ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ হচ্ছেই না ॥ আরও এসেছে দু’শতাধিক

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ হচ্ছেই না ॥ আরও এসেছে দু’শতাধিক

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ এখনও বন্ধ হচ্ছে না রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। মিয়ানমারের সীমান্ত খোলা রয়েছে রোহিঙ্গাদের চলে আসার জন্য। আর বাংলাদেশের সীমান্ত উন্মুক্ত রয়েছে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের জন্য। গত ২৫ আগস্ট মধ্যরাতের পর রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান শুরুর পর বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমনে যে ঢেউ লেগেছে সে ঢেউয়ের উত্তালতা না থাকলেও একেবারে থামছে না। বিষয়টি বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, মানবতার খাতিরে বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের গ্রহণের যে অঘোষিত পথ বেছে নেয়া হয় তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। আর এ সুবাদে রাখাইন রাজ্যে নিপীড়ন নির্যাতনের মুখে না থাকা রোহিঙ্গারাও এখন চলে আসছে। এ পরিস্থিতিতে উখিয়া-টেকনাফসহ গোটা কক্সবাজার অঞ্চল প্রতিদিন অজানা ঝুঁকিতে চলে যাচ্ছে। এসব বক্তব্য উখিয়া-টেকনাফের স্থায়ী অধিবাসীদের পাশাপাশি প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত অধিকাংশ কর্মকর্তাদেরও। বৃহস্পতিবার ভোরে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে আরও দুই শতাধিক নতুন রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এহেন পরিস্থিতিতে স্থানীয় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধে সরকার কেন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। স্থানীয়দের পক্ষ থেকে সীমান্ত সীল করার দাবিও উঠেছে। আর তা যদি না হয় তাহলে গোটা রাখাইন রাজ্যের অবশিষ্ট রোহিঙ্গারাও এদেশে যে চলে আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ফলে জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে, আর কত রোহিঙ্গা এলে মিয়ানমার সংলগ্ন বাংলাদেশের গোটা সীমান্ত এলাকার কোন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা আর আসতে পারবে না। বর্তমানে কক্সবাজার অঞ্চলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ৭১ এনজিও কাজ করছে। এসব এনজিওর মধ্যে বেশকিছু রয়েছে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যেÑএ ধরনের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা সমালোচনার কমতি নেই। এমনও আলোচনা রয়েছে, কিছু কিছু এনজিও রয়েছে যারা রাখাইন থেকে অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদেরও চলে আসার জন্য ইন্ধন যোগাচ্ছে। পাশাপাশি স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার জন্যও শক্তি সাহসসহ যাবতীয় সহযোগিতা যোগাচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে ইতোমধ্যে যে প্রত্যাবাসন প্রশ্নে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে এবং এর পাশাপাশি অস্থায়ীভাবে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসান চরে জায়গা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এর সফলতা নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। প্রত্যাবাসনের বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত। সমঝোতা স্মারক হলেও এর পরবর্তী যে সব বিষয়াদি রয়েছে তা সময়সাপেক্ষ। সর্বাগ্রে রয়েছে রোহিঙ্গাদের পক্ষে ইতোমধ্যে প্রত্যাবাসন প্রশ্নে নানা দাবি উঠেছে। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও গত মঙ্গলবার বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে যেন কোন ধরনের বল প্রয়োগ করা না হয়। তবে জাতিসংঘ রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ভূমিকা পালন করে চলেছে। তবে নিরাপত্তা পরিষদে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসছে না বিধায় জাতিসংঘও এক ধরনের অসহায়ত্ব বরণ করে আছে। নতুন এলো দুই শতাধিক ॥ বৃহস্পতিবার ভোরে টেকনাফের তিনটি পয়েন্ট দিয়ে নতুন দুই শতাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। শামলাপুর, লম্বরিপাড়া ও শাহপরীরদ্বীপ পযেন্ট দিয়ে এসব রোহিঙ্গা উত্তর মংডু থেকে চলে এসেছে বলে স্থানীয়দের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মংডুর দমখালী এলাকায় এখনও বহু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রতিদিন ছোট বড় ইঞ্জিন নৌকাযোগে রোহিঙ্গারা আসছে। মাঝখানে ভেলা ভাসিয়েও এসেছে। বৃহস্পতিবার আগত রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের অধিকাংশ স্বজন ও পরিচিতরা আগেই বাংলাদেশে চলে এসেছে। এছাড়া রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সরকারের নিপীড়ন নির্যাতন না থাকলেও এক ধরনের ভীতি প্রদর্শনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ফলে ভবিষ্যত অনিশ্চয়তায় তারাও চলে এসেছে। অন্যরাও চলে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। এসব রোহিঙ্গাদের অনেকে জানিয়েছে, ইতোপূর্বে রাখাইন জুড়ে যে পরিমাণে সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল তাদের অধিকাংশই ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে মংডু শহর ও শহরতলীর আশপাশে সেনা টহল অব্যাহত আছে। নতুন-পুরাতন মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সরকারীভাবে ১০ লক্ষাধিক বলে বলা হলেও মূলত এ সংখ্যা আরও বেশি। অনেক সংস্থার মতে, এ সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ফলে আগামীতে প্রত্যাবাসন যদি আদৌ শুরু হয়, সেক্ষেত্রে প্রতিদিন ৩শ’ করে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলে তাতে পালিয়ে আসা সব রোহিঙ্গা ফিরে যেতে সময় লাগবে প্রায় একযুগ। বর্তমানে এসব রোহিঙ্গা টেকনাফ উখিয়ার বারোটি ক্যাম্প ছাড়াও বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন এলাকায় বসতি গেড়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৯১-৯২ সনে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সিংহভাগ ফিরিয়ে নিলেও মাঝপথে এসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভাটা পড়ে। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়ে থাকা মানুষগুলো আসলেই মিয়ানমারের নাগরিক কি-না তা যাচাই করার বাহানায় প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় মিয়ানমার। ১৯৯২ সাল থেকে ২৬ বছর ধরে প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় থেকে গেছে উখিয়া ও টেকনাফের দু’টি ক্যাম্পে অশ্রিত প্রায় ৩২ হাজার রোহিঙ্গা। পরবর্তী ১৯৯৪ সালে ফের পালিয়ে আসে প্রত্যাবাসনকৃত প্রায় দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৫ বারের তো রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। তবে এবারের মতো অতীতে কোন সময় এত রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেনি। ইতোপূর্বে যারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছিল, তন্মধ্যে অনেকে প্রত্যাবাসনে ফাঁকি দিয়ে থেকে গেছে এদেশে। এদের বড় একটি অংশ এদেশের ভুয়া ঠিকানা ও পাসপোর্ট নিয়ে পাড়ি জমিয়েছে মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। বিদেশে পাড়ি জমানোর আগে তারা পরিবার-পরিজনদের রেখে গেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। ওসব রোহিঙ্গা স্থায়ী বসবাসের সুবাদে জাতীয় সনদ সংগ্রহ করে বাংলাদেশী দাবি করে জমিজমাও ক্রয় করেছে বিভিন্ন স্থানে। তবে এবারে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের সরকার বায়োমেট্টিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন করার কারণে হয়ত তারা ভুয়া ঠিকানায় পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে পারবে না। ইতোপূর্বে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের যারা স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, তাদের সহযোগিতায় ক্যাম্প থেকে স্বজনদের নিয়ে আসা হচ্ছে ওইসব বাসাবাড়িতে। ক্যাম্প ত্যাগ করে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা রোধে প্রশাসন সড়কপথে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করে রেখেছে। কিন্তু এরপরও ফাঁকফোকরে বহু রোহিঙ্গা পলায়ন তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। কক্সবাজার জেলা ও পুলিশ প্রশাসন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ ও পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঁচটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা শিবিরে পুলিশ ক্যাম্প নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল জানান, উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে ৫টি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনকল্পে জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। বালুখালী, লম্বাশিয়া, তাজনিমারখোলা, কুতুপালংয়ের মধ্যখানে মোট পাঁচটি ক্যাম্প স্থাপন করা হবে। ওসব ক্যাম্পে দায়িত্বরতরা উখিয়া থানা পুলিশের সহযোগিতায় কাজ করবে। নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ৫টি পুলিশ ক্যাম্পে ৫ জন ওসির অধীনে এক শ’ জন করে মোট ৫শ’ পুলিশ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। ইজতেমায় বহু রোহিঙ্গা ॥ বৃহস্পতিবার থেকে কক্সবাজারে শুরু হওয়া তাবলিগ জামাতের তিন দিনের জেলা ইজতেমায় বিচ্ছিন্নভাবে যোগ দিয়েছে বহু রোহিঙ্গা। সমুদ্র সৈকতের জেলে পার্ক মাঠ সংলগ্ন পশ্চিমের বিশাল এলাকায় রোহিঙ্গাদের জমায়েত রয়েছে। প্রধান সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেকপোস্টের বিপরীতে তারা পায়ে হেঁটে ওই ইজতেমায় যোগদান করেছে বলে বিভিন্ন সূত্রের দাবি রয়েছে। টেকনাফ ও উখিয়ার আশ্রিত ক্যাম্পগুলোতে কাঁটাতারের ঘেরা না থাকায় রোহিঙ্গারা সহজে বেরিয়ে যত্রতত্র চলাচল করছে। ক্যাম্প ত্যাগ করে ইজতেমায় আসা রোহিঙ্গারা ফের আশ্রিত ক্যাম্পে ফেরত যাওয়া নিয়ে সন্দেহ করছেন স্থানীয়রা। রোহিঙ্গারা যাতে স্বদেশে ফেরত না গিয়ে শহর ও শহরতলীর কোথাও আশ্রয় (ভাড়া বাসা) খুঁজে পরবর্তীতে কৌশলে পরিবারের সদস্যদেরও ক্যাম্প ত্যাগ করিয়ে নিয়ে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে আয়োজক কর্তৃপক্ষীয় সূত্রে জানানো হয়েছে, জেলা পর্যায়ে ক্যাটাগরিতে কক্সবাজারে তৃতীয়বারের মতো ইজতেমা শুরু হলো। পাঁচ লাখ মুসল্লির সমাগমের লক্ষ্য নিয়ে এই ইজতেমার আয়োজন করা হয়েছে। পুরো ইজতেমা স্থলের ১৭ একর জায়গায় প্যান্ডেল করা হয়েছে। জেলার রামু, চকরিয়া, সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া টেকনাফ, উখিয়া এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও লামা উপজেলার মানুষ ইজতেমায় অংশ নিচ্ছেন। এছাড়াও কক্সবাজারে অবস্থানরত দেশের বিভিন্ন স্থানের তাবলিগ জামাতের লোকজন ও বাংলাদেশে অবস্থানরত ওমান, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার তাবলিগ জামাতের লোকজনও অংশ নেবেন। কাল শনিবার দুপুরে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে ইজতেমা শেষ হবে। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন বলেন, ইজতেমা ও মুসল্লিদের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা নেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সব ধরনের গোপনীয় নাশকতার আশঙ্কা ঠেকাতেও গোয়েন্দা নজরদারি থাকবে।
×