ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ

অদম্য মুনিবা

প্রকাশিত: ০৭:৩৪, ৯ জানুয়ারি ২০১৮

অদম্য মুনিবা

মুনিবা মাজারি একজন পাকিস্তানী মানবাধিকার কর্মী, চিত্র শিল্পী , টেলিভিশন উপস্থাপক। তিনি আয়রন লেডি হিসেবে সমধিক পরিচিত। ২০১১ সালে বিবিসির ‘১০০ সর্বাধিক অনুপ্রেরণামূলক নারী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং পরের বছর ফোর্বসের ‘আন্ডার থার্টি ইম্পেক্ট চ্যালেঞ্জ’-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০১৭ সালের ফোর্বসের ‘আন্ডার থার্টি ইম্পেক্ট চ্যালেঞ্জ’ স্থান করে নেন মুনিবা মাজারি। একুশ বছর বয়সে তিনি কার এক্সিডেন্টে তার শরীরের বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে যায়। তার বেঁচে থাকার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন ডাক্তাররা। ডাক্তারদের শত চেষ্টায় বেঁচে ওঠেন তিনি কিন্তু পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হয় তাকে। এর পর থেকেই শুরু হয় তার জীবন সংগ্রাম। হুইল চেয়ারে বসেই তিনি বিশ্বকে জয় করছে। তিনি প্রথম পাকিস্তানী নারী মডেল যে কিনা হুইল চেয়ারে বসে বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছেন ইচ্ছা-শক্তি থাকলে অসাধ্যকেও সাধন করা যায়। মুনিবার জন্ম পাকিস্তানের এক রক্ষণশীল পরিবারে। সেখানে তার বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটানোই ছিল প্রধান কাজ। বাবা-মায়ের আদেশে ১৮ বছর বয়সেই তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। তিনি বিয়ে নিয়ে অখুশি থাকার পরেও বাবা-মায়ের কথা ভেবে হাসি মুখে মেনে নেন সেই বিয়ে। বিয়ের দুই বছরের মাথায় ২০০৭ সালে মুনিবা তার বাড়িতে যাওয়ার পথে রোড এক্সিডেন্টে আক্রান্ত হন, মুনিবার স্বামী গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তখন তার স্বামী তাকে ফেলে গাড়ি থেকে বের হয়ে যান তাকে উদ্ধারের চেষ্টাও করেননি। সে সময় তিনি বুঝতে পারলেন তার শরীর কোনভাবেই নাড়াতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত উদ্ধারকারী দল গাড়ি কেটে তার থেকে তাকে বের করে আনেন। তখন তিনি সংজ্ঞা হিন অবস্থায় ছিলেন। তার হাত, কাঁধ, পাঁজর এবং কলার থেকে একাধিক ফ্র্যাকচারস হয়। একদিন ডাক্তাররা এসে তাকে বলেছিলেন যে, তার স্পাইনাল ইনজুরি এত যে তিনি আর কখনও হাঁটতে, ছবি আঁকাতে পারবেন না। এমনকি আর মাও হতে পারবেন না। হাসপাতালের বেডে তাকে প্রতিদিন নতুন নতুন দুঃসংবাদ শুনতে হতো। তখন প্রতিটি দিন সকাল হলে তাকে মৃত্যু যন্ত্রণা আঁকড়ে ধরত। মুনিবা ছবি আঁকতে ভালবাসতেন। আগে ছবি আঁকা ছিল তার প্রতিদিনের সঙ্গী। কিন্তু এক্সিডেন্টের পর প্রতিদিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে মনের ক্যানভাসে নতুন নতুন ছবি আঁকতেন। তিনি যখন শুনলেন তার স্বামী তার এ অবস্থা দেখে তাকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করেন। হাসপাতালের লম্বা সাদা করিডর তার ক্যানভাসে মিশে থাকত। মুনিবা ভাবলেন এভাবে চলতে থাকলে উনি আরও অন্ধকারের অতলে ডুবে যাবেন। তিনি আবার নিজেকে নিয়ে নতুনভাবে বাঁচার তাগিদে যাত্রা শুরু করলেন। সেই দিন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে মুনিবা নিজের জন্য বাঁচবেন। তিনি তার ভাইকে বললেন তার জন্য ক্যানভাস আর রং আনতে। তিনি এবার আঁকতে চান। প্রথমে তুলির আঁচরে তিনি যে ছবি আঁকেন তা হলো তার হসপিটালে বেডে থাকার ছবি। সবাই তার আঁকা ছবি দেখে বাহবা দিতে লাগল কিন্তু তার হাসপাতাল জীবনের করুণ কাহিনী জানতে চাইল না। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি নিজের জন্য বাঁচবেন। তিনি ভাবলেন অন্য কারও জন্য নিখুঁত হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাকে ভয়কে জয় করতে হবে। তখন তিনি তার ভয়গুলোকে একটি কাগজে লিপিবদ্ধ করলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলাম আমি আমার ভয়গুলোকে জয় করব। মালিবার কাছে সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার ছিল তার স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স। তিনি যখন জানলেন তার স্বামী আরেকটি বিয়ে করছেন তখন তিনি শুধু একটি এসএমএস করেন তার প্রাক্তন স্বামীর কাছে ‘আমি জেনে খুব খুশি হলাম তুমি আবার বিয়ে করছ তোমার জন্য অনেক শুভ কামনা।’ তার দ্বিতীয় ভয় ছিল তিনি কখনও মা হতে পারবেন না। তিনি ভাবলেন এই পৃথিবীতে অনেক বাচ্চা আছে যারা এতিম আছে যাদের কেউ নেই তাদের মাঝ থেকে যে কাউকেই তার বাচ্চা হিসেবে নিতেই পারেন তিনি। তার মতো করে গড়ে তোলেন তাকে। শিক্ষা দেবেন, মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। এর পর তিনি বিভিন্ন অনাথ আশ্রমে যোগাযোগ করতে লাগলেন। এর প্রায় দুই বছর পর তিনি অনাথ আশ্রম থেকে বাচ্চা নিলেন। ওই সময় অনাথ ছেলেটার দুই দিন বয়স ছিল আজ তার বয়স ছয় বছর। এই থেকে শুরু হলো তার নতুন করে বেড়ে ওঠার ইতিহাস। মুনিবা তার এক সাক্ষাতকারে বলেনÑ ‘যখন আপনি হুইল চেয়ারে থাকবেন, সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপার কি জানেন? মানুষ মনে করে যে, তারা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, কারণ সবাই মনে করে এই দুনিয়াতে নিখুঁত মানুষ সব কিছুর অংশীদার আর অক্ষম মানুষেরা সব কিছুর থেকে বঞ্চিত থাকবে তাই তাদের নিয়তি। এর পর থেকে আমি নিজেকে আরও বেশি করে তুলে ধরার চেষ্টা করি। সত্যি কথা বলতে আপনি যখন নিজের পথকে সঠিক ভেবে মেনে নেবেন তখন অন্যরা তা মেনে নেবে। নিজেকে নিজের আত্ম শক্তিতে বলিয়ান করতে হবে। ভাবতে হবে আমার প্ল্যান অনুযায়ী সব হবে। এই জীবনে সব কিছুর স্বাদ নিতে হবে। তবে সব কিছুর স্বাদ নেয়া এত সহজ নয়। কখনও নিজের ওপর দোষারোপ করবে না। জীবনে হাসি-কান্না থাকবে সেটাই স্বাভাবিক তার মাঝেই উঠে দাঁড়াতে হবে। বার বার বার্থ হলে ও চেষ্টা করে গেলে সফল হবে নিশ্চয়ই। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসকে এনজয় করতে হয়। কখন নিজের জীবিত থাকার অবস্থায় মরে গেলে চলবে না। সব সময় বিধাতার কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে বেঁচে থাকার জন্য। জীবনের প্রতিটা ক্ষণ বেঁচে থাকতে হবে নিজের মতো করে।
×