ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

শীতের হাওয়া ও সাহিত্য

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮

শীতের হাওয়া ও সাহিত্য

ঋতুপ্রধান বাংলাদেশে সাহিত্যচর্চায়ও ছয়টি ঋতুর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যদিও সব ঋতুর প্রভাব বা বৈশিষ্ট্য সমানভাবে আমাদের চোখে পড়ে না। তবে বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, বসন্ত, শীতের অনুষঙ্গ ঘুরেফিরে এসেছে বহুকাল ধরে। মানুষ স্বভাবতই প্রকৃতি দ্বারা প্রভাবিত। প্রকৃতি আবার ঋতু দ্বারা প্রভাবিত। ফলে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। তাই মানুষের গড়া সাহিত্যে প্রকৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অর্থাৎ সাহিত্য প্রকৃতির মূল কেন্দ্রবিন্দু। যুগ যুগ ধরে কবি-লেখকরা যে কোন সাহিত্যকর্মে সময়ের উপস্থিতিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রাকৃতজগত সকল কালের সকল স্থানের সকল তথ্য নিয়ে, সাহিত্যজগত সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষের কল্পনাপ্রবণ মন নিয়ে। তাই প্রতি ঋতুর শিক্ষা প্রতি ঋতুতে নিতে হবে।’ একটি জাতির সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধশালী করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা থাকে সাহিত্যের। সে জন্যই হয়তো পিয়েত্রো আরোতিনো বলেছেন, ‘এসো শীতকে ভালোবাসি, কেন না প্রতিভাবানদের কাছে এটাই বসন্তকাল।’ ঋতু বা কালের মতোই বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত বাংলা সাহিত্য। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কল্পকাহিনী, সিনেমা, নাটক, মঞ্চনাটক, যাত্রাপালা, গানসহ সব শাখাতেই ঋতুর উপস্থিতি যেন অনিবার্য। কাহিনী নির্মাণে, স্থান বা প্রকৃতি উপস্থাপনে ঋতুর প্রসঙ্গ আপনাআপনিই এসে যায়। সেই ঋতুর বর্ণনায় শীতের প্রসঙ্গও অতিক্রম করার সুযোগ নেই। সঙ্গত কারণেই বাংলা সাহিত্যে শীতের উপস্থিতি পাই হাড়কাঁপানোর মতো বা শীতল আবেশে। সাহিত্যে শীতের উপাদান হিসেবে শীতল হাওয়া, কুয়াশা, শিশির, খেজুর রস, অতিথি পাখি, প্রজাপতির দেখা মেলে। কবি-লেখকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শীতকালও যেন সাহিত্যের রসদ জোগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই কাগজে শব্দের আঁচড়ে ফুটে ওঠে এ ঋতুর সুবিধা এবং অসুবিধা। যদিও রসনাবিলাসী বাঙালীর মূল সংস্কৃতির বিরাট জায়গাজুড়ে শীতের পিঠা-পুলির ঐতিহ্য ধরা দেয় আপন মহিমায়। সব দেশের প্রকৃতি এক না হলেও বিশ্বের অনেক দেশেই শীতের আবির্ভাব চোখে পড়ে। তাই বিশ্বসাহিত্যেও শীতের পরশ পাওয়া যায়। পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের বিশাল অংশজুড়েও শীতের অবস্থান। বাংলা সাহিত্যে প্রাচীনকালের ‘চর্যাপদ’ থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের অতি আধুনিক সঙ্গীত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে শীত। কেননা পৌষের ফসল কাটার সময় গানের কথায় শোনা যায়, ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে/ আয়রে চলে আয়।/ আয় আয় ডালা যে তোর ভরেছে/ আজ পাকা ফসলে।’ এরকম বহু গানের সন্ধান পাওয়া যাবে শীতকে ঘিরে। শীতকে ঘিরে গ্রামীণ আয়োজনও উঠে আসে বাংলা সাহিত্যে। মানুষের জীবনযাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপ যদি সাহিত্যে উঠে আসে, তাহলে শীত কোনভাবেই বাদ পড়ার মতো নয়। অন্যান্য ঋতুর মতোই তা আলোচিত হয়ে ওঠে। যদিও প্রাচীনকাল থেকেই শীত মানুষের চর্চিত বিষয়। তখন অন্ধকার বা শীতকে মানুষ তুলনা করতো মৃত্যুর সঙ্গে। তবে বাংলায় শীতকে তুলনা করা হতো থুত্থুুরে বুড়ির সঙ্গে। প্রাচীন ভারতের উপকথায়Ñ ব্রহ্মা জগত সৃষ্টির সময় আলো আর অন্ধকারকে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন। আলোকে দেবতার জন্য আর অন্ধকারকে অসুরদের জন্য নির্ধারণ করলেন। তখন থেকেই শীতকে তুলনা করা হয় অন্ধকারের সঙ্গে। গ্রিক পুরাণে শীতের দেবীর নাম পাওয়া যায় ‘অর্শিয়া’। তিনি ছিলেন মর্ত্যরে মানবী। বাবা ইরেকথিয়াস ছিলেন এথেন্সের শাসক। রাজকুমারী অর্শিয়া ইলোসাস নদীর তীরে হাঁটছিলেন। এ সময় দখিনা বাতাসের দেবতা বোহেঁস প্রথম দেখাতেই তার প্রেমে পড়েন। ফলে তিনি জোর করে নিয়ে গেলেন ইগগ্রোনাস নদীর তীরে স্পার্ডিয়ন পাহাড়ে। সেখানে তাকে মেঘের আড়ালে রেখে ধর্ষণ করেন। অর্শিয়া দুই মেয়ে ও দুই ছেলের মা হলেন। মেয়ের নাম চিউনি ও ক্লিওপেট্রা আর দুই বায়ু সন্তান ক্লাসিয়াস ও জেথাস। ছেলেগুলোই পরে আরাগোন্সের সঙ্গে বিভিন্ন অভিযানে বের হন। পরে অর্শিয়াকেই দেবরাজ জিউস পাহাড়ি ঠা-া বাতাসের দেবী বানিয়ে দেন। বলা হয়, পারস্য যুদ্ধে তিনি শীতল হাওয়া, কুয়াশা এবং তুষার দিয়ে অনেক জাহাজ ধ্বংস করেন। শীত প্রসঙ্গে ঋতুর দেবী ডেমিটারের কথা না বললেও হয় না। তার মেয়ের নাম প্রেসপোন। একদিন অন্ধকারের দেবতা হেডেস বনের মধ্যে প্রসপোনকে পশুপাখির সঙ্গে খেলা করতে দেখে মুগ্ধ হন। এরপর প্রসপোনকে তুলে নিয়ে যান অন্ধকারের দুনিয়ায়। প্রসপোন ছিল জিউসের মেয়ে, সেই হিসেবে হেডেসের ভাতিজি। কিন্তু হেডেস সে সব আমলে নিতে নারাজ। আর জিউস প্রচ- রাগান্বিত হলেন। কিন্তু অন্ধকার জগতে তিনি প্রবেশের অনুমতি পেলেন না। এদিকে ডেমিটার প্রসপোনের কান্না প্রায়ই শুনতে পেতেন। তবে কখনই খুঁজে পাননি। ডেমিটার কাতর হয়ে পড়লেন। ফলে পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। মানুষ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলো। তারা প্রচ- শীত ও তুষারের সম্মুখীন হলো। শীতে নদীর পানি সব বরফ হয়ে গেল। একদিন হঠাৎ অ্যাপোলো যখন অন্ধকার জগতের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি প্রসপোনকে দেখতে পান। তিনি জিউসকে জানালে স্বর্গের বার্তাবাহক হারমেসকে পাঠান প্রসপোনকে নিয়ে আসতে। কিন্তু প্রসপোন তখন ছয়টি মৃত্যুবীজ খেয়ে ফেলেছিলেন। ফলে সে প্রতি ছয় মাস পরপর অন্ধকার জগত থেকে বের হয়ে আসতে পারতেন। না হলে তাকে বন্দী হয়ে থাকতে হতো অন্ধকার জগতে। যে ছয় মাস প্রসপোন ডেমিটারের কাছে থাকত সে সময় পৃথিবী শস্য আর ফুলে সুন্দর হয়ে যেত। যা হলো গ্রীষ্ম ও বসন্তকাল। আর যখনই প্রসপোন অন্ধকার জগতে ফিরে যেতেন, শুরু হতো শীতকাল। এদিকে পার্সিয়ান উপকথায়Ñ মিথরা হলো অন্ধকারের দেবী। প্রাচীনকালে মিথরাকে ধরা হতো অন্ধকারের শক্তিশালী ও ক্ষমতাশালী ঈশ্বরী হিসেবে। সূর্যের দেবতা আহুরামাজিদা আর উর্বরতা ও জলের দেবী আনাহিতার সঙ্গে মিথরাকেও পরম পূজনীয় মানা হতো। পার্সিয়ান দেবী জোকাসথেরিয়ান ধর্মমতে অন্ধকারকে শাসন করে মাঝে মাঝে আঁধারের বুকে শীতল নৃত্য প্রদর্শন করে মানুষকে তার কথা জানান দেন। এজন্য অনেকে মিথরাকে শীতের দেবী হিসেবেও উল্লেখ করেন। এভাবেই প্রাচীনকাল থেকে শীত ও অন্ধকার নিয়ে রচিত হচ্ছে সাহিত্য। তবে অন্ধকার ও শীতের রাতের প্রতি মানুষের ভয়াবহ অনুরাগ ও রহস্যময়তা নিয়ে তৈরি পুরাণে শীতকে দেখানো হয়েছে ভয়াবহ দুর্যোগ হিসেবে। আর মানুষও সেই দুর্যোগ মোকাবেলা করে চলেছে সাহসের সঙ্গে। প্রাচীনকাল ছেড়ে মধ্য যুগে এলেও শীতের ছোঁয়া পাই মঙ্গলকাব্যে। অধিকাংশ মঙ্গলকাব্যে নায়িকাদের বারো মাসের দুঃখ বর্ণনায় শীতের আবির্ভাব ঘটে। যদিও শীত এখানে আনন্দের চেয়ে অনেক বেশি বেদনাই নিয়ে আসে। কেননা শীত সবসময়ই মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তদের জন্য অভিশাপই বটে। তাই তো বাঙালীর হাজার বছরের দুঃখের কথা বলেন ফুল্লরা- ‘কার্ত্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ। যগজনে করে শীত- নিবারণ বাস নিযুক্ত করিল বিধি সভার কাপড়। অভাগী ফুল্লরা পরে হরিণের ছড়’ (চ-ীমঙ্গল কাব্য : মুকুন্দরাম চক্রবর্তী) শীত নিম্নবর্গের অসহায় মানুষের জীবনে চরম দুঃখ নিয়ে আসে। বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে প্রচলিত আছে যে, মাঘ মাসে ক্ষেত থেকে শাক তুললে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়। মধ্যযুগের বাংলা প্রণয়োপাখ্যানেও শীতের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সেখানেও শীত নায়ক বা নায়িকার বারো মাসের দুঃখ বর্ণনার অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে। দৌলত উজির বাহরাম খানের ‘লায়লী-মজনু’ কাব্যে- ‘এ সুন্দরী দেখ বিরহীর অবশেষ।/প্রবল ষট্্ ঋতু নাথ বিচ্ছেদ/সরোরুহ ভেল মলিন।/দীরঘ যামিনী দিবস ভএ ক্ষীণী/কাপন তপন তুহার।’ (লায়লী-মজনু : দৌলত উজির বাহরাম খান) প্রাচীন ও মধ্যযুগের পর আধুনিকতার শুরু হলে কবিতার পাশাপাশি গদ্যেও শীতের প্রকাশ বা বিকাশ ঘটতে থাকে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে শীত। দীর্ঘ নয় মাসের মধ্যে দুই মাসই যুদ্ধ করতে হয়েছে শীতকে উপেক্ষা করে। বিজয়ও অর্জিত হয়েছে শীতের মধ্যেই। তাই মুক্তিযুদ্ধের গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটকে একাধিকবার উঠে এসেছে শীতের উষ্ণতা বা বৈপরিত্য। ফলে শীতের প্রভাব বাঙালী জাতিসত্তার সঙ্গে মিশে আছে। আধুনিক বাংলা উপন্যাসেও শীতের উপস্থিতি রয়েছে। সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসে শীতের বর্ণনা এরকমÑ ‘শীতের উজ্জ্বল জ্যোৎস্না রাত, তখনো কুয়াশা নামেনি। বাঁশঝাড়ে তাই অন্ধকারটা তেমন জমজমাট নয়। সেখানে আলো অন্ধকারের মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি যুবতী নারীর মৃতদেহ দেখতে পায়।’ শুধু চাঁদের অমাবস্যাই নয়; এমন বহু উপন্যাস, গল্প, নাটকে প্রসঙ্গক্রমে শীত এসেছে বহুবার। বিষবৃক্ষ, পথের পাঁচালী, পদ্মা নদীর মাঝি প্রভৃতি কথাসাহিত্যেও বাঙালীর ঋতুবৈচিত্র্যের স্বাদ এক ভিন্ন আনন্দকে ছড়িয়ে দিয়ে যায়। আর এই স্বাদ শুধু জীবনযাপনে নয়, সব কিছুকেই ছুঁয়ে যায় নিবিড়ভাবে। যেন বাস্তব জীবনের মতো হেমন্তের নতুন ধানের সুগন্ধি আর কাঁঠালিচাপার গাছের ছায়ায় শীতের কিশোর বকুল ফুলের মালা হাতে দাঁড়ায়। প্রকৃতির রূপটিও যেন সেই কিশোরের বুক পকেটে ভাঁজ করা রুমালের মতোই। কথাসাহিত্যের পাশাপাশি আধুনিক কবিতায় শীত যেন অধিক হারে মূর্ত হয়ে ওঠে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘শীত বন্দনা’ কবিতায় বলেন, ‘ওগো মোর লীলা সাথী অতীত বরষার/ আজিকে শীতের রাতে নব অভিসার।’ নজরুলের কবিতায় শীতের বহিরাঙ্গিক রূপে লেগেছে প্রসন্নতার আলপনা। শীতের পাতাঝরা রিক্ততার মধ্যেও নজরুল খুঁজে পান এক ধরনের আনন্দ, নতুনের আবাহন গীতÑ ‘পউষ এলো গো!/পউষ এলো অশ্রু-পাথার হিম-পারাবার পারায়ে।/ঐ যে এলো গো-/কুজ্ঝটিকার ঘোমটা পরা দিগন্তরে দাঁড়ায়ে।/সে এলো আর পাতায় পাতায় হায়/বিদায়-ব্যথা যায় গো কেঁদে যায়,/অস্ত-বধূ (আ-হা) মলিন চোখে চায়।/পথ-চাওয়া দীপ সন্ধ্যা-তারায় হারায়ে/পউষ এলো গো-/এক বছরের শ্রান্তি পথের, কালের আয়ু ক্ষয়,/পাকা ধানের বিদায়-ঋতু নতুন আসার ভয়।’ ইংরেজ কবি রাফ বার্ন শীতকালে মাছ শিকারের কথা বলেছেন। মাইকেল রিয়ান বলেন, ‘শীতকালে প্রেম এবং আলো পূর্ণতা পায়।’ কবি মার্ক ভেনভোল্ট শীতকালে নতুন করে শিক্ষা নেওয়ার, নতুন করে কল্পনা সাজানোর সময় বলে ভাবতে পছন্দ করতেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং জীবনানন্দ দাসদের কবিতায়ও শীতের আরাধনা বা মাধুর্য ফুটে ওঠে। আধুনিক বাংলা কবিতায় শীতের বহুমাত্রিক রূপ অঙ্কিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের হাতে। শীতের বহিরাঙ্গিক ছবি যেমন পাওয়া যায় তার রচনায়, তেমনি পাওয়া যায় দার্শনিক উপলব্ধি প্রকাশে শীতের অনুষঙ্গ। শীতের রূপ দেখা যায় তাঁর ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতায়। সেখানে মাঘ মাসের প্রবল শীতে মানুষ যখন কাঁপছে, তখন রাজমহিষী শীত নিবারণের জন্য দরিদ্র মানুষের সামান্য কুঁঁড়েঘরে আগুন জ্বালাতে কুণ্ঠিত হয় না। এ কবিতা কেবল রাজমহিষীর স্বেচ্ছাচারিতা প্রকাশ করে না, বরং প্রকাশ করে উচ্চবিত্ত মানুষ কর্তৃক নিম্নবর্গের মানুষকে শোষণ ও নির্যাতনের কথা। এভাবে রবীন্দ্রনাথ শীতের অনুষঙ্গে বহিরঙ্গের সঙ্গে মিলিয়ে দেন উপলব্ধির অন্তরঙ্গ অনুভূতিকে। বাংলাদেশের সাহিত্যে শীত মানেই এক ভিন্ন আয়োজন। শীতে ঝরে যায় প্রকৃতির সব আভরণ। গাছপালা হয়ে যায় পাতাশূন্য। শীতের এই বেশ কবি জসীমউদ্দীনের কাছে তপস্যারত ঋষির মতো মনে হয়- প্রকৃতি যেন ধ্যান করতে বসেছে তার সব আভরণ পরিত্যাগ করে, ‘সে কি ওই চরে দাঁড়ায়ে দেখিবে বরষার তরুগুলি,/শীতের তাপসী কারে বা সরিছে আভরণ গার খুলি?/হয়তো দেখিবে, হয় দেখিবে না, কাল সে আসিবে চরে,/এপারে আমার ভাঙা ঘরখানি, আমি থাকি সেই ঘরে।’ (কাল সে আসিবে)। শীতের উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ কুয়াশা। শীতের কুয়াশা কবির কাছে সংশয়চেতনা প্রকাশের অব্যর্থ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় পাওয়া যায় এমন ভাবনার প্রকাশ- ‘ঘোচে না সংশয়/তোমারে নেহারি কি না প্রসারিত মাঠে/প্রত্যুষের কুয়াশায় ঢাকা খেয়াঘাটে/গৃহগামী কৃষকেরা যাবে সন্ধ্যাবেলা/জটলা পাকায়’ (অনিকেত)। বুদ্ধদেব বসু শীত-অনুষঙ্গকে ব্যবহার করেছেন দার্শনিক উপলব্ধির উপাদান-উৎস হিসেবে। শীতের রিক্ততা কবির কাছে প্রত্যাশিত, কারণ তা মানুষকে সংসার থেকে দিতে পারে আকাক্সিক্ষত মুক্তি। শীত কবির কাছে মৃত্যুর প্রতিমসত্তায় উপস্থিত হয়েছেÑ ‘আমি যদি মরে যেতে পারতুম এই শীতে, গাছ যেমন মরে যায়, সাপ যেমন মরে থাকে সমস্ত দীর্ঘ শীত ভ’রে।’ শীত কখনও কখনও বুদ্ধদেব বসুর চিত্ততলে জন্ম দেয় নিঃসঙ্গতাবোধ। তিনি মনে করেন, শীত মানুষের চেতনায় যে অনন্বয় ও নির্বেদ সৃষ্টি করে, পরিণতিতে যা জন্ম দেয় মহার্ঘ্য নিঃসঙ্গতা। তা-ই কবির কাছে সৃষ্টিশীলতার আদি উৎস, প্রতœ প্রেরণা। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কাছে শীত এসেছে দুঃখের বার্তা নিয়ে। দরিদ্র মানুষের কাছে শীতের ভয়াবহতা কবিকে চিন্তিত করেছে। তাই নিম্নবর্গের মানুষের জন্য সূর্যের কাছে তার প্রার্থনা, সূর্য যেন শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাদের উত্তাপ দেয়। শীতকালে খেজুর গাছ কেটে রস-সংগ্রহ বাংলার এক চিরচেনা দৃশ্য। তাই সব কবির কাছেই খেজুরের রস নয়, বরং গাছটার বেদনাই বড় হয়ে উঠেছে। শীত আর শীতের অনুষঙ্গ কিংবা শীতের পাখি কবির চেতনায় জন্ম দেয় লিবিডোসজল ভাবনা। আকাক্সক্ষার নারীকে কবিরা শীত-অনুষঙ্গ দিয়েই আলিঙ্গন করেন। শীতের উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ আগুন জ্বেলে সম্মিলিতভাবে উত্তপ্ত হওয়া- এ দৃশ্য গ্রামবাংলায় অতি পরিচিত। শীতের এই অনুষঙ্গ কবিরা মানুষের সঙ্গে মানুষের পরস্পর বিচ্ছিন্নতার সূত্রে চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন। কেবল বিশেষ কোন ভাব-প্রকাশের জন্যই নয়, শীত ও তার নানাবিধ অনুষঙ্গ কখনও কখনও কবিরা ব্যবহার করেছেন অলঙ্কার সৃষ্টির উপকরণ হিসেবেও। কখনও উপমা, কখনও চিত্রকল্প সৃষ্টিতে শীত ঋতু পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিরহের বেদনায় কবির হৃদয় শূন্য, উদাস বাউলের মতো রিক্ত তার মনের আকাশ, তার ঘর-দুয়ার। এই চেতনাকে কবি রিক্ত শীতের পাতা-ঝরা প্রাণসুপ্ত বৃক্ষের রূপকে চিত্রিত করেছেন। সেই যাত্রায় পিছিয়ে নেই সমকালীন কবিরাও। সদ্যপ্রয়াত শহীদ কাদরী তার এই শীতে কবিতায় বলেছেন- ‘শীতার্ত নিঃস্বতায় কিছুই বাঁচে না যেন বেঁচে থাকা ছাড়া, বসন্তের শিথিল স্তন নিঃশেষে পান করে নিঃস্বার্থ মাটি লতাগুল্ম গাছ কাক শালিক চড়ুই এমনকি অসহায় গর্তের দেয়ালের জীব...’ কবি বুলান্দ জাভীর ‘মিস হেরিটেজ’ কবিতায় কুয়াশার প্রসঙ্গ এনেছেন এভাবে- ‘বাকিংহাম প্যালেস এর বহুদূর বেষ্টনী ছুঁয়ে ছুঁয়ে/টাওয়ার ক্যাসেলের সংরক্ষিত কোহিনূর এর উজ্জ্বল প্রভা এড়িয়ে/বুঝতে চেয়েছি এই শহরের কোথাও তুমি আছো। আমি এই শহরের অবস্থানের সকল সময়/তুমি আমাকে কুয়াশার মতো বেষ্টন করে আছো।’ তবে সামগ্রিক বিচারে মনে হতে পারে- সাহিত্যের শাখাগুলোর মধ্যে কবিতায়ই মনে হয় শীতের প্রসঙ্গ বেশি। আসলে হয়তো সেটি না-ও হতে পারে আবার হতেও পারে। বিশাল এই সাহিত্য ভা-ারে কতকিছুই তো জমা হয়ে আছে। আমরা তার কতটুকুই আহরণ করতে পারি? তবে গল্পের প্লটে শীত আছে। গানের কথায় শীতের কাঁপন আছে। নাটকের দৃশ্যে শীতের পোশাক আছে। সে সবের দিকে আমাদের নজর হয়তো তীক্ষèভাবে পড়ে না। তাই আপাতদৃষ্টে কবিতায় শীতের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। মূল কথা হচ্ছেÑ যে শিল্পকর্মে মানুষ আছে, প্রকৃতি আছে; সেখানে শীতকাল প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে আসে। তবে শীতকে নিবেদন করে বিশেষ কবিতা যেমন লেখা হয়; তেমন গল্প-উপন্যাস হয়তো হচ্ছে না। বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা, লিটলম্যাগ কিংবা সাময়িকীতে শীতকাল এলে শীতের কবিতার জন্য বিশেষ সংখ্যা করতে দেখা যায়। এমনকি বসন্ত, শরৎ, হেমন্তের আয়োজন থাকে। কথাসাহিত্যে হয়তো সেটি সম্ভব হয়ে ওঠে না। কথাসাহিত্যে আমরা শীতের বর্ণনা পেতে পারি। গল্পের চরিত্রের পোশাকের বর্ণনায় প্রকৃতির অনুষঙ্গ চলে আসে। গল্প নির্মাণের স্বার্থেও শীতের প্রসঙ্গ এসে যায়। তবে দাগ কেটে কেটে সবিশেষ উল্লেখ করার মতো প্রসঙ্গ খুব বেশি একটা আছে বলে মনে হয় না। শীত প্রসঙ্গে সাহিত্যের আপাদমস্তক আলোচনা করতে গেলে অনেক উদ্ধৃতিই হয়তো দেওয়া সম্ভব। তবে সবিস্তারে তা বলারও প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কারণ শীত ও শীতের অনুষঙ্গ নিয়ে অনেকেই গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গান লিখেছেন। শীত আমাদের কবিদের রচনায় আসতে পারে বিভিন্ন বোধ ও অভিজ্ঞানের সৃষ্টি-উৎস হিসেবে। আবার লেখকের চোখে ধরা দিতে পারে ভিন্নরূপে। শীত বাঙালী কবি-সাহিত্যিকদের সৃষ্টিশীল চৈতন্য বিকাশে পালন করেছে দূরসঞ্চারী এবং বহুমাত্রিক ভূমিকা। তাই কামনা করছি- শীত আরও সমৃদ্ধ করুক বাংলা সাহিত্যকে।
×