ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বকাপকথন- ১

মন্টিভিডিও টু মস্কো

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১০ জানুয়ারি ২০১৮

মন্টিভিডিও টু মস্কো

২১তম বিশ্বকাপ ফুটবলের আর খুব বেশি একটা দেরি নেই। বাকি আছে পাঁচ মাসের মতো। দিনের হিসাবে দেড় শ’ দিনেরও কম। ২০১৮ সালের ১৪ জুন শুরু হয়ে এ প্রতিযোগিতা শেষ হবে ১৫ জুলাই। ফলে শুরু হয়ে গেছে বিশ্বকাপ ফুটবলের ‘কাউন্ট ডাউন’ বা দিন গোনা। সঙ্গে চলছে জম্পেস আলোচনাও। এরই মধ্যে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বিশ্বকাপের আলোচনার ঝড় উঠতে শুরু করেছে। আর তাই আমরাও বিশ্বকাপ নিয়ে সরস আলোচনায় মেতে উঠব। আলোচনা করব বিশ্বকাপের আদ্যোপ্রান্ত। এবারের ২১তম বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসছে রাশিয়ায়। ২১তম বিশ্বকাপে ৩২টি দল অংশ নেবে। কোন ৩২টি দল ২১তম বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেবে সেটাও এখন সবার জানা হয়ে গেছে। রাশিয়ার ১২টি স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ৬৪টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। ১৪ জুন মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক রাশিয়ার বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এশিয়ার প্রতিনিধি সৌদি আরব। প্রতিযোগিতার দুই ফাইনালিস্ট শিরোপা জয়ের লড়াইয়ে ১৫ জুলাই একই মাঠে নামবে। বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার জন্য ফিফার ২১১ সদস্যের মধ্যে অনেক আগে থেকেই বাছাই পর্ব শুরু হয়ে গেছে জোর লড়াই। বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিশ্বকাপের চূড়ান্তপর্বে নিয়মিত অংশ নিলেও এ পর্যন্ত ফুটবলের বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের দেয়াল টপকে চূড়ান্তপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। সার্ক দেশগুলোর মধ্য থেকে পাঁচটি দল ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান ক্রিকেটের বিশ্বকাপে খেললেও, শুধু বাংলাদেশ কেন- সার্কের কোন দল এ পর্যন্ত ফুটবলের চূড়ান্তপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। কবে পারবে সেটাও বলা কঠিন। ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আসর বসে উরুগুয়েতে। মন্টিভিডিওতে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। মন্টিভিডিও থেকে মস্কো। বিশ্বকাপ ফুটবলের ৮৮ বছরের পথচলা নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক আয়োজন ‘বিশ্বকাপকথন’। লিখেছেন... প্রথিতযশা কবি, কথাসাহিত্যিক ও ক্রীড়ালেখক সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ ফুটবল : যেখান থেকে শুরু বাংলায় একটা বিতর্ক অনাদিকাল থেকে চলে আসছে- ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’। এটা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক হলেও ফুটবল আগে না বিশ্বকাপ আগে তা নিয়ে বিতর্কের এতটুকু অবকাশ নেই। অবশ্যই ফুটবল আগে। ফুটবলের জন্ম হয়েছিল বলেই বিশ্বকাপ ফুটবলের সূচনা। বিশ্বকাপ শুরু মানেই দুনিয়াজুড়ে উন্মাদনা আর মাতামাতি। বিশ্বকাপ এলেই তামাম ফুটবল দুনিয়া আক্রান্ত হয়ে পড়ে ‘ফুটবল জ্বরে’। কী ছেলে কী মেয়ে, দুধের বাচ্চা থেকে নব্বই বছরের বুড়োবুড়ি; সবাই মেতে ওঠে বিশ্বকাপ নিয়ে। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে এত ক্রেজি ক্রীড়া উৎসব আর নেই। বলা যায়, অলিম্পিকের চেয়েও বিশ্বকাপের ব্যাপকতা অনেক বেশি। বিশ্বকাপ এলেই গোটা ফুটবল দুনিয়া ভাগ হয়ে যায় ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি বা স্পেন অথবা অন্যদলের সাপোর্টারে। সেই বিশ্বকাপ ফুটবলের ২১তম আসর শুরু হতে খুব বেশি দেরি নেই। বিশ্বকাপ নিয়ে কথকতা শুরুর আগে ফুটবল নিয়ে একটা ছোট্ট আলোচনা করা যেতেই পারে। কেননা বিশ্বকাপ জানার আগে ফুটবলকে জানা দরকার। ফুটবলের উৎপত্তি নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে খোদ ফুটবল গবেষকদের মধ্যেই। কেউ বলেন চীনে, কেউ বলেন জাপানে ফুটবলের উৎপত্তি। সে চীন হোক আর জাপানই হোক সেটা আজকের বিবেচ্য বিষয় নয়। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘জন্ম হোক যথা-তথা, কর্ম হোক ভাল’। ফুটবলের জন্মের কাসুন্দি না ঘেটে ফুটবল আজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে সেদিকে তাকানোই ভাল। আর ফুটবলকে আজকের এই শিখর চূড়ায় পৌঁছে দেয়ার নেপথ্য কারিগর হচ্ছে ইংরেজরা। ফুটবলের জন্ম নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তার লালন-পালন ও বেড়ে ওঠা নিয়ে কারও মনে এতটুকু সংশয় নেই। আজকের এই আধুনিক ফুটবলের জনক, পরিচর্যাকারী তথা ফুটবলকে বিশ্বায়ন করার সিংহভাগ কৃতিত্ব ইংরেজদের। বৃটিশ শাসন সম্প্রসারণের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রসারিত হতে থাকে ফুটবলের ব্যাপিত ও পরিধি। ইংরেজদের হাত ধরেই ফুটবল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করে। কবে কখন কোথায় কে প্রথম ফুটবলে লাথি মারেন সে ইতিহাস আজ কালের অতলে বিলীন। তবে অনেকে হয়তো জানেন না প্রথম যে বলটিতে লাথি মারা হয় সেটি আজকের মতো এত দামী ফুটবল ছিল না। সেটি ছিল চামড়ায় মোড়ানো একটি বাঁশের গোলক। সেই বাঁশের গোলকের সংস্করণ হতে হতে আজকের এই সুদৃশ্য দামী বলে রূপান্তরিত হয়েছে। ফুটবল নিয়ে রয়েছে অনেক কথা, অনেক কল্পকাহিনী। প্রাচীন যুগে ফুটবল খেলার কোন নিয়ম-কানুন ছিল না। মেক্সিকোতে ফুটবলের গোল হতো সুউচ্চে বাঁধা গোল বলয়ের মধ্যে দিয়ে বল পাঠাতে পারলে। পশ্চিমা দেশে আরও এক রকমের গোল দেয়ার কথা জানা যায়। মাঠের দু’দিকে দু’খানা লম্বা কাপড় টাঙ্গানো থাকত, আর সে কাপড়ের গোলাকার ছিদ্র দিয়ে বল ঢোকাতে পারলে গোল হতো। তখন ফুটবল মাঠের নির্দিষ্ট কোন আয়তন ছিল না। মাইলের পর মাইল জুড়ে ফুটবল মাঠ। আর খেলোয়াড়ের সংখ্যাও হাজার হাজার। কোন বাঁধাধরা সংখ্যা ছিল না। ফলে যার যখন ইচ্ছে হতো আবার খেলার ইচ্ছে না হলে চলে যেত। না ছিল কোন রেফারি, না ছিল কোন লাইন্সম্যান। মাসের পর মাস ফুটবল খেলা চলতে থাকত। তখন এ খেলার নাম ছিল ‘মিলিস’। তবে এই নিয়মেরও বদল হতে থাকে। কোন নিয়ম-কানুন না থাকায় ফুটবলে অনেক অঘটনও ঘটতে দেখা যায়। প্রাণহানিরও আশঙ্কা কম ছিল না। এ গণ খেলাটি তখন ছিল সাংঘাতিক বিপজ্জনক। তবে দিন বললের সঙ্গে সঙ্গে ফুটবলও বাঁধা পড়তে থাকে আইনের বাঁধনে। ফলশ্রুতিতে ফুটবল পরিণত হতে থাকে একটি সুশৃঙ্খল ও সভ্য খেলায়। মধ্যযুগে ইউরোপে ফুটবল এতটাই মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল যে, বিশেষ করে যুব সম্প্রদায় ফুটবল ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারত না। নাওয়া-খাওয়া ভুলে সবাই ফুটবল নিয়ে মেতে থাকত। সেনা দলে লোক পাওয়া যাচ্ছিল না। সবাই ফুটবলে মাতোয়ারা। ফলে রোম স¤্রাট আইন করে ‘ফুটবল খেলা নিষিদ্ধ’ করলেন। তবে তাতেও তেমন একটা কাজ হলো না। পুলিশের চোখ এড়িয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে, গভীর জঙ্গলে; নিভৃতে ফুটবল খেলা চলতে থাকল। একবার নয়, একাধিকবার ফুটবলকে রাজন্যবর্গের রোষাণলে পড়তে হয়েছে। তারপরও ফুটবলের অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। ফুটবল এগিয়ে চলেছে সমহিমায়। আর তাই ফুটবলের পতাকাতলে আজ দু’শোরও বেশি দেশ সমবেত। ষোল শতকের শেষ দিকে ফুটবলের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার হতে শুরু করে। আর তারই ফলশ্রুতিতে সতের শতকের গোড়ার দিকে ফুটবলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল থেকে অবমুক্ত হবার পর ফুটবল খেলার প্রথম ছাড়পত্র পায় কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ১৮৮৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল (সকার ও রাগবি) এ্যাসোসিয়েশন গঠিত হবার পর ফুটবলের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। এ্যাসোসিয়েশন ফুটবলকে আইনের আওতায় নিয়ে আসে। ১৯৫০ সালে ফুটবলের প্রথম ক্লাব ‘শেফিল্ড ক্লাব’ গঠিত হয়। ১৯৬০ সালে সকার ও রাগবিকে আলাদা করায় সকার অর্থাৎ ফুটবল তার নিজস্ব স্বকীয়তায় এগিয়ে চলার সুযোগ পায়। ফুটবলের নিজস্ব এ্যাসোসিয়েশন গঠন ও খেলার উন্নয়ণের পথ প্রসস্ত হয়। ১৯৬০ সালের পর থেকে ফুটবল (সকার) ও রাগবি আলাদা খেলা হিসেবে পরিগণিত হয়। ১৮৬৩ সালে ইউরোপের ১১টি ফুটবল ক্লাবের কর্তারা একটি ‘ফুটবল এ্যাসোসিয়েশন’ গঠনের উদ্দেশে লন্ডনের হলবর্ণের ফ্রি মেনশন ট্যাভার্নে মিলিত হয়। ১৮৬৬ সালে ফুটবল এ্যাসোসিয়েশন ও শেফিল্ড ক্লাবের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। এর ফলে ফুটবলের আইন-কানুন আরও সম্প্রসারিত হয়। এরই ফলশ্রুতিতে ১৮৬৯ সালে গোল কিক্, ১৮৭২ সালে কর্ণার কিক্সহ বিভিন্ন রুলস প্রবর্তিত হয়। এ সময়ে ফুটবল ম্যাচে প্রথম রেফারি বাঁশি হাতে মাঠে নামেন। একই বছর ১৮৭২ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ফুটবলের পিতা ইংল্যান্ড ও প্রতিবেশী স্কটল্যান্ড। ইংল্যান্ডকে ‘ফুটবলের পিতা’ বলা হয় এ কারণে, ইংরেজরাই আধুনিক ফুটবলের ধারক বাহক ও বিশ্বায়ণকারী। ইংরেজ যোদ্ধা, নাবিক-বণিকেরা ফুটবলকে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে নিয়ে যায়। ছড়িয়ে দেয় সারা বিশ্বে। রাশিয়া, ডেনমার্ক, ইতালিসহ গোটা ইউরোপ তো বটেই, আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো তো বটেই এমন কী ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা তথা তামাম বিশ্বে ফুটবলকে ছড়িয়ে দেয় ইংরেজরা। এ জন্যে ইংল্যান্ডকে ‘ফুটবলের পিতা’ বলা হয়। আধুনিক ফুটবলের উন্নয়ণ ও প্রসারে যা যা করণীয় তার সবই করেছে বৃটিশরা। ফুটবলকে একটি সাধারণ খেলা থেকে বিশ্বের ‘এক নম্বর’ খেলায় পরিণত করার নেপথ্য কারিগর ইংরেজরাই। এশিয়া তথা ভারতবর্ষ এমন কী বাংলাদেশেও ফুটবল আসে সাহেবদের হাত ধরে। (চলবে) লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সংগঠক, সভাপতি, বাংলাদেশ লেখক পরিষদ ব-সধরষ : [email protected]
×