ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বই ॥ কালের ধ্বনির বিশেষ সংখ্যা নিজের আলো তবুও দিবাশশী

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ৫ জানুয়ারি ২০১৮

  বই ॥ কালের ধ্বনির বিশেষ সংখ্যা  নিজের আলো তবুও দিবাশশী

অপ্রদর্শিত, অনালোকিত আব্দুল কাদিরকে ধুলোমুক্ত করে আলোক সম্পাতে যুগের কাছে তুলে ধরার এক নান্দনিক প্রয়াস ‘কম চেনা বড় মানুষ আব্দুল কাদির’। স্বকালের ধ্বনিকে উচ্চকিত করে সমকালীন উপযোগিতাকে তুলে ধরাই ‘কালের ধ্বনির’ কাজ। কবি ও ছান্দসিক আব্দুল কাদির স্মারকগ্রন্থখানি যুগের সেই মহান ডাকের প্রতি উপযুক্ত সাড়া বলেই প্রতীয়মান। উনিশ্শো ছয় সালের পয়লা জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আড়াইসিধা গ্রামে জন্ম নেওয়া আব্দুল কাদির জন্ম হতেই এক ইঁদুর কপালে সত্তা যিনি অতি শৈশবেই মাতৃহারা হয়ে বঞ্চিত হন অপত্য স্নেহ হতে। সেই ধারা বহমান থাকে তাঁর শিক্ষাজীবনেও যিনি পাঁচটি বিষয়ে লেটার পেয়ে ম্যাট্রিকুলেশনের বৈতরণী পার হলেও কেবলমাত্র গণিত নেওয়ার কারণে স্নাতকের গন্ডী অতিক্রম করতে পারেননি। অথচ তাঁর মেধা ছিলো প্রখর এবং ছাত্র হিসেবে তিনি তুখোড়ই ছিলেন বলা যায়। শুধু যে গণিতই তাঁর উচ্চ শিক্ষায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা-ই নয়, তাঁর সাহিত্য বিষয়ে ও সম্পাদনার বিষয়ে অতি আসক্তি তাঁকে পাঠ্যবিমুখ করে তোলে। ফলে পর্যাপ্ত সময় ব্যয়িত না হওয়ার কারণে সনদধারী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মানদ-ে তিনি উচ্চ শিক্ষিতরূপে চিহ্নিত হতে পারেননি। ইঁদুর তার কপাল এতোটুকুই কেটেছে যে বড়ো মাপের সাহিত্যজন হয়েও তিনি আজ সাহিত্যের আড্ডায় অনাঘ্রাত, অনুচ্চারিত। আজ যারা কবি যশোপ্রার্থী ছন্দ তাদের দূর প্রতিবেশির মতো। আধুনিক গদ্য কবিতার তুমুল প্রভাবের কারণে আজকের কবির কাছে ছন্দ অস্পৃশ্য এবং সেকেলে হয়ে উঠেছে। অথচ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত খুব জোর দিয়ে বলেছিলেন ছন্দ স্বাচ্ছন্দ্যই কবিত্বের সবচেয়ে বড়ো অভিজ্ঞান। ছন্দের শুদ্ধ পাঠ আজকাল বিরল। এমনই এক ছন্দোক্রান্তির লগনে ছান্দসিক আব্দুল কাদিরকে স্মরণ ও তাঁর সাহিত্যিক জীবনের উপর উপযুুক্ত আলোক সম্পাত ‘কালের ধ্বনির’ এক মহৎ উদ্যোগ এ কথা অকুণ্ঠচিত্তে বলতেই হয়। কবির কালজয়ী প্রবন্ধ ভা-ার হতে ছন্দ বিষয়ক ‘বাঙলা ছন্দের বিশ্লেষণ’ এবং ‘বাঙলা ছন্দ ও নজরুল ইসলাম’ শীর্ষক অমর দুটি প্রবন্ধকে পুনপাঠ হেতু সচল করার যে সমকালশোভন প্রয়াস তাতে আজকের নবীন লিখিয়েদের জন্যে তা মহাপ্রসাদ বলেই বিবেচিত হবে। ছান্দসিক আব্দুল কাদিরের বাইরে কবি, সংগঠক ও সম্পাদক আব্দুল কাদিরকে পূর্ণাঙ্গ পরিস্ফুটনে ‘কালের ধ্বনি’র ‘কম চেনা বড় মানুষ’ শিরোনামটি যুৎসই ও দূরদর্শী হয়েছে বলেই প্রমিত। কবি আব্দুল কাদির একজন অলস কিংবা প্রচার-অন্তরালের মানুষ হিসেবেই পরিগণিত। নইলে উনিশ্শো তেত্রিশ এ দিলরুবাকে রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দিয়ে যিনি বাংলার কবিদের আসরে নিজের অধিকার ও আসন অসংশয়িত করে নিয়েছেন তিনি কেনই বা উনিশ্শো সাতষট্টিতে ‘উত্তর বসন্ত’ নিয়ে সন্তোষে আবিষ্ট হবেন? কবি আব্দুল কাদির একজন প্রচারে নির্লোভ নিজ প্রতিভায় অবিচারকারী অপরাধী এক উদাসীন বই আর কিছুই নয়। সাংবাদিক আব্দুল কাদির একজন বালুচরে ঘর বাঁধা যাযাবরের মতো। কোন পত্রিকাতেই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেননি। কখনো পরিস্থিতির কারণে, কখনোবা আপন বিচরণশীলতার কারণে। নিজের ‘জয়তী’ সাত সংখ্যার বেশি টেনে নিতে না পারাটা আদৌ কি আর্থিক অনটন নাকি তার অস্থিরতার প্রভাব তা-ও বিবেচ্য। সংগঠক আব্দুল কাদির ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের অগ্রপুরুষ। কিন্তু খুব বেশি পরিমাণে মুসলিম কবি-সাহিত্যিক ও সংগঠন নিয়ে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে তার মধ্যে অতিমাত্রায় বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদী ভাবধারার কালচার গড়ে উঠেছিলো। এরই সুবাদে নজরুল প্রতিভার বিচারে কিঞ্চিৎ আবেগ তাকে যুক্তিনিষ্ঠতা হতে বিচ্যুত করেছিলো বলে মনে হয়। এই কারণে তিনি নজরুলকে ‘জাতীয় মহাকবি’ আখ্যা দিতেও পিছপা হননি যেখানে বাংলা মায়ের আরেক সন্তান মাইকেল মধুদূদন দত্ত স্বীকৃত মহাকবি হিসেবে জ্বলজ্বল করছিলেন তাঁর সামনেই। গবেষক আব্দুল কাদির অত্যন্ত মেধাবী এবং শ্রমনিষ্ঠ ও তথ্যনিষ্ঠ। আব্দুল কাদিরের সর্বাপেক্ষা সবল দিক ও দুর্বল দিক হচ্ছে সংকলন সম্পাদনা। একজন সম্পাদক হিসেবে নিজেকে নিজেই তিনি তিলে তিলে নষ্ট করেছেন মূল্যবান সময় ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে। কখনও কখনও তার সম্পাদনার কর্মটি কাক ও পরভৃৎ এর কাহিনীটাকেই মনে করিয়ে দেয়। নিজের সৃজনশীলতাকে পরিচর্যা না করে মননশীল রচনায় মেতে তিনি এমন অনেক কিছুই সংকলন করেছেন যা তার জন্যে আবশ্যক ছিলো না। তাঁর সকল সংকলনের মধ্যে নজরুলকে নিয়ে যত কর্ম সম্পাদনা হয়েছে তা-ই তাকে আজও অবিস্মরণীয় করে রেখেছে। নজরুল জীবনীকার এবং নজরুল রচনাবলী সম্পাদনা তাঁর সম্পাদিত কর্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এই কারণেই কবি আব্দুল কাদির আজও নজরুল প্রসঙ্গে সমীহভরে উচ্চারিত ও অনুসৃত। আব্দুল কাদিরের ছন্দ বিষয়ক প্রবন্ধ ছাড়াও ‘কম চেনা বড় মানুষ আব্দুল কাদির’ স্মারকগ্রন্থটিতে উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি হলো শামসুজ্জামান খান কর্তৃক গৃহীত আব্দুল কাদিরের লিখিত সাক্ষাতকার ও কবিকন্যা সুলতানা কাদির এর ‘আমার বাবা’ শীর্ষক স্মৃতিচারণা। পাশাপাশি পিতার সাথে আব্দুল কাদিরের পত্র যোগাযোগও মূল্যবান সংযোজন। বিভিন্ন বিভাজনে ও বিশ্লেষণে আব্দুল কাদিরকে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে সংযোজিত রচনাগুলো প্রায় বহুলাংশেই পুনরাবৃত্তি হয়েছে- এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়। প্রায় প্রতিটি রচনাতেই রবীন্দ্রনাথের ‘দিলরুবা’ পাঠে মন্তব্য সংশ্লিষ্ট থেকেছে। নজরুল, প্রবোধ চন্দ্র সেনের উক্তি, মোহিতলাল মজুমদার, আবুল ফজলের লেখনীর অংশবিশেষ ঘুরেফিরে বিভিন্ন লেখায় পুনরাবৃত্ত হয়েছে। স্মারকগ্রন্থখানা পাঠে এ কথা বলা যায় কলেবর স্ফীতির ব্যাপারে সম্পাদকের আবেগমাখা প্রশ্রয় ছিলো বটে। ‘একজন আব্দুল কাদির’ শিরোনামে খন্দকার সিরাজুল হক এর রচনাটিকে আব্দুল কাদির এর মূল্যায়নে যথাবর্ণিত রচনা বলে সাধুবাদ দেয়া যায়। পাশাপাশি ‘আনুষঙ্গিক একটি পত্রিকা : জয়তী’ শীর্ষক আব্দুল মান্নান সৈয়দ লিখিত রচনাটিও পাঠকের পিপাসা মেটাতে সক্ষমতা ধারণ করে। অধিকাংশ রচনাতেই আব্দুল কাদিরকে পরিচিত করতে গিয়ে নজরুলকে ব্যাপক পরিসর দেয়া হয়েছে এবং তার শ্বশুর মুজাফ্ফর আহমদও কম মঞ্চ দখল করেননি। যার কারণে স্মারকগ্রন্থ পাঠে এটাই মনে হয় নজরুল সম্পর্কে আলোচনায় আব্দুল কাদির যতটুকু আসতে পারে ততটুকুই বুঝি তাকে ফুটিয়ে তোলা হল। একই কারণে ‘কম চেনা বড় মানুষ’ কথাটি গ্রন্থটি নিজেও তার আঙ্গিকে ধারণ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। একটি কথা বার বার গ্রন্থ পাঠে সামনে এসেছে কবি আব্দুল কাদির রবীন্দ্র বলয়ভুক্ত। অথচ এমন বড় মাপের একজন কবির সাথে আব্দুল কাদির বিষয়ে আলাদা কোন আলোচনাই হলো না। রবীন্দ্রনাথ যেখানে ‘দিলরুবা’তে দিলখোলা হয়েছেন খুশ্ দিলে সেখানে ‘রবীন্দ্রনাথ ও আবদুল কাদির’ শিরোনামে আলাদা কোন পাঠ কীভাবে বাদ পড়ে যায় ভাববার বিষয়। পারিবারিক জীবনে আব্দুল কাদির কেমন মানুষ ছিলেন তা আরও ব্যাপক পরিসরে আলোচিত হলে মানুষ আব্দুল কাদিরকে জানা সম্ভব হতো। স্মারকগ্রন্থটিতে যারাই আলোচনা করেছেন তাদের অনেকেই আব্দুল কাদির উচ্চ শিক্ষিত না হতে পারার বিষয়টি অবতারণা করেছেন। কিন্তু উচ্চ শিক্ষিত না হওয়ার কারণে তার সাফল্যে ও সার্থকতায় কোন্দিকে ঘাটতি ছিলো তা ইঙ্গিত করেননি। বরং বিষয়টি বারবার আলোচিত হওয়ায় ক্ষুদ্র ক্ষতকে বারবার খুঁচিয়ে অহেতুক বড় করে তোলার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। চারশ ছেষট্টি পৃষ্ঠার ঝকমকে ছাপা বইটির শেষে কবি আব্দুল কাদিরের বেশ কয়েকটি দুর্লভ ছবি ছাপানো হয়েছে যাতে গ্রন্থটি পূর্ণাঙ্গতার পথে এগিয়ে গেছে। আব্দুল কাদিরের বইগুলোর কয়েকটির প্রচ্ছদ ছবি প্রকাশ করে আজকের পাঠকদের তীর্থ ভ্রমণের মতো সুখ লাভে সুযোগ করে দিয়েছেন সম্পাদক মহোদয়। মনন মোর্শেদের মনকাড়া প্রচ্ছদে কবি আব্দুল কাদিরের প্রতিকৃতি চমৎকার ফুটে উঠেছে। প্রধান সম্পাদক আশিক রেজা ও সম্পাদক তরুণ কবি ইমরান মাহফুজের সম্পাদনায় ফেব্রুয়ারি দুই হাজার সতের এ’ আলোর মুখ দেখা গ্রন্থখানি কবি আব্দুল কাদির সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য দলিল- এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়। উপেক্ষণীয় মুদ্রণ প্রমাদ সত্ত্বেও আব্দুল কাদিরের ‘যোড়’ বানান শৈলীতে চোখ আটকে যায়। আপন আলোকবিহীন চাঁদ দিনেরবেলা সূর্যের প্রতাপে নজরে পড়ে না। তাই মনে হয় দিনের আকাশে বুঝি চন্দ্রোদয় ঘটেনি। কবি আব্দুল কাদির এর ক্ষেত্রেও এই উপমা প্রযোজ্য; তিনি নিজে একজন অসংশয়িত কবি, কিংবদন্তী ছান্দসিক এবং কালজয়ী সম্পাদক। তবু এই মানুষটিকে চেনা হলো কম সে কী নজরুল নামক সূর্যের প্রতাপে নাকি তার আপন উদাসীনতায়? কবি আব্দুল কাদির তাই যথার্থ অর্থেই ‘কম চেনা বড় মানুষ’ যার নিজের আলো থাকলেও তিনি দিবাশশী।
×