ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রজেন্দ্র কুমার দাস

পাকিস্তানের বিবেক আসমা জাহাঙ্গীর

প্রকাশিত: ০৪:০২, ৫ মার্চ ২০১৮

পাকিস্তানের বিবেক আসমা জাহাঙ্গীর

শিষ্টাচার, আন্তরিকতা, ভদ্রতা, কর্তব্য, কৃতজ্ঞতা ইত্যাদি কারণে কারও মৃত্যুতে শোক প্রকাশের রেওয়াজ দেশে দেশে-সমাজে সমাজে চলে আসছে। আর সঙ্গত কারণেই শোক প্রকাশের ধরন-ধারণ হরেক রকমের হয়ে থাকে। সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের শোক প্রকাশের খবরটিই খবরে আসে। খবরে আসে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের মৃত্যুর খবরটিও। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের তালিকা একেক জনের কাছে একেক রকম হয়। এটাই স্বাভাবিক। বিষয়টি একেবারেই মনমানসিকতা-চিন্তা-চেতনার বিষয়। এত বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের কথাই যদি বিবেচনায় নিয়ে চিন্তা করি, তাহলে আইয়ুব-ইয়াহিয়া-নিয়াজী-ভুট্টো-টিক্কা বা রাও ফরমান আলী ইত্যাদি রাবণ চরিত্রের ব্যক্তিবর্গ কারও কারও গুরুত্বপূর্ণ, তাদের মৃত্যুতে অন্তর থেকেই কেউ কেউ শোক প্রকাশের কর্মটি করে থাকেন। তাদের মৃত্যুতে কারও কারও হৃদয়ে হয়তবা রক্তক্ষরণও হয়ে থাকে একান্ত গোপনে, নীরবে নিভৃতে। ওই বর্বর নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোকগুলো বাংলাদেশের প্রতিটি-মানুষের কাছেই বিশেষ পরিচিত জন। একাত্তরের জল্লাদ বললেও বোধহয় বেশি বলা হয় না। কিন্তু ওইসব রাবণ-এজিদরাই তো পাকিস্তানের সব কিছু নয়। শেষ কথা নয়। ওখানেও উদার মানবতায় ঋদ্ধ মানুষের দেখাও মেলে। খুঁজে বের করতে হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিশিষ্ট মানবাধিকার আইনজীবী ও সমাজকর্মী পাকিস্তানের আসমা জাহাঙ্গীরকে খুঁজে বের করেছেন। আসমা জাহাঙ্গীরের মৃত্যুতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীই নন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের সভাপতিও। তিনি তাঁর প্রত্যেকটি পদের দায়িত্ব নিয়ে শোকবার্তাটি প্রেরণ করেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রধান যদি আসমা জাহাঙ্গীরের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতো, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা গৌরবান্বিত হতাম। কৃতজ্ঞ জাতি হিসেবেও গর্ব করার মতো গৌরব আমরা অর্জন করতাম এবং তা এ কারণে যে আসমা জাহাঙ্গীরের পরিবার বিশেষ করে তাঁর পিতা মালিক গোলাম জিলানী আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে বর্বর পাকিস্তানীদের দ্বারা নানাভাবে অপমানিত-নির্যাতিত হয়েছেন। কে এই আসমা জাহাঙ্গীর? আমরা না হয় নানা কারণে, নানা চিন্তা মাথায় নিয়ে আসমা জাহাঙ্গীর এবং তাঁর বাবাকে ভুলে গেলাম কিন্তু আমাদের আজকের প্রজন্ম এবং আগামী প্রজন্মের কাছে তো আসমা জাহাঙ্গীরকে পরিচয় করিয়ে দেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে পরিবারটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত-সম্পৃক্ত। আমাদের সহযোদ্ধাও বটে। একাত্তরের কোন পাকিস্তানী নাগরিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তথা বাঙালীদের মুক্তি সংগ্রামকে জোরালোভাবে সমর্থন করা অবশ্যই বিরল এক সাহসী পদক্ষেপ। আসমা জাহাঙ্গীরের পিতা সেই দুঃসাহসী কাজটিই করেছেন। আসমা জাহাঙ্গীরের পিতা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। একাত্তরের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর তাঁর মুক্তির দাবিতে জেনারেল ইয়াহিয়াকে তিনি খোলা চিঠি লেখেন। এ জন্য তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। পাকিস্তানী সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধোচারণ করার ফলে ১৯৬৮-৬৯ সালে তাঁকে গৃহবন্দী রাখা হয়। বাংলাদেশের অনেক চিহ্নিত ব্যক্তি যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পাকি সামরিক বাহিনীর সহচর হিসেবে কাজ করেছেন, সেখানে এক পাকিস্তানী যেভাবে বাংলার নির্যাতিত আক্রান্ত মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তা অবশ্যই বাঙালীর জন্য এক অনন্য কাজ। আর এ জন্যই বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে তাঁকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ প্রদান করে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছ থেকে তা গ্রহণ করেছিলেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা আসমা জাহাঙ্গীর। আসমা জাহাঙ্গীর ছিলেন পাকিস্তানের বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্র্মী। পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। ইরানে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ দূত হিসেবে তিনি কর্মরত ছিলেন। আসমা জাহাঙ্গীর ছিলেন সাহসী নারী। যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার। পাকিস্তানে নারীদের নিজেদের পছন্দ মতো বিয়ে করার অধিকার ছিল না। আসমার প্রচেষ্টায় তা আজ স্বীকৃত সে দেশে। জনগণের অধিকার আদায়ে তিনি বার বার গ্রেফতার হন। বাংলাদেশের মানুষ বিশেষভাবে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকার কথা এ কারণে যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে বর্বর পাকি সৈন্যরা যেভাবে গণহত্যা চালিয়েছে, বর্বরতার সীমা ছাড়িয়েছে তার জন্য আসমা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ক্ষমা চাওয়ানোর জন্য বার বার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু সেই বর্বর রাষ্ট্রের কর্ণধাররা এখনও সে কাজটি করার মতো সৎ সাহস দেখাতে পারেনি। আসমা জাহাঙ্গীর শুধু পাকিস্তান আর বাংলাদেশেই পরিচিত মুখ নন, সারা বিশ্বে তিনি মানবাধিকার কর্মী হিসেবে স্বীকৃত এবং নন্দিত। তাঁর মৃত্যুতে সারা বিশ্ব নেতৃবৃন্দই শোকাহত। জাতিসংঘ মহাসচিব এ্যান্তনিও গুতেরেস তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। পাকিস্তানের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে আসমার মৃত্যুতে গভীর শ্রদ্ধা ভরে নানা মন্তব্য করে। কেউ বলেন তিনি ছিলেন পাকিস্তানের নৈতিক কম্পাস। কেউ বলেন, আসমার মতো একজন নাগরিকের জন্য পাকিস্তান গর্ববোধ করতে পারে। কোন কোন সংবাদপত্র লেখেÑ তিনি ছিলেন পাকিস্তানের বিবেক। কেউ বা বলেন, পাকিস্তান যত সাহসী সন্তানের জন্ম দিয়েছে আসমা ছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী। এই সাহসী নারীর প্রতি আমাদের সন্মান ও শ্রদ্ধাঞ্জলি। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক ব্যাংকার
×