ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব

উত্তাল সময়ের বয়ান অগ্নিপুরুষ

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ২ মার্চ ২০১৮

উত্তাল সময়ের বয়ান অগ্নিপুরুষ

তাঁর কলমে জাদু আছে। মায়া আছে। আছে অদ্ভুত এক ঘোর। তাঁর লেখায় বেগ আছে। আবেগ আছে। আছে চুম্বকের টান। তিনি পলকেই চরিত্রে পুরে দেন প্রাণ। সংলাপ বুনন ও চরিত্র চিত্রণে তিনি এতটাই সিদ্ধহস্ত, তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলো যেন ‘শেষ হইয়াও, শেষ হইল না’ গান। তাঁর গল্প বলার ঢংটাও দেখার মতো। খুবই সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত। তাতে গল্প-উপন্যাসের বিমূর্ত আখ্যানটি মুহূর্তেই হয়ে ওঠে জ্বলজ্বলে আর মূর্ত। তাঁর অনুপম বর্ণনাভঙ্গিতে চরিত্রগুলো আর বইয়ের পাতায় থাকে না। উঠে আসে পাঠকের চোখের পাতায়। কখনও কখনও কথা বলে, হাসে, খেলেও। তাঁর লেখনীর সবচেয়ে শক্তিশালী দিক, গতি এবং সেটা এতটাই প্রবল, তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলো পড়তে গেলে আর ফিকশন থাকে না, মনে হয় ‘নির্বাক চলচ্চিত্র’। হ্যাঁ বলছি, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামালের কথা। এবার বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে তাঁর অনন্য সৃষ্টি ‘অগ্নিপুরুষ’। ছয় দফা-উত্তর অগ্নিসময় ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে উপজীব্য করে লেখা এই ঐতিহাসিক উপন্যাসকে স্রেফ উপন্যাস না বলে বাঙালীর উত্থাল দিনের ‘নির্বাক চলচ্চিত্র’ বলাই শ্রেয়। কারণ ইতিহাস ও তার চরিত্রগুলোর এমন গতিময় উপস্থাপনা ও প্রাণবন্ত উপস্থিতি, বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলোতে যথেষ্ট বিরল। পার্ল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত এ বই কেবল একটি উপন্যাস নয়, এ যেন ইতিহাসের বাহনে অদ্ভুত এক আনন্দ যাত্রা। বইটি কেবল জ্ঞানপাঠ্য ও সুখপাঠ্য নয়, একই সঙ্গে বহুধা বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব ম-িত। যেমনÑ নিঃসন্দেহে আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়টির নাম মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালী জাতির শৌর্যবীর্য, প্রেরণা বলতে আমরা এখনও যা বুঝি, সেই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলন। সেই ইতিহাস বিষয়ে আমরা কিছু-না-কিছু জানি। তবে জানি না, সেই ইতিহাসের বুনন, সময়ের সেই ফোঁড়, চড়াই-উতরাই, আঁক-বাঁক, অলি-গলি। এই বই পাঠে, ইতিহাসের সেই টগবগে সময়ের গনগনে আগুনের আঁচ শরীরে টের পাওয়া যায়। হƒদয়ের অলিন্দ-নিলয়ে টের পাওয়া যায় সেই উত্তাল সময়ের উত্থাল অনুভূতি। আমাদের ইতিহাসের চরিত্র ও তাদের ভূমিকা সম্বন্ধেও কম-বেশি আমরা জানি। কিন্তু তাদের হাসি-কান্না, দুঃখ-হতাশায় জর্জরিত রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে দেখা পাওয়ার সুযোগ কী আছে? ‘অগ্নিপুরুষ’ আমাদের সেই সুযোগ করে দেয়। সুযোগ করে দেয় ইতিহাসের চরিত্রগুলোর চোখের সামনে ‘ঐতিহাসিক’ হয়ে ওঠার দৃশ্য উপভোগের। এখানে দেখা মিলে, কিভাবে একজন সাধারণ ছাত্রনেতা থেকে শেখ মুজিব দেশের অবিসংবাদিত নেতা, ‘অগ্নিপুরুষ’ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রিয় ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠছেন, কিভাবে ইয়াহিয়া খান একজন সাধারণ সেনা কর্মকর্তা থেকে সেনাপ্রধান, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও মুক্তিযুদ্ধের খলনায়ক হয়ে উঠছেন কিংবা একজন মোনেম খাঁ বা আইয়ুব খানের ৭ কোটি বাঙালীর দুশমন হয়ে ওঠার পথপরিক্রমা। এভাবে মওলানা ভাসানীর একবার নায়ক থেকে খলনায়ক, ফের নায়ক হয়ে ওঠা; তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মুশতাক আহমেদসহ অসংখ্যা জাতীয় চরিত্রের ইতিহাস হয়ে ওঠার রূপরেখার জীবন্ত রূপ দেখা মিলে। এই বই একদিকে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, মওলানা ভাসানীর ১৪ দফা, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ ১৯৬৬-৬৯-এ উত্থাল রাজনীতির জীবন্ত দলিল। একই সঙ্গে আইয়ুব খানের আমলে সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রবীন্দ্র সঙ্গীতচর্চা, বিপুল পহেলা বৈশাখ পালনসহ আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ঐতিহাসিক দলিল। আমাদের জাতীয় সঙ্কট ও গৌরবে বরাবরই সংবাদপত্রের রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধে ও গণঅভ্যুত্থানের সময় সেই ভূমিকা ছিল আরও বিস্তৃত ও সুদূরপ্রসারী। রাজনীতির দোলায় সংবাদপত্র-সাংবাদিকদের জীবন ও ভাগ্য যে কতটা পেন্ডুলামের মতো দোলে, এই বইয়ে সেই দৃশ্য সুনিপুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাছাড়া কেবল ছাত্র-রাজনীতিবিদ নয়, এ দেশের ইতিহাস বিনির্মাণে সাংবাদিকরা যে কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছে, বন্দুকের নলের মুখে ও সরকারের দুর্বিষহ দমন-নীতির মুখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ দেশের সাংবাদিকরা কিভাবে কলমযুদ্ধ করেছে; এই বইয়ে প্রথম বারের মতো সেই অজানা অধ্যায় জীবন্তরূপে উšে§াচিত হয়েছে। এ বই শুধু রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দলিল নয়, একই সঙ্গে সাংবাদিকতার ইতিহাস ও উত্থাল দিনে কলমযুদ্ধের দলিল। এ উপন্যাসে আরেকটি অজানা অধ্যায়ের দ্বার খুলে দিয়েছে। সেটা হলোÑ বঙ্গবন্ধুর বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পেছনে তার স্ত্রী বেগম মুজিবের অবদান ও ত্যাগ। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু জেলে থাকাকালীন সময়ে ছয় দফা প্রত্যাহারের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান, তাঁর পরামর্শে আট দলীয় জোট গঠন, প্যারোলে মুক্তির বদলে স্থায়ী জামিন ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিঃশর্ত প্রত্যাহারের শর্তে রাওয়ালপিন্ডিতে বৈঠকের সিদ্ধান্ত, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দল পরিচালনা, ইত্যাদি ভূমিকা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। একবার কল্পনা করে দেখুন, বঙ্গবন্ধুকে যদি ওই সব পরামর্শ না নিতেন, নিজের পরিবারের কথা চিন্তা করে বিপরীত পরামর্শ দিতেন, ইতিহাসের রূপরেখাটা কেমন হতো? আর অবিশ্বাস্য হলো, ফজিলাতুন্নেসা রাজনৈতিক ছিলেন না, অথচ তাঁর ভাবনা-চিন্তায় কতটা রাজনৈতিক দুর্দর্শিতা-প্রজ্ঞা! আর কঠিন সময়ে কী অটল, স্থির ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মন! তাছাড়া তাঁর মতের ওপর বঙ্গবন্ধুর কী অবিচল আস্থা ও শ্রদ্ধা! এ উপন্যাসে বাঙালী স্বাধিকার আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম নেতা মওলানা ভাসানীর মানুষরূপী উপস্থিতি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিস্তৃত বর্ণনা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ওয়াজেদ মিয়ার বিয়ে ইত্যাদি ঐতিহাসিক উপন্যাসের পাঠকদের জন্য নিশ্চিত অনন্য প্রাপ্তি। আগেই বলেছি, লেখক মোস্তফা কামালের বিশেষত্ব হলো তাঁর লেখার গতি। এ উপন্যাসও ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে, বঙ্গবন্ধুকে রাতের অন্ধকারে কারাগার থেকে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে হস্তান্তর পর্ব থেকে উপন্যাসের বাকি অংশটাকে (পৃষ্ঠা ১৬৭-২৫৪) রীতিমত থ্রিলার মনে হয়েছে। বঙ্কিম চন্দ্র আদর্শ রচনার দুটি প্রধান শিল্পগুণের কথা বলেছিলেন-১. অর্থব্যক্তি ও ২. প্রাজ্ঞলতা। ‘অগ্নিপুরুষ’ দুই গুণেই গুণান্বি^ত। যেমন- উপন্যাসে বঙ্গবন্ধুর জবানে ছয় দফার একটা সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়। সেটা হলো, ‘কত নিছো, কবে দেবা, কবে যাবা?’ ছয় দফার এমন আশ্চর্য সহজ ও প্রাঞ্জল সংজ্ঞা পাঠক আর কখনও পড়েনি। তাত্ত্বিকভাবে আদর্শ উপন্যাসের কিছু উপাদান থাকে। যেমন-প্লট বা আখ্যান, চরিত্র, সংলাপ, উপস্থাপনা শৈলী, লেখকের সামগ্রিক জীবনদর্শন ইত্যাদি। অগ্নিপুরুষ সব ক’টি উপাদানে টইটুম্বুর। একটি সার্থক উপন্যাসে দুটি জিনিস পাওয়া যায়Ñ জীবনের চিত্র ও জীবনের দর্শন। সে বিচারে ‘অগ্নিপুরুষ’-এর পরতে পরতে এ দুইয়ের দেখা মিলে। উপন্যাসের যতগুলো রূপ আছে, তার মধ্যে ঐতিহাসিক উপন্যাস সবচেয়ে কঠিন ও দুঃসাধ্য কাজ। ইতিহাসের কঙ্কালে রক্ত-মাংস দিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা প্রচ- ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিশ্রমসাধ্য একটা কাজ। পাশাপাশি, ইতিহাস ও চরিত্রের সত্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হয়। সব মিলিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মতো বিশাল এবং বহুমাত্রিক পটভূমি ও ক্যানভাসের ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার উদ্যোগÑ যার পর নেই চ্যালেঞ্জিং। লেখক দুর্দান্ত সাহস ও মুন্সিয়ানায় চ্যালেঞ্জটা মোকাবেলা করেছেন এবং তিনি এক কথায় সফল। ‘অগ্নিপুরুষের’ দুর্বলতা বলতে একটাই, কিছু কিছু অধ্যায়ে গল্পটা দুম করে শেষ করে দেয়া হয়েছে। তাতে পাঠকের অতৃপ্তি রয়ে যায়। যেমন- শেষ দিকের অধ্যায়গুলো। আরও কিছু ক্ষেত্রে চরিত্রের ব্যাপ্তিটা কম। কিন্তু বাড়ানো যেত। যেমন- মানিক মিয়া। এ চরিত্রটি মজার, ভিন্ন, কৌতূহলোদ্দীপক ও পাঠকের অজানা। তাছাড়া, ৩ বছর পর কিভাবে ‘ইত্তেফাক’ খুলল, ‘সংবাদের’ কী হলোÑ বজলুর অবস্থাই বা কীÑ এসব বিষয় কী আরেকটু বিশদ আসতে পারত না? বঙ্কিম চন্দ্রের রাজসিংহ (১৮৮২) দিয়ে বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের যাত্রা। সময়ের আবর্তনে সেই যাত্রায় যোগ হয়েছে, রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ধর্মপাল’, মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু (১৮৮৫-৯১)’, সত্যেন সেনের ‘অভিশপ্ত নগরী’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’, ‘সেই সময়’, হুমায়ুন আহমেদের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, বাদশাহ নামদার, শাহাদুজ্জামানের ‘ক্রাচের কর্নেল’, আনিসুল হকের ‘যারা ভোর এনেছিল’সহ বেশ কিছু উপন্যাস। এ ধারায় ‘অগ্নিকন্যা’ ও তার সিক্যুয়াল ‘অগ্নিপুরুষ’ নিঃসন্দেহে গৌরবোজ্জ্বল ও অনন্য সংযোজন। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, বাংলা সাহিত্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ ও ‘সেই সময়ের’ পর সবচেয়ে সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘অগ্নিকন্যা’ ও ‘অগ্নিপুরুষ’। আশা করি, বই দুটি আগামীতে দেশে-বিদেশে আরও বেশি সমাদৃত হবে। রাজনীতি ও ইতিহাসের পাশাপাশি সাংবাদিকতার উৎসুক পাঠক, গবেষক , শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য হয়ে উঠবে। বই দুটি বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী হবেÑ এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। [email protected]
×