শুরু করা যাক শৈশব থেকেই। যে দিনগুলো ছিল কবিতার মত নির্মল। প্রতিদিন কবিতা বা ছড়া মুখস্থ করানোর পেছনে কত চেষ্টাই না ছিল বড়দের। ব্যর্থতার ফলে কত বকুনিই না খেতে হতো আমাকে। স্কুলে শিক্ষকের পিটুনি খেয়ে বাসায় ফিরে স্বজনদের ঝাড়ি। এই শাসনের মাঝ দিয়েই কেটে গেছে আমার কবিতার প্রতি অনাগ্রহের শৈশব। কবিতাকে ভালবেসেছি কৈশোরে এসে। যখন বুঝতে পেরেছি, নিজেকে শুদ্ধ করার, একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে কবিতা। নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়ে নেবার মাধ্যমও এই কবিতাই। আমার বন্ধুমহলে অনেকেই কবিদের পাগল বলে। অথচ ক্লাসে ওরা পাগলদের কবিতা মুখস্থে ভুল হলে-ই শিক্ষকের ঝাড়ি ও বেতের বারি খায়। (যেমন-টি আমার শৈশবেও ঘটেছিল) আফসোস! পাগলদের যে কী মূল্য, তখনও ওরা বুঝতে পারেনি। যখন আমি সাহিত্য নিয়ে ওদের সাথে কিছু বলার চেষ্টা করি, তখন ওরা বলে, সাহিত্য মানে নাস্তিকতা। সাহিত্যিক মানেই নাস্তিক। আমি প্রতিউত্তরে বলিÑ তোরা মরে যেতে চাস, কবিরা বেঁচে থাকতে চায়। কবি আর সাধারণের মানুষের মাঝে এতটুকুই তো তফাৎ। হে বন্ধু, তোমরা জেনে রাখো, কবিতা মানে অমৃত পরশপাথর, যা অনন্তকাল পাঠক- কে কিশোর করে রাখে। সহস্রকোটি বালিকার স্বপ্নপুরুষ হয়ে ওঠে একমাত্র কবিই। কবিরাই বাঁচতে শেখান, আর কবিতা মানুষকে হাসতে শেখায়। ভালবাসতে শেখায়। পৃথিবীর বুকে মৃত্যুকে কবর দিতে এসেছে এই কবিতা। কবিতা হলো বাঁচিয়ে রাখার ঈশ্বর। বেঁচে থাকা- জন্য যতটুকুই খোরাক প্রয়োজন, সবটুকু এই কবিতাই দিয়ে যেতে পারে। শুধু প্রেম-বিরহ নিয়ে কবিতা হতে পারে, তবে সেসব কবিতার কবি কখনো প্রকৃতপক্ষের হতে পারে না। কবি মানে সমাজ পরিবর্তক। কবি মানে কলমের খোঁচায় একটি আততায়ী বিবেককে নমনীয় করে তোলা। কবি মানে দেশ, প্রকৃতি ও মানুষের গান গাওয়া। এক হাতে নয়, কবিদের লিখতে হয় সকল হাতে। সব্যসাচী কবি হয়ে উঠুক পৃথিবীর সকল কবি। পৃথিবী সাহিত্যের একজন তরুণ ছাত্র হিসেবে এতটুকু চাওয়া থাকতেই পারে আমার।
কবিতার মতো সুন্দর
মেঘরঙা কাক উড়ে যাচ্ছে স্বনীড়ের
দিকেÑ আকাশে কোনো নীলের
চিহ্ন নেই; মেঘের গোল্লাছুট, সূর্যের
চারপাশে বাতাসের শোঁ-খেল; উপরে
তাকিয়ে দেখি একটি সুন্দর পৃথিবী
অথবা একটি স্বচ্ছ সকাল ছুটে আসছে
আমার দিকে..
মর্ণিংওয়াক টেনে নিচ্ছে ওদিকটায়
শীতলক্ষ্যার কূল-ঘেঁষে কাশফুল
ফুটেছে সূর্যের মতো। আমি হেঁটে
যাচ্ছি আরও কিছুটা হাঁটবো বলে;
দেখেছি, কবুতরের ডানায় ক্রিম হয়ে
লেগে আছে একটি স্বচ্ছ আকাশ
হায় ! এত সকালে কীভাবে বকের
ক্ষুধা লাগলো? বকেরাও আমাদের
মতো প্রকৃতি খেয়ে বাঁচে; ওরাও
বড্ড প্রকৃতিখোর বাঁচাতে হবে বলে
ক্ষুধার্তের জন্য প্রকৃতিই মরে যায়।
বালির ট্রলারগুলো যদিও এই নদীরই
অংশ; তবু স্মৃতিদস্যু ড্রেজার কেড়ে
নিয়েছে বাবার রেখে যাওয়া মৎস্যখামার
ওখানে এখন চড়ুই পাখি বাসা বেঁধেছে;
ওদের জীবনযাপন পুরো কবিতার মতোই সুন্দর...
*অণুকাল
মহাকাল থেকে পৃথ্বীপথে একটি অণুকাল
খসে পড়লো; ঘড়ির কাঁটায় চোখ-পলান্টিস
খ্যালে বার্ধক্য বিবর্তন আপাতত অনুজ
ডায়নোসরের কাছ থেকেই ধার করা হয়েছে
আবহসঙ্গীত; পরবর্তীকালে নৃকুঞ্জ থেকে
কিছু কথ্যধ্বনি নেয়া যাবে আমরা বরং
মহাকালের পথেই হাঁটি। কারণ উল্কাপাতে
বংশী বাজায় প্রলয়ধ্বনি যুদ্ধের মতো।
এই নশ্বর নীলপথে চলো মদপান করি;
যদিও মহাকালে বিমুগ্ধ পানশালা রয়েছে!
উপভোগ্য ফলের রসে যদি কলসের মতো
কোমর ভেসে ওঠে তবে দোষ কী এতে?
চলো, নুব্জ হয়েই উপভোগ করি অণুকাল;
ঈশ্বর তো সবকিছু প্রস্তুতই রেখেছেন।
*অন্ধকার
ভাবো,
কোনো এক নদীর মাঝখানে একটি নৌকো একটি তুমি একটি আমি;
আমাদের চারপাশ কী বিদঘুটে অন্ধকার !
কয়েকশো-কোটি তারা স্বাভাবিক নিয়মে জ্বলছেÑ
কিছু চামচিকে বা বাঁদর উড়ে যাচ্ছে
আমাদের চোখের তেরো হাত উপর দিয়ে;
(অন্ধকারে খুব ঝাপসা লাগছে দেখতে)
তুমি ভাবতে পারো,
আমাদের চারপাশ সত্যিই খুব অন্ধকার;
যেহেতু অমাবস্যা চলছে যেহেতু এখানে
বলা হয়নি ল্যা¤প অথবা জ্বলন্ত কুপির গল্প।
তুমি ভাবতেই পারোআমরা ভেসে চলছি
এক অন্ধকার রাত ও কূল নেই এমন
কোনো নদীর স্রোতে; খুব সহজেই ভাবতে
পারো এসব, যদি এরচেয়ে নিকষ কোনো অন্ধকার
তোমার ভাবনাশক্তিতে আঁচড় কেটে না যায়...
*তুমি এবং ওরা
আজকে আকাশ খুব কেঁদেছে, জানো?
হয়তো শহর তুমিহীনা তাই;
মেঘের ভাঁজে আবছা অভিমানও
ভাসছে কোথায় তোমায় খুঁজে পাই!
তোমার খোঁজে বারান্দার ওপাশে
ফড়িং এসে অপেক্ষাতে রয়,
দৃশ্য তোমার অদৃশ্য আকাশে
প্রজাপতি ফড়িংকে তা কয়।
‘কোথায় তবে?’ প্রশ্ন করে পাখি
উত্তরে সব বললো ফুলের টব
নেই তুমি আজ; জানি এ নয় ফাঁকি
নিলেন স্বয়ং স্রষ্টা, মানে ‘রব’।
হুম জানি তা, নেই তো তোমার দোষ ও
মানছে না মন; আসবো তোমার কাছে?
যাত্রাপথে একটু কোথাও ব’সো
আসবো দেখো তোমার মনের আঁচে।
*অধুনা
এখন আর মানুষের প্রেমে ভাসি না;
কভু অন্যের সুখে হাসি না।
ধর্মান্ধতার হিংস্র থাবায় মানবতার সুখ চাষি না।
রয় ধার্মিকও পাশাপাশি না,
দেখি, চোখে শুধু জল; হাসি না।
পৃথিবীতে শুধু বাঁচবে ওরাই; দিদি, দাদা, পিসি, মাসি না।
জানি যাচ্ছেও শুভ রাশি না,
তাই একলা কোথাও আসি না।
এ ভূমে গণধর্ষণও হয়; শুধু গুম ও প্রাণনাশই না।
আজ স্বাধীনতা বলে ভাষি না,
সব ধ্বংসিত; শুধু হ্রাসই না।
পৃথিবীকে ওরা করছে নরক; ঠুকরিয়ে শুধু গ্রাসই না।
এখন কারোরই দাস দাসি না,
আমি মৃতপ্রায়; শুধু লাশই না।
সত্যি কথা বলতে এখন নিজেকেও ভালোবাসি না।
*পৃথিবীর বুকে মৃত্যুকে কবর দিতে আসবো
ঘাসের ত্বকে ফুটফুটে শিশির এক টুকরো রোদের জন্য যেভাবে প্রতীক্ষা করে,
তুমি অন্তত সেভাবে প্রতীক্ষা কোরো
আমি আসবো,
স্রষ্টার কাছে পুনর্জন্মের আবেদন কোরে
আমি পৃথিবীর বুকে মৃত্যুকে কবর দিতে আসবো!
নিশ্চিহ্ন কোরে তুলব ‘মৃত্যু’ নামক শব্দটি..
তুমি অন্তত সেভাবেই প্রতীক্ষা কোরো,
যে প্রতীক্ষার উপমায় এসে পড়ে হেমন্ত
ঝরে পড়ে পাতা;
অশ্বত্থের প্রতীক্ষমাণ ডালগুলো নুয়ে পড়ে লজ্জায়!
তুমি কিন্তু সেভাবেই প্রতীক্ষা করবে,
যে প্রতীক্ষার সাক্ষরে স্রষ্টা গ্রহণ করে নেবেন আমার আবেদন পত্র..
*প্রশ্ন এবং আমি
মন ভালো নেই বেশ কিছুদিন ধরে
না, জানি না কারণটা কী তার,
প্রশ্নগুলো মনের মাঝে ওড়ে
উত্তর আজও হয়নি আবিষ্কার।
শুকনো ঠোঁটে রাত্রি হলে মাখি
একলা ঘরে বসে নিকোটিন,
মাখছি কেন? প্রশ্নে ঘিরে থাকি
প্রশ্ন সহজ, উত্তরই কঠিন !
পর্দামেলা জানলা দিয়ে আসে
বাহির থেকে মুগ্ধ-শীতল হাওয়া,
গ্রিলটা ধরে তাকাই দূর আকাশে
রাত্রি করে চন্দ্রটাকে ধাওয়া!
মন তা দেখে প্রশ্নগুলো ভোলে;
সূর্য যখন আলতো মেলে আলো
ভেতরটা ফের প্রশ্নে জ্বলে-জ্বলে
চোখের নিচে দাগ করে দেয় কালো।