ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

চা উৎপাদন বাড়াতে ১০ বছরের রোডম্যাপ ॥ দুটি পাতা একটি কুঁড়ি

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮

চা উৎপাদন বাড়াতে ১০ বছরের রোডম্যাপ ॥ দুটি পাতা একটি কুঁড়ি

এম শাহজাহান ॥ চায়ের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে দশ বছর মেয়াদী একটি পথ নক্সা তৈরি করা হয়েছে। আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ চায়ের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩০ মিলিয়ন কেজি। সরকার আশা করছে, উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও চা রফতানি করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি উত্তরবঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ চা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ‘বঙ্গবন্ধু’ চা ভবন করা হবে ঢাকায়। জাতির জনক এক সময় চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। চা শিল্প সম্প্রসারণ, উদ্যোক্তাদের আরও উদ্যোগী করা, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাবমূর্তি বাড়ানোসহ উত্তরবঙ্গে এ শিল্প খাত ছড়িয়ে দিতে ঢাকায় দুই দিনব্যাপী চা শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। চা বোর্ডের আয়োজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে এ শিল্পের পথ নক্সা বাস্তবায়নে রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরবেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে চা রফতানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। দেশীয় চায়ের গুণগত মান ভাল থাকায় বিদেশী ক্রেতাদের কাছে চায়ের চাহিদা ছিল বেশি। তখন এ দেশের রফতানি পণ্যের তালিকায়ও উপরের দিকেই ছিল চা। গত মৌসুমে দেশে চা উৎপাদনে সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে ৮০ মিলিয়ন কেজি উৎপাদন হয়েছে। গত পাঁচ বছরে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে ৪৫ লাখ টন। একই সময়ে দেশে চায়ের চাহিদা বেড়েছে ৮৮ লাখ টন। অর্থাৎ উৎপাদন দ্বিগুণ হারে দেশে চায়ের চাহিদা বাড়ছে। আর সেই কারণে চা রফতানি তলানিতে ঠেকেছে। শুধু তাই নয়, অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে এখন চা আমদানি করতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন দেশীয় চা শিল্পে যে সঙ্কট পড়েছে তা জাতীয় অর্থনীতিসহ এ শিল্প সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই উদ্বেগজনক। তাই চা বোর্ড ও সরকারকে চা শিল্প নিয়ে পরিকল্পিত উদ্যোগের পাশাপাশি চা গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতেও নজর দেয়া প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব শুভাশিষ বসু জনকণ্ঠকে বলেন, চা শিল্প সম্প্রসারণ ও উৎপাদন বাড়াতে দশ বছর মেয়াদী একটি পথ নক্সা তৈরি করা হয়েছে। এবার এই পথ নক্সা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছে সরকার। এবার চা প্রদর্শনী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিচ্ছেন। ওই সময় তিনি পথ নক্সা বাস্তবায়নে রূপরেখা ঘোষণা করবেন। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু চা ভবন করা হবে। শীঘ্রই এই ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে। এছাড়া উত্তরবঙ্গে চা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে গোটা উত্তরবঙ্গে ক্ষুদ্রায়তন চা আবাদ আশাব্যঞ্জক সাফল্য লাভ করেছে। জানা গেছে, অনুকূল আবহাওয়া এবং সরকারী নীতি সহায়তার কারণে গত কয়েক বছর ধরে চা উৎপাদন বেড়েছে। এছাড়া উৎপাদন বাড়াতে পাবর্ত্য অঞ্চলের পাশাপাশি সমতল ভূমিতে চা চাষের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। দেশের ১৭ জেলাকে ঘিরে চা চাষের একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে উচ্চ ফলনশীল ও আকর্ষণীয় গুণগতমানের ২০টি ক্লোন উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই)। চায়ের ক্লোন উদ্ভাবন ছাড়াও এ পর্যন্ত চার ধরনের বাই-ক্লোনাল ও এক প্রকারের পলিক্লোনাল বীজ উদ্ভাবন করেছে বিটিআরআই সংস্থাটি জার্মপ্লাজম সমৃদ্ধ জিন ব্যাংক স্থাপন করেছে ৫১৭টি। চা শিল্প উন্নয়নে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এর ফলে দেশে ধারাবাহিকভাবে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে। বাংলাদেশে চা শিল্প ॥ ব্রিটিশদের হাত ধরে ১৮২৪ সালে সিলেট অঞ্চলে প্রথম চা চাষ শুরু হয়। তবে ১৮৬০ সালে হবিগঞ্জের লালচাঁন্দ চা বাগান ও মৌলভীবাজারের মির্তিঙ্গা চা বাগানে প্রথম চায়ের বাণিজ্যিক চাষ শুরু করেন উদ্যোক্তারা। ২০০০ সালে উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়েও ছোট আঙ্গিকে চায়ের চাষ শুরু হয়। বাংলাদেশে চা শিল্পের বিকাশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৫৭-৫৮ সময়কালে তিনি বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। সে সময়ে চা শিল্পে মাঠ ও কারখানা উন্নয়ন এবং শ্রম কল্যাণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এ কারণে জাতির জনকের নামে এবার ঢাকায় বঙ্গবন্ধু চা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিগত তিন দশক ধরে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কিন্তু উৎপাদন বাড়েনি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার রফতানি বাড়াতে পাট এবং চা শিল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে। ইতোমধ্যে পাটের জিন আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশ। চায়েরও নতুন ক্লোন আবিষ্কার হয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে চা শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম এবং সুদূঢ় প্রসারী। জিডিপিতে চা খাতের অবদান শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ। বাংলাদেশের ১৬২টি বাগানের ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে ২০১৫ সালে ৬৭ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে। চা বোর্ডের তথ্য মতে, ১৯৯০ সালে চায়ের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৮৩ লাখ ৬০ হাজার কেজি এবং অভ্যন্তরীণ ভোগ ছিল ১ কোটি ৪২ লাখ ১০ হাজার কেজি। আর ২০১৫ সালে চা উৎপাদন ছিল ৬ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার কেজি এবং অভ্যন্তরীণ ভোগ ছিল ৬ কোটি ৫০ লাখ কেজি। এদিকে চা কোম্পানির মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদের তথ্যমতে, ২০০৯-১৩ পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেশে ২ কোটি ৮৭ লাখ ৯৩ হাজার কেজি চা আমদানি হয়েছে। এছাড়া সিলেটের মালনিছড়া চা-বাগানের মাধ্যমেও ১৮৫৪ সালে দেশে চা চাষ শুরু হয়। চা বোর্ডের হিসাবে বিশ্বে চা উৎপাদনের পরিমাণ ৪৬২ কোটি ৫০ লাখ কেজি। এর মধ্যে চীন একাই উৎপাদন করে ১৭৯ কোটি কেজি। এরপর ভারত ১১২ কোটি ৬০ লাখ, কেনিয়া ৩৭ কোটি এবং শ্রীলঙ্কা ৩২ কোটি ৮০ লাখ কেজি চা উৎপাদন করে। তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, জাপান ও আর্জেন্টিনার পর বাংলাদেশের অবস্থান দশম। চা উৎপাদন করে যাতে ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায় সে বিষয়ে তাগিদ দিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ ও মোঃ জসিম উদ্দিন এ শিল্প খাত উন্নয়নে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। একই সঙ্গে যেসব কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান চা বাগানগুলো লিজ নিয়েছে তাদেরও উৎপাদন বাড়ানোর দিকে সর্বোচ্চ নজর দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। উত্তরবঙ্গে হচ্ছে চা গবেষণা ইনস্টিটিউট ॥ বাংলাদেশে চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান কার্যালয়টি ‘চায়ের রাজ্য’ শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত। গবেষণার মাধ্যমে উন্নতর প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগের ধারাবাহিকতার লক্ষ্যেই ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিটিআরআই। শুরু থেকেই ইনস্টিটিউটটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ চা বোর্ডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। এ ইনস্টিটিউটের বর্তমানে ৩টি পূর্ণাঙ্গ ও একটি নতুন সৃষ্ট উপকেন্দ্র রয়েছে। এবার উত্তরবঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট করা হবে। এছাড়া সমগ্র বাংলাদেশে চা আবাদীর সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে ১৭ জেলা বিশেষ করে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারি, দিনাজপুর, লালমণিরহাট, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইলের মধুপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলায় মোট ১ লাখ ১ হাজার ৭২ হেক্টর ক্ষুদ্রায়তনের চাষযোগ্য জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। গত পঁয়তাল্লিশ বছরে আবাদী জমি ৪২ দশমিক ৬ হাজার হেক্টর থেকে বেড়ে ৬০ হাজার হেক্টর হয়েছে। এদিকে, এ শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, চা শিল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে না। তীব্র আর্থিক সঙ্কটের সম্মুখীন এ শিল্পটি। বিদ্যমান ব্যাংক ঋণের সুদের হার এত বেশি যে বিনিয়োগের জন্য ঋণের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করা উৎপাদনকারীদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া চা বাগানের জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ রয়েছে, চা কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহে সমস্যা এ শিল্পের উন্নয়নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদের পক্ষ থেকে বিদেশ থেকে নিম্ন মানের চা আমদানি বন্ধ বা উচ্চ শুল্কহার আরোপ, চা উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা প্রদানের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
×