ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবাহ হারাচ্ছে নদী ॥ জেগে উঠছে অসংখ্য চর

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২০ জানুয়ারি ২০১৮

প্রবাহ হারাচ্ছে নদী ॥ জেগে উঠছে অসংখ্য চর

সমুদ্র হক ॥ সড়ক পথে চলতে চোখে পড়ে কোন ছোট সেতু। যে সেতুর নিচে শুকনো ঠাঠা। জল নেই। প্রবাহ নেই। বর্ষাকালেও ভরে না। কংক্রিটের সেতুর প্রবেশ পথে রেলিংয়ের ওপর লেখা থাকে কোন নদীর নাম। সেই নদীর অস্তিত্ব এমনই। নদীর নামটি শুধু ধরে রেখেছে সেতুটি। এমনই কত নদী শুকিয়ে ভূমি হয়েছে আর কত নদী মরা গাঙে পরিণত হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই নদী দেখভালকারী প্রতিষ্ঠান পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কাছে। জেলা প্রশাসনের নদীর নথিতেও তা খুঁজে পাওয়া যায় না। ভূমি অফিসগুলোতে শুকনো ও মরা গাঙের হিসাব বের করা সুদূর পরাহত। গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এই তিনটি নদী অসংখ্য শাখা-প্রশাখা নিয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশে গেছে। এ দেশে প্রায় ১৪ হাজার ২শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীপথ আঁকাবাঁকা অথবা চুলের বেণির মতো পে্যঁচানো বলে বাড়ত পলি অথবা জলপ্রবাহ অনেক বেশি হারে ভাঙ্গনের কারণ হয়। এছাড়া যেসব নদীর পাড় খুব একটা স্থিতিশীল নয় সেখানেও দেখা দেয় ভাঙ্গন। একদিকে পাড় ভেঙ্গে যায়। আরেকদিকে প্রবাহ বাধা পেলেই ট্র্যাক পরিবর্তন করে। নদী শুকিয়ে হারিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এভাবেই অনেক নদী হারিয়ে গিয়েছে। ভাঙ্গনের মতো নদীতে চর জাগার বিষয়টিও নদীর চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। অনেক নদী ভরাট হয়ে মরাগাঙে পরিণত হচ্ছে। আবার সংস্কারের অভাবে অনেক নদী ভরাট হয়ে অবরুদ্ধ হচ্ছে। কোন নদী রূপান্তরিত হচ্ছে খালে। শুকনো মৌসুমে সেচের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। নাব্য হ্রাস পেয়ে নৌ চলাচল বিঘিœত করছে। পানি প্রবাহ কমেছে বড় নদী ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, ধরলা, তিস্তায়। যার প্রভাবে অনেক ছোট নদী অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। খলসডোঙ্গা, মহানন্দা, আত্রাই, বড়াল, তেতুলিয়া, ইচ্ছামতি, নারদ, হুরাসাগর, গুমানী, কাঁকন, কাকেশ্বরি, চিকনি, চিকনাই, করতোয়া, রূপনাই, ফুলেশ্বরি, বাঙালী, নদীশুখা, মাথাভাঙ্গা, গোমতি, গুঙ্গানী, ট্যাপাখাওয়া, উছলি ইত্যাদি নামের নদীগুলো কোথাও মরা গাঙ কোথাও খালের মতো। অনেক নদী শুকিয়ে গিয়ে আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে। দখলও হয়েছে নদী ভূমি। যেমন বগুড়া নগরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া নদী শুকিয়ে ময়লা আবর্জনার ভাগারে পরিণত। শহরের ভেতরেই নদীকে দেখে মনে হবে কোন কাঁচা ড্রেন। এই নদীর দুই তীরের অনেকটাই দখল হয়েছে। করতোয়া কত বড় ছিল তা ১৯২০ সালের সিএস রেকর্ড ও ১৯৬২ সালের এম আর রেকর্ডে উল্লেখ আছে। নদী রক্ষায় এই রেকর্ডও দেখা হয় না। খরস্র্রোতা এই নদীর নাব্য হ্রাস করা হয় গত শতকের ৮৭-৮৮ সালে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালির কাছে বহমান করতোয়ার পানি প্রবাহ বন্ধ করে সেই পানি বাঙালী নদীতে ঘুরিয়ে দেয়ায় জন্য চকরহিমপুরে একটি রেগুলেটার নির্মান করা হয়। এর প্রবাহে করতোয়া দিনে দিনে হয়ে ওঠে খাল। পানি না থাকায় গোবিন্দগঞ্জ থেকে বগুড়া পর্যন্ত নদীর নানা স্থানে শুকিয়ে যাওয়ায় শুরু হয় দখল প্রক্রিয়া। শুকনো মৌসুমে অনেক নদী খুঁজে পাওয়া যায় না। পদ্মা মেঘনা তিস্তা ও শাখা নদীগুলোতে পানি প্রবাহ কমছে। নাব্য হারিয়ে মজে যাচ্ছে। বর্ষায় উজানের ঢলে পানি প্রবাহ বেড়ে যায়। হেমন্তের শুরুতেই কোথাও পানি থাকে না। শীতের শুকনো মৌসুমে নদীকে চেনাই যায় না। এদিকে নদী শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চর ভূমি। রাজশাহীর চারঘাট থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত ৩শ’ ৫০টির বেশি চর জেগেছে। কুড়িগ্রাম থেকে পাবনার ঢালারচর পর্যন্ত প্রায় এক হাজার চর জেগেছে। ঢালার চর থেকে রাজশাহী ২শ’ ৫০ এরও বেশি। এইসব চর বড় নদীতে পানি প্রবাহ কমিয়ে দিচ্ছে। এক সূত্র জানায় নদীতে জেগে ওঠা চরের পরিমাণ অন্তত দুই হাজার বর্গ কিলোমিটার। যা মোট ভূমির প্রায় পৌনে দুই শতাংশ। যমুনায় দেড় হাজার বর্গ কিলোমিটার। গঙ্গা ও পদ্মায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার। মেঘনা উত্তর ও দক্ষিন অববাহিকায় ৭শ’ বর্গ কিলোমিটার। একটা সময় হাটবাজার জনপদ ছিল নদী তীরে। ব্যবসা-বাণিজ্য হতো নৌপথকে ঘিরে। এখন সংস্কারের অভাবে নদীই হারিয়ে যাচ্ছে।
×