ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নিম্ন আদালতের বিচারকদের আচরণবিধির গেজেট গ্রহণ সুপ্রীমকোর্টের;###;বাদীপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর মন্তব্য করব ;###;সুপ্রীমকোর্ট বলে, সবক্ষেত্রে সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করার বিধান রাখা হয়েছে

দীর্ঘ বিতর্কের অবসান

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৪ জানুয়ারি ২০১৮

দীর্ঘ বিতর্কের অবসান

বিকাশ দত্ত ॥ অবশেষে অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণবিধির বহু আলোচিত গেজেটটি সন্তোষজনকভাবে সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে আদেশ প্রদান করেছেন আপীল বিভাগ। এর মধ্য দিয়ে ওই গেজেট নিয়ে সরকারের সঙ্গে সর্বোচ্চ আদালতের দীর্ঘ টানাপোড়েন তিক্ততার অবসান ঘটল। মোট ৮৪ কার্যদিবস শুনানির পর চাকরিবিধির বিষয়টি নিষ্পত্তির পর্যায়ে হলো। গেজেটটি গ্রহণ করার পূর্বে আদালত বলে, দেখুন, উর্ধতন কর্তৃপক্ষের জায়গায় সুপ্রীমকোর্টের নাম ঢুকিয়েছি। আগে সুপ্রীমকোর্টের নাম ছিল না। সবখানে সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করার কথা বলা হয়েছে। সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া অনুসন্ধান করা যাবে না। সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া সরকার কিছুই করতে পারবে না। অথচ পত্রিকায় লেখা হচ্ছে সুপ্রীমকোর্র্ট সব দিয়ে দিয়েছে। দুঃখ হলো, কেউ পড়ে না। এই ধারা না পড়েই আন্দাজে মন্তব্য করে। আমরা পাঁচজন (আপীল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি) বসলাম। আমরা কি এতই বোকা? আমরা কি নবিস বিচারক? এরপর শুনানি শেষে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপীল বিভাগ বেঞ্চ বুধবার এ আদেশ দেয়। অন্য বিচারপতিগণ হলেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বিচারপতি ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। শুনানিতে ছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম ও মনজিল মোরসেদ। এর আগে বিধিমালায় আপত্তি জানিয়ে তা আপীল বিভাগ থেকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন দুর্নীতির দায়ে পদত্যাগ করা প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। বিচারপতি সিনহার কারণেই দীর্ঘদিন ধরে অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণবিধির গেজেটটি করা যায়নি। ফলে নি¤œ আদালতে দেখা দেয় স্থবিরতা। গেজেটটি আদালত গ্রহণ করাতে নি¤œ আদালতের স্থবির অবস্থান কেটে চলমান হবে এমনটি আশা করেছেন রাষ্ট্রের এ্যাটর্নি জেনারেল। গত ১১ ডিসেম্বর সরকার বিচারকদের চাকরিবিধির গেজেটটি প্রকাশ করে। পরে তা এফিডেভিট আকারে আপীল বিভাগে জমা দেয় রাষ্ট্রপক্ষ। আপীল বিভাগের আদেশে বলা হয়, সুপ্রীমকোর্টের সুপ্রিমেসি রেখে সরকার অধস্তন আদালতের যে শৃঙ্খলা ও আচরণবিধি প্রকাশ করেছে, তা গ্রহণ করেছে আপীল বিভাগ। তবে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণগুলো চলমান রেখেছে আপীল বিভাগ। উল্লেখ্য, আপীল বিভাগে শৃঙ্খলাবিধির এ মামলা প্রথম ওঠে ২০১২ সালের ৩০ মে। বুধবার শুনানির শুরুতেই এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আদালত চাকরি সংক্রান্ত শৃঙ্খলার বিধিমালা গেজেট আকারে জারির নির্দেশ দিয়েছিলেন। গত ১১ ডিসেম্বর সেটা জারি করা হয়েছে। আমাদের আরও একটি আবেদন আছে। ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট এ আদালত যে আদেশ দিয়েছিলেন সেখানে ১১৬ অনুচ্ছেদের রাষ্ট্রপতির বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ ছিল। আমরা সেটা প্রত্যাহার চাচ্ছি। এ সময় আদালত বলেন, সেটা করা যাবে। আগে গেজেটের বিধিগুলো পড়ুন। এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বিধিমালা পড়তে গেলে মাসদার হোসেন মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম ডায়াসে দাঁড়ান। তিনি বলেন, বিধিমালা চ্যালেঞ্জ করে রিভিউ আবেদন করব। এ বিষয়ে আমার একটি লিখিত বক্তব্য রয়েছে। সেটা দেখুন। সেটা নিষ্পত্তি করুন। তিনি বলেন, নিয়মানুযায়ী রুলস তৈরি করবে হাইকোর্ট। সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করবেন রাষ্ট্রপতি। এরপর গেজেট জারি হবে। এ সময় আদালত বলেন, মাসদার হোসেন মামলায় আপীল বিভাগ রুলস তৈরি করতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী এর আগেও রুলস তৈরি হয়েছে। গেজেট জারি হয়েছে। এ সময় ব্যারিস্টার আমীর বলেন, এই গেজেট নিয়ে কথা বলতে চাই। জবাবে আদালত বলেন, অবশ্যই বলবেন। রুলসে কি আছে সেটা দেখতে চাই। অন্য কোন কিছু থাকলে তা তো যে কোন সময় পরিবর্তন করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বলা হচ্ছে, আমরা সব দিয়ে দিয়েছি। কোথায় সব দিয়ে দিয়েছি, তা দেখান। গণমাধ্যমে উল্টাপাল্টা লেখা হচ্ছে। এরপর আদালত এ্যাটর্নি জেনারেলকে গেজেট থেকে বিভিন্ন ধারা পড়তে বলেন। আদালতের কথামতো এ্যাটর্নি জেনারেল বিভিন্ন ধারা পড়তে থাকেন। সুপ্রীমকোর্টের পরামর্শ করার কথা আসা মাত্রই আদালত বলেন, দেখুন সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করার বিধান করা হয়েছে। এক পর্যায়ে আদালত বলেন, দেখুন, উর্ধতন কর্তৃপক্ষের জায়গায় সুপ্রীমকোর্টের নাম ঢুকিয়েছি। আগে সুপ্রীমকোর্টের নাম ছিল না। সবখানে সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করার কথা বলা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া অনুসন্ধান করা যাবে না। সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া সরকার কিছুই করতে পারবে না। অথচ পত্রিকায় লেখা হচ্ছে সুপ্রীমকোর্ট সব দিয়ে দিয়েছে। বিধিমালার ২৯ নম্বর ধারা পড়ার সময় আদালত বলেন, এটা তো আরও মারাত্মক। ২৯ নম্বর ধারা দেখুন। সেখানে বলা আছে, কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে সেক্ষেত্রে সুপ্রীমকোর্টের পরামর্শ প্রাধান্য পাবে। দুঃখ হলো, কেউ পড়ে না। এই ধারা না পড়েই আন্দাজে মন্তব্য করে। আমরা ৫ জন (আপীল বিভাগের ৫ বিচারপতি) বসলাম। আমরা কি এতই বোকা? আমরা কি নবিস বিচারক? আমরা নাকি সব শেষ করে দিয়েছি। আমাদের মনে হচ্ছে আগের রুলসে সুপ্রীমকোর্টের ক্ষমতা ছিল না। এখন সেটা করা হয়েছে। বাইরে বলা হচ্ছে গেল গেল সব গেল। আমরা সব দিয়ে দেইনি। আদালত বলেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোন প্রস্তাব দিলেও সুপ্রীমকোর্ট পরামর্শ না দিলে কিছু করতে পারবে না উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ। কোন কিছু করতে হলে আমাদের (সুপ্রীমকোর্র্ট) পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপে অবশ্যই সুপ্রীমকোর্টের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। এ সময় ব্যারিস্টার এম আমীর বলেন, সুপ্রীমকোর্ট গেজেট গ্রহণ করার পর আমার আর কিছুই বলার থাকে না। এরপর আদালত আদেশ দেন। আদেশের পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, আদালত স্পষ্টভাবে দেখেছেন যে, নিম্ন আদালতের বিচারকদের ব্যাপারে অনুসন্ধান, তদন্ত, শাস্তি প্রদান, আপীল এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করার বিধান রাখা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা যদি রাষ্ট্রপতি বা আইন মন্ত্রণালয় এবং সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে মতে কোন অমিল হয়, চাকরি বা অপসারণের ক্ষেত্রে তাহলে সুপ্রীমকোর্টের মতামতই প্রাধান্য পাবে বলেই উল্লেখ করা আছে। আমরা রুলসটি আপীল বিভাগে দাখিল করেছিলাম। আজ আদালত গ্রহণ করেছে। এতদিন অর্থাৎ চাকরি থেকে অপসারণসহ অন্যান্য বিধিমালা ছিল না। আজ (বুধবার) থেকে কার্যকর হবে। আদালত সন্তোষ হয়ে এই গেজেটটি গ্রহণ করেছেন। এর আগে আদালত নির্দেশ দিয়েছিল রুলস প্রণয়ন করার জন্য। আদালত গ্রহণ করার ফলে এখন নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের বিতর্কের অবসান ঘটল। অন্যদিকে ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম বলেছেন, আদালত গেজেটটি গ্রহণ করা আমাদের হাইকোর্ট বিভাগে রিট করার ক্ষেত্রে একটি বাধা সৃষ্টি হলো। অতএব এখন পূর্ণাঙ্গ রায় না পেলে আমি মন্তব্য করব। আপীল বিভাগে শৃঙ্খলাবিধির এ মামলা প্রথম ওঠে ২০১২ সালের ৩০ মে। সে সময় প্রধান বিচারপতি ছিলেন মোঃ মোজাম্মেল হোসেন। সাত সদস্যের ওই বেঞ্চে তার সঙ্গে ছিলেন বিচারপাতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোঃ ইমান আলী ও বিচারপতি মোঃ শামসুল হুদা। তাদের মধ্যে বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি মোঃ শামসুল হুদা অবসরে গেছেন। নানা আলোচনার জন্ম দিয়ে বিচারপতি এস কে সিনহা পদত্যাগ করেছেন। বর্তমানে পাঁচজনের বেঞ্চে বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি ইমান আলীর সঙ্গে আছেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। ঘটনা প্রবাহ ॥ মাসদার হোসেন মামলার চূড়ান্ত শুনানি করে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রীমকোর্টেও আপীল বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে ঐতিহাসিক এক রায় দেয়। ওই রায়ে আপীল বিভাগ বিসিএস (বিচার) ক্যাডারকে সংবিধান পরিপন্থী ও বাতিল ঘোষণা করে। একইসঙ্গে জুডিসিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস ঘোষণা করা হয়। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে ১২ দফা নির্দেশনা দেয় সর্বোচ্চ আদালত। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর ২০০৭ সালের ১ নবেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করে সুপ্রীমকোর্টে পাঠায়। সরকারের খসড়াটি ১৯৮৫ সালের সরকারী কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপীল) বিধিমালার অনুরূপ হওয়ায় তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থী বলে গত বছর ২৮ আগস্ট শুনানিতে জানায় আপীল বিভাগ। এরপর ওই খসড়া সংশোধন করে সুপ্রীমকোর্ট আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেইসঙ্গে তা চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন আকারে আদালতে উপস্থাপন করতে বলা হয় আইন মন্ত্রণালয়কে। এরপর দফায় দফায় সময় দেয়া হলেও সরকারের সঙ্গে আদালতের মতপার্থক্যের কারণে ওই বিধিমালা গেজেট প্রকাশের বিষয়টি ঝুলে থাকে। আইন ও বিচার বিভাগ থেকে এর আগে শৃঙ্খলা বিধিমালার যে খসড়া সুপ্রীমকোর্টে জমা দেয়া হয়েছিল, গত ৩০ জুলাই তা গ্রহণ না করে কয়েকটি শব্দ ও বিধি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তখনকার প্রধান বিচারপতি সিনহা। গত ২ জুলাই সরকারকে দুই সপ্তাহ সময় দিয়ে আপীল বিভাগ বলেছিল, এটাই ‘শেষ সুযোগ’। যদিও আপীল বিভাগ এর আগে কয়েকবার ‘শেষ সুযোগ’ উল্লেখ করে সময় দেয়ার পরও রাষ্ট্রপক্ষ দফায় দফায় সময় নিয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সরকারের প্রণীত খসড়া শৃঙ্খলাবিধি সুপ্রীমকোর্ট তাদের সুপারিশসহ আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। সেই থেকে ধারাবাহিকভাবে সময় নেয় সরকার। ২০১৬ সালের ৭ নবেম্বর বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা ২৪ নবেম্ব^রের মধ্যে গেজেট আকারে প্রণয়ন করতে সরকারকে নির্দেশ দেন আপীল বিভাগ। আপীল বিভাগের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দুই সচিবকে তলব করেছিলেন আদালত। তবে ওই বছর ১১ ডিসেম্বর রাতে আইন মন্ত্রণালয় এক পরিপত্রের মাধ্যমে জানায়, নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে পরদিন ১২ ডিসেম্বর আপীল বিভাগ দ্বিমত পোষণ করেন। আদালত বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতিকে ভুল বোঝানো হচ্ছে।’ বিধি প্রণয়ন সম্পর্কে আপীল বিভাগ বলেন, ‘এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন। এখানে কোনও কম্প্রোমাইজ নেই।’ তবে আপীল বিভাগের এই অভিমত সত্ত্বেও বিগত সাত মাসেও এই গেজেট জারি করা হয়নি। ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয়া হয়। ওই রায়ের আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল। ১২ দফার মধ্যে ইতোমধ্যে কয়েক দফা বাস্তবায়ন করেছে সরকার। এজন্য বার বার আদেশ দিতে হয়েছে আপীল বিভাগকে। এমনকি ২০০৪ সালে আদালত অবমাননার মামলাও করতে হয়েছে বাদীপক্ষকে। এরপর ২০০৭ সালের ১ নবেম্বর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক ঘোষণা করেন। এ অবস্থায় ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ আপীল বিভাগ চার সপ্তাহ সময় দেন সরকারকে। এরপর গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় থেকে একটি খসড়া শৃঙ্খলাবিধি তৈরি করে সুপ্রীমকোর্টে পাঠানো হয়। কিন্তু তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে না হওয়ায় সুপ্রীমকোর্ট কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি গঠন করে আলাদা একটি শৃঙ্খলা বিধি তৈরি করেন। গত ২ জানুয়ারি এ বিষয়ে আপীল বিভাগে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৭ সালের ১০ জানুয়ারি আপীল বিভাগ বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত চারটি বিধিমালা সাতদিনের মধ্যে গেজেট আকারে প্রকাশের নির্দেশ দেন। তবে এ সংক্রান্ত মামলাটি এখনও আপীল বিভাগে বিচারাধীন। ১২ দফা নির্দেশনার যেসব দফা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য তাগিদ রয়েছে। শৃঙ্খলাবিধির সেই খসড়া নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে গত ১৩ অক্টোবর দেশ ছাড়ার পর ছুটি শেষে ১০ নবেম্বর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। এরপর গত ১৬ নবেম্বর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার সঙ্গে বৈঠক করে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ওই খসড়া নিয়ে মতপার্থক্য দূর হয়েছে। এরপর তিনি সোমবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন প্রমোটিং ইকোয়ালিটি, জাস্টিস এ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে আসার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে গেজেট প্রকাশের তথ্য জানান। আনিসুল হক বলেন, ‘কিছু কিছু প্রতিকূলতা আছে। এই প্রতিকূলতাগুলো কিন্তু আমরা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছি। একটু সময় হলে আমি মনে করি অনেক প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে পারব।’ নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেয়ার একমাত্র এখতিয়ার মহামান্য রাষ্ট্রপতির। তিনি কখন নিয়োগ দেবেন, সেটা তো তিনি আমাকে বলবেন না।’ আইনমন্ত্রী একইসঙ্গে বলেন, অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি সংবিধান অনুসারে প্রধান বিচারপতির অনুরূপ সব কাজই করতে পারেন। তিনি বিচারপতি নিয়োগ দিলেও সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করা হয় না। এ্যাটর্নি জেনারেল ॥ নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধির ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্রপতি বা আইন মন্ত্রণালয় এবং সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে মতের কোন অমিল হয়, তাহলে সুপ্রীমকোর্টের মতামতই প্রাধান্য পাবে। বিধিমালার গেজেটে এমন উল্লেখ আছে বলে জানিয়েছেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট গ্রহণ করে আপীল বিভাগের আদেশে পর বুধবার নিজ কার্যালয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বাংলাদেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির ব্যাপারে ইতিপূর্বে আমরা সময় নিয়েছিলাম। এ ব্যাপারে আইন যেটা তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। সেটা দাখিল করেছি। বুধবার সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ এটাকে গ্রহণ করেছেন। এখন থেকে এটা কার্যকর হবে। এতদিন নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধি, তাদের চাকরি থেকে অপসারণ বা অন্যান্য বিষয়ে যে বিধানাবলী থাকার কথা ছিল সেগুলো ছিল না। আদালত সন্তুষ্ট হয়ে এটাকে গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, আদালত স্পষ্টভাবে দেখেছেন যে, নিম্ন আদালতের বিচারকদের ব্যাপারে অনুসন্ধান, তদন্ত, শাস্তি প্রদান, আপীল এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করার বিধান রাখা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা যদি রাষ্ট্রপতি বা আইন মন্ত্রণালয় এবং সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে মতে কোন অমিল হয়, চাকরি বা অপসারণের ক্ষেত্রে তাহলে সুপ্রীমকোর্টের মতামতই প্রাধান্য পাবে বলেই উল্লেখ করা আছে। এটা নিয়ে অনেকে নানা রকম কলাম লিখছেন বা একটা টকশোতে বলছেন সুপ্রীমকোর্টের ক্ষমতা খর্ব হয়েছে, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এই রুলসটা পড়লেই বোঝা যাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শের বিধান রাখা হয়েছে। মাজদার হোসেন মামলায় এটি কন্টিনিউয়াস ম্যান্ডামাস। যদি মাজদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোন রকম মত দ্বৈততা দেখা দেয় বা কোন রকম ডেড লক ক্রিয়েট হয়, সেক্ষেত্রে আবার এই মামলায় তারা নির্দেশ দেবেন। যেটাকে বলা হয় কন্টিনিউয়াস ম্যান্ডামাস। অর্থাৎ নতুনভাবে কোন কিছু আর দায়ের করতে হবে না। এ মামলাতেই বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনে তারা আদেশ দিতে পারবেন। এজন্যই বলেছেন ফর দ্য টাইমবিং। কিন্তু আমাদের রুলস গ্রহণের বিষয়ে টাইমবিং এ্যাপলিকেবল না। এটা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম ॥ এ মামলায় আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম বলেন, নিয়ন্ত্রণ বিধি যেটা আজ এ্যাটর্নি জেনারেল আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করেছেন সেটা সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে। যেটা কর্ম বিভাগের জন্য প্রযোজ্য এবং সংস্থাপন মন্ত্রণালয়কে যে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ করা হয়েছে, সেটি রিট করবার চিন্তা আমাদের ছিল। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ যদি আপীল বিভাগের হাইকোর্ট বিভাগের অধীনে মন্ত্রণালয় থাকত তাহলে সেটা সঠিক হতো। আমাদের আদি সংবিধানে সেটাই ছিল। এখন উনারা (আপীল বিভাগ) যে আইনগুলোকে অনুমোদন করে দিলেন, সেসব বিষয় চ্যালেঞ্জ করে রিট করার ইচ্ছা ছিল, সুপ্রীমকোর্ট অনুমোদন করার কারণে সেটা আর সম্ভব হবে না। গেজেট প্রকাশ ॥ ১১ ডিসেম্বর অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণবিধির বহু আলোচিত গেজেটটি প্রকাশ করা হয়। রাষ্ট্রপতির মোঃ আবদুল হামিদের আদেশক্রমে আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মোঃ জহিরুল হক স্বাক্ষরিত ২৪ পৃৃষ্ঠার এই গ্রেজেট প্রকাশ করা হয় সোমবার। এই বিধিমালা বাংলাদেশে জুডিসিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা ২০১৭ নামে অভিহিত হবে। সার্ভিসের কোন সদস্যের বিরুদ্ধে এক বা একাধিক কারনে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেলে, এই বিধিমালা ও অন্যান্য বিধান অনুসারে অনুসন্ধান এবং বিভাগীয় মামলা রুজুসহ আনুষঙ্গিক সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে। এছাড়া অনুসন্ধান ইত্যাদিও বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের উদ্যোগ, বিভাগীয় মামলা ও সূচনা রুজু অভিযোগ বিবরণী ও অভিযোগনামা, সাময়িক বরখাস্তকরণ ও উহার অবসান, দ-সমূহ, তদন্ত ও দ- আরোপের পদ্ধতি, তদন্ত কার্যক্রম, তদন্তের সময়সীমা ও প্রতিবেদন, তদন্ত প্রতিবেদনের বিবেচনায় কতিপয় সিদ্ধান্ত, শারীরিক ও মানসিক অদক্ষতার ক্ষেত্রে অনুসন্ধান, সার্ভিস ত্যাগের ক্ষেত্রে অনুসন্ধান, ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে অনুসরণীয় পদ্ধতি, আপীল ও রিভিউ, অন্যান্য দ- পুনঃবিচেনার আবেদন, নির্ধারিত সময়সীমা অনুসরণ, সুপ্রীমকোর্টের পরামর্শের কার্যকারিতা, বিভাগীয় মামলা হতে কার্যকারিতা, বিভাগীয় মামলা হতে অব্যাহতির ফলসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে। ঐ দিনই আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের কোন দ্বন্দ্ব ছিল না। নেই। একজন ব্যক্তির (বিচারপতি এসকে সিনহা) রাজনৈতিক অভিলাষের জন্য সঙ্কট তৈরি হয়েছিল। তিনি রিমুভ হওয়াতে সঙ্কট দূরীভূত হয়েছে। এ কারণে আজ নিম্ন আদালতের গেজেট বের হয়েছে।’ মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে বিচারকদের নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ ও অপসারণসংক্রান্ত বিধিমালা না করায় গত এক বছর ধরে সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েন চলে আসছে। এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ নিয়ে সরকার ২৫ দফা সময় নিয়েছে।
×