মিয়া হয়ে যাবে। কিন্তু এখন করবেনটা কী তিনি। বুকের ভেতরটা ভারি হয়ে আসে হাসানের। বাইরে কোথাও একটু গেলে মন্দ হয় না। প্রিয় এক ভাগনি বুলি। কাছেই মোহাম্মদপুরে থাকে। ওর বিয়ের পর সাতটি বছর পার হয়ে গেছে, একটিবারও যাওয়া হয়ে ওঠেনি কাজের চাপে। একটা ছেলে কোলে এলেও ওকে নিয়ে কষ্টের শেষ নেই বুলির। অটিজমের এই বাচ্চা নিয়ে ও কী করবে তা নিয়েই ওর যত ভাবনা। মামা আবুল হাসান সান্ত¡না দিয়ে ওকে থামিয়ে রাখলেও সামনা সামনি আজও দেখা হয়ে ওঠেনি। সেখানেই যাবেন তিনি। কিন্তু সেখানেও যে আরেক কিসিমের টেনশন অপেক্ষা করছিল- কল্পনাও করেন নি আবুল হাসান। এতদিন পর মামাকে কাছে পেয়ে আনন্দে কান্না থামতে চায় না বুলির। একমাত্র ছেলে মৃদুল সামনে আসে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় আবুল হাসানের দিকে। এক সময় চোখদুটো নিচে নামিয়ে বলে, ‘কে এটা?’ ‘তোমার নানু বাবা সোনা।’- বুলি পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘নানু মানে কি? আমি চিনি না, চিনি না। ওকে যেতে বল, যেতে বল’-চিৎকার করে বলতে বলতে পাশের ঘরে চলে যায় মৃদুল। হতবাক আবুল হাসান কী বলবেন ভেবে পান না। বুলি বুঝিয়ে বলেও ওর চিৎকার থামাতে পারে না। মামার কাছে বসে বলে, ‘এ রকমই করে মামা। নতুন কাউকে সহ্যই করতে পারে না।’- চোখে পানি আসে বুলির। আবুল হাসান সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করে বলেন, ‘কাঁদিস না। শুনেছি ওর নাকি অনেক মেধা। ভালো গান করতে পারে, পড়াশোনাতেও ভালো। অতীত ভবিষ্যতের কথাও নাকি নির্ভুল বলতে পারে। এমন ট্যালেন্টেড ছেলে ক’জনের হয় বল্?’ ‘হ্যাঁ মামা। এই মেধাটুকু আল্লাহ দিয়েছেন বলেই একটু সান্ত¡না পাই।’- ওড়নায় চোখ মোছে বুলি। পেছনে তাকিয়ে দেখে-আধখোলা দরোজার ফাঁকে চোখ রেখে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে মৃদুল। ইশারায় কাছে ডাকে বুলি। আপত্তি করে না সে। সোজা এসে নানুর পাশে বসে দাঁড়ি নিয়ে খেলা করতে থাকে। তবে মুখটা তখনও গম্ভীর। আবুল হাসান ওকে খুশি করার জন্যে বলেন, ‘ভাইয়া, তুমি নাকি সুন্দর গান করতে পারো। শোনাবে একটা?’ ‘না এখন গান করা যাবে না। মুড নাই।’ ‘ঠিক আছে। তাহলে কী করবে? তুমি নাকি কোন্ মাসের কোন্ তারিখ কি বার হয়- ঠিক ঠিক বলে দিতে পারো?’ ‘হ্যাঁ পারিই তো।’ ‘তাহলে বল তো, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ কি বার ছিল?’ ‘শুক্রবার। মোবাইলে সার্চ করে দ্যাখো।’- বুলি মোবাইল সার্চ করে দেখাল মৃদুলের কথাই ঠিক। বিস্ময়ে থ মেরে যান আবুল হাসান। কৌতুহলও বেড়ে যায়। বলেন, ‘বাহ্ ঠিক বলেছ তো। এবার বলতো ভাইয়া, ২০২৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর কি বার হবে?’ হঠাৎ মৃদুল উঠে পড়ে মুখ গম্ভীর করে যেতে যেতে বলে, ‘বুধবার।’-বুলি মোবাইলে মিলিয়ে দেখল-ঠিক তাই। আবুল হাসান খুশিতে ওকে কাছে ডেকে আদোর করতে চাইলেন। কিন্তু পেছন ফিরে তাকিয়েই দিল সে এক পিলে চমকানো ঘোষণা। ‘এই যে মিস্টার নানু। বুড়ো হয়েছ। তুমি আর বেশিদিন বাঁচবে না, বুঝেছ? ২০১৬ সালের ১৬ জুন তুমি মারা যাবে। পেপারে বড় বড় করে তোমার মৃত্যুর খবর ছাপা হবে। হা: হা: হা:’ বুলি দৌড়ে গিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে বলে, ‘ছি: ছি: মৃদুল, এভাবে বলতে হয় না বাবা সোনা। নানু কষ্ট পাবে।’ আবুল হাসান কথাটা গায়ে মাখেন নি-এমন ভাব করে বলেন, ‘থাক থাক বুলি, ওকে কিছু বলিস না। বাচ্চা ছেলে। এমনিই হয়তো বলেছে।’ ‘হ্যাঁ মামা। হঠাৎ হঠাৎ কখন যে কি বলে ফেলে...কিছু মনে করবেন না মামা।’ ‘না না কিছু মনে করিনি। স্বাভাবিক বাচ্চা হলে নিশ্চয়ই এ রকম বলতো না।’ কিন্তু মন কি আর তা মানে? বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে আবুল হাসানের। মৃত্যু! তাও একেবারে দিন তারিখের ঘোষণা! এখন মার্চ চলছে। তার মানে ওর কথা সত্যি হলে তিন মাস সময়ও হাতে নেই। ছটফট করে ওঠে ভেতরটা। ভাবেন- অটিজমের বাচ্চা হলে কি হবে? দু’দুটো বছরের বার ঠিক ঠিক বলে দিল! মৃত্যুর তারিখটাই বা তাহলে ঠিক হবে না কেন? ০৩. ‘ রুনার বিয়ের তারিখটা কি একটু এগিয়ে আনা যায় না, মেরিনা বেগম?’ ‘বল কি গো! ২৯ জুন এ ওর প্রাক্টিক্যাল শেষ হবে। তারপর সাত আট দিনের ঈদের ছুটি। কেন, পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই বিয়ে দিতে চাও নাকি?’ ‘আরে না। সম্ভব কিনা সেটা জানতে চাইছিলাম। জুন এর ৫ তারিখেই তো থিওরিটিক্যাল পরীক্ষা শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষা তেমন আর কি। এ্যাটেন্ড করলেই হলো। ওই গ্যাপটাতেই...’ ‘না, না। পরীক্ষা পরীক্ষাই। তাছাড়া তখন রোজা চলবে। এর মধ্যে বিয়ের কথা ভাবো কি করে? আসল কথাটা কী, বল তো, বড় কোন সমস্যা?’ ‘সমস্যা টমস্যা কিছু না মেরিনা। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তো। নিঃশ্বাসেরও ভরসা নেই। তাই ভাবছিলাম দায়টা যত তাড়াতাড়ি সারা যায়। এই আর কি।’ ‘কি যে বল না তুমি মুনার বাপ। বয়স বুঝি আর কারো হয় না। ওসব ঝেড়ে ফ্যালো তো মাথা থেকে। বরং দোয়া করতে থাকো মেয়েটা যেন রেজাল্টটা ভালো করে।’ - চুপসে যান আবুল হাসান। আসল কারণটা আর বলতে পারলেন না। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলেন- ‘ঠিক আছে, থাক্। অন্য কথা বলি। মাথা গোঁজার জন্যে একটা বাড়ির দরকার ছিল আমাদের, সেটা তো হয়েছে। কি বল?’ ‘হ্যাঁ হয়েছেই তো। তাতে কি?’ ‘কিন্তু পরে যেটা করেছি সেটার কি কোন দরকার আছে?’ ‘দরকার নেই মানে? কি বলছো তুমি? দুই মেয়ের জন্যে দুই বাড়ি। বেশি হলো কোথায়?’ ‘বেশিই তো হয়েছে। মেয়েরা জন্মেছে ঢাকায়। বড় হয়েছে ঢাকায়, থাকবেও ঢাকাতেই। মফস্বল শহরে শুধু থাকার জন্যে নিশ্চয়ই ওরা যাবে না। আমরা পটল তোলার সঙ্গে সঙ্গে জামাইরা বউদের রাজি করিয়ে বাড়ি দুটো বেঁচে খাবে। বোঝ এটা?’ ‘খেলে খাক না। মেয়ে-জামাইরাই তো খাবে। সমস্যা কি?’ ‘সমস্যা আছে মেরিনা। বাড়ি করতে গিয়ে যে ঋণ হয়েছে সেটা তো শোধ করা ফরজ। ওটা তো আর জামাই বাবাজিরা করবে না। পেনশনের টাকায় হাত দিলে তো জানই শেষ। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে? ঋণ নিয়ে কবরে গিয়ে মুগুড়ের ঘাই খাবো আমি একা, আর ওদিকে জামাই বাবাজিরা শ্বশুরের বাড়ি বেচার টাকা নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াবে। এটা আমাকে মানতে হবে?’ ‘ভারি মুশকিলের কথা। আমরা মরলে মেয়েরা কী করবে, না করবে সেটা নিয়ে ভাবার দরকার কি? আমাদের জীবনটা কেটে গেলেই তো হলো। আসলে তোমার হয়েছে কী, সত্যি করে বল তো?’ ‘হবে আবার কী? প্রশ্নটা হলো ঋণ শোধের। সেই টাকা তো হাতে নেই। তাই এক্সেস বাড়িটা বিক্রি করে ঋণ শোধ করে কবরে যেতে চাই। ক্লিয়ার?’- না ক্লিয়ার হলো না। পেট্রোল আগুনে জ্বলে ওঠেন মেরিনা বেগম। ‘ও...এই তাহলে আসল কথা? কিসের ঋণ শোধ? সারাজীবন তো ঋণের কোন কথা শুনলাম না। উল্টো ঋণ তুমিই মানুষকে দিয়ে বেড়িয়েছ। এখন আবার ঋণ এলো কোত্থেকে? ভেলকিবাজি, তাই না? ওসব আমি বুঝতে চাই না। খবরদার বাড়ি বিক্রির কথা আর মুখে আনবে না। এই আমার শেষ কথা।’-এক ঝটকায় ঘর থেকে বেরিয়ে যান মেরিনা বেগম। নাহ্! দুটো ইস্যূ তুলে কোনটারই সুবিধে করা গেল না। আর ইস্যু দুটোও এমন ডেলিকেটেড যে কাউকে বুঝিয়ে বলার মতোও না। মেয়ের বিয়েটাকে না হয় ইগনোর করা গেল। কিন্তু খাম এর ইস্যু? এর আর তো কোন সোর্স নেই। পার্কের ফুরফুরে বাতাসেও ঘামতে থাকেন আবুল হাসান। বিষণœ মন নিয়ে দুপুরে নামাজ পড়ে সোজা চলে এসেছেন পার্কে। এখন বেলা তিনটে। খিধেয় নাড়ি ভুঁড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছে। তিন চার বার কল এসেছে এর মধ্যে বাসা থেকে। বোঝাই যাচ্ছিল- খেতে ডাকা হচ্ছে। কিন্তু খাবেন কেন তিনি? জাহান্নামের পোড়াপুড়িটা এখানেই হয়ে যাক। খাবেন না তাই কলও ধরছেন না। পার্কে তিনি একা। এ সময়টা একা থাকারই কথা। কিন্তু দূরে ওটা কী দেখা যায়? একটা গাছের ঝোপের নিচে ওরা কারা? হ্যাঁ, কম বয়সী ছোকরা ছুকরিই তো। কে যে কার কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে আছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। জঘন্য ল্যাপ্টালেপ্টি অবস্থা। ছি: ছি:। এই রকমভাবে প্রকাশ্যে! ছেলে মেয়েরা আজকাল এতটাই বেহায়া বেশরম! নাউজুবিল্লাহ! অনিচ্ছুক চোখ দুটোকে জোর করে ফেরাতে চাচ্ছিলেন আবুল হাসান কিন্তু চাইলেই তো আর হবে না। ততক্ষণে বুড়ো রক্ত মাংসের ভেতরে টগবগে তরুণ আবুল হাসান জেগে উঠতে শুরু করেছে। এক সময় পাজামায় এক উর্ধমুখী চাপও অনুভব করেন আবুল হাসান। রোমাঞ্চিত হয়ে ভাবেন-বাহ্, এখনো আছে দেখছি! ফুরোয় নি। কিন্তু তাতে কি। মেরিনা বেগম তো অলরেডি ফিউজড। শিরিনটা থাকলে অবশ্য জমতো দারুণ। ও ছিল আগুনের টুকরো। কয়লার আগুন। ও নিশ্চয়ই এত তাড়াতাড়ি নিভে যেত না। ঠিক এ সময় বেরসিক মোবাইলটা বেজে ওঠে আবারও। উফ্! এত জ্বালায় ক্যান ্ফোনটা? প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে সেটটা বের করেন আবুল হাসান। দেখেন-জামাই মারুফ! ইসরে, জামাই আর সময় পেল না! গেল সব মজার তড়বড়ানি। কি আর করা। (চলবে)
×