ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডের নেতৃত্বে বহুজাতিক সামরিক মহড়া

মিয়ানমার সেনাবাহিনী আমন্ত্রিত!

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

মিয়ানমার সেনাবাহিনী আমন্ত্রিত!

মুসলিম রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন অভিযান চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে আগামী বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডের নেতৃত্বে একটি বহুজাতিক সামরিক মহড়ায় পর্যবেক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ইয়াহু নিউজ। পেন্টাগন মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল ক্রিস্টোফার লোগান গণমাধ্যমকে বলেন, থাইল্যান্ডের বার্ষিক কোবরা গোল্ড নামের সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণের জন্য মিয়ানমারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, যেখানে কয়েক হাজার মার্কিন ও থাই সামরিক কর্মকর্তাসহ অন্যান্য এশিয়ান দেশগুলোও অংশ নেবে। লোগান আরও বলেন, মহড়ায় মিয়ানমারকে মানবিক সাহায্য ও দুর্যোগ ত্রাণ বিতরণ অংশে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। রয়্যাল থাই সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ গোয়েন্দা বিভাগের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, মিয়ানমার এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছে কিনা তা স্পষ্ট নয়, তবে থাইল্যান্ড চায় তারা এই মহড়ায় অংশগ্রহণ করুক। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পাশবিক নির্যাতন ও সন্ত্রাসের পরও থাইল্যান্ড কেন মিয়ানমারকে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নিলো এমন প্রশ্ন করা হলে ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা রোহিঙ্গা সমস্যাকে এর বাইরে রেখেছি, এটা কখনোই আলোচনায় আসেনি। আমরা সামরিক সহযোগিতা জনিত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার উপর নজর দিয়েছি। মিয়ানমার এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করুক এটি আমাদের ইচ্ছা। রোহিঙ্গাদের বিষয়টি রাজনীতির বিষয়, আমরা সৈন্য, আর এটা হলো সামরিক মহড়া। গণমাধ্যমে তার কথা বলার অনুমতি নেই যুক্তিতে পরে এই সরকারী কর্মকর্তা তার নাম প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন। এই মহড়ার বিষয়ে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে মন্তব্যের জন্য বেশ কয়েকবার অনুরোধ করা হলেও তারা কোন সাড়া দেয়নি। পেন্টাগন মুখপাত্র লোগানকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে থাকা মিয়ানমারকে আসন্ন মহড়ায় আমন্ত্রণ না জানানোর জন্য থাইল্যান্ডকে মার্কিন সামরিক বাহিনী কোন চাপ দিয়েছিল কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি পেন্টাগনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের উপর কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে নির্যাতন-নিপীড়ন শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে সেখান থেকে পালিয়ে এ পর্যন্ত ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বিশ্বজুড়ে শরণার্থীদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত আন্তর্জাতিক সংগঠন ডক্টরস উইদাউট বর্ডার ১৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন শুরুর প্রথম চার সপ্তাহেই সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ৬ হাজার ৭০০ জনকে হত্যা করেছে। তাদের মধ্যে ৭৩০ জন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু। গত ২৫ আগস্ট থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংগঠনটি নিজেদের করা জরিপের ভিত্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। সংগঠনটি জানায়, বাংলাদেশে অবস্থানরত শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ২ হাজার ৪৩৪টি পরিবারের ১১ হাজার মানুষের সঙ্গে তারা সরাসরি কথা বলে এ তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এই পরিবারগুলোর সবাই বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমনের শুরুর দিকেই সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছায়। জরিপের তুলনায় রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার ও মৃত্যুর হার প্রকৃত অর্থে আরও বেশি হবে বলে তাদের দাবি। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অত্যাচার, নিধন ও অগ্নিসংযোগে অন্তত নয় হাজার রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু মুসলমানের মৃত্যু হয়েছে বলে তারা ধারণা করছে। এদের মধ্যে ৭২ শতাংশ সরাসরি নির্যাতনের শিকার হয়েছে। মিয়ানমারে রাখাইন প্রদেশে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর নারকীয় হামলাকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত শুদ্ধতা অভিযান হিসেবে অভিহিত করেছে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দাবি তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ তদন্তে রাখাইন অঞ্চলে নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্তদের নিরাপত্তা বাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এই সপ্তাহের শুরুতে, মিয়ানমারে রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের ওপর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় সেনা কর্মকর্তা মং মং সোসহ ১৩ জনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক জাচিরি আবুজা বলেন, রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মহড়ার জন্য মিয়ানমারকে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্যে দিয়ে এদেশটির প্রতি বস্তুত অসঙ্গত এবং ভুল বার্তা পাঠানো হয়েছে। আবুজা বলেন, মহড়ায় মিয়ানমারকে আমন্ত্রণ জানিয়ে মার্কিন সরকার দেশটির বিরুদ্ধে নিজেদের ঘোষিত জাতিগত নিধন অভিযানের অভিযোগটির উপরই এক ধরনের প্রলেপ দিয়ে দিল। যেখানে দুয়েকদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ গুরুতর মানবাধিকারের লঙ্ঘনের জন্য মিয়ানমারের এক সেনা কর্তাকে শাস্তি দিল। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের বিষয়টিকে তারা খুব হালকাভাবে নিচ্ছে। কোবরা গোল্ড থাইল্যান্ডের একটি বার্ষিক সামরিক মহড়া। ২০১৮ সালের কোবরা গোল্ড মহড়ায় মিয়ানমারসহ ২৯টি দেশ এতে অংশ নেবে বা পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই মহড়ায় অংশ নেবে প্রায় ৩৬০০ মার্কিন সেনা। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হবে যুদ্ধের এ মহড়া। মানবাধিকারসহ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার বিভিন্ন বিষয়ে ওয়াশিংটন ব্যাংককের সমালোচনা করলেও কয়েক দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ড যৌথভাবে এই মহড়া চালিয়ে আসছে। ২০১৪ সালের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী থাইল্যান্ডের ক্ষমতা গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্র-থাইল্যান্ড সম্পর্ক শীতল হয়ে যায়, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর এ সম্পর্কের পালে আবার হাওয়া লেগেছে।
×