ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা বেড়েছে

সহপাঠীরাই খবর দিল ইউএনওকে, মুক্তি পেল রিজওয়ানা

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ২৮ অক্টোবর ২০১৭

সহপাঠীরাই খবর দিল ইউএনওকে, মুক্তি পেল রিজওয়ানা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ দুদিন পরেই সহপাঠীর বিয়ে! কিন্তু এখনও তো তার বিয়ের বয়স হয়নি। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই পরিবার থেকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়া শুরু করে রিজওয়ানার বাবা-মা। এমনকি তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয় তার পরিবার। এরপর রিজওয়ানার সহপাঠীরা এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানায়। খবর পেয়ে শুক্রবার বিয়ের দিন হবিগঞ্জ এলাকার ইউএনও এবং উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা রিজওয়ানার বাড়িতে বর আসার আগেই উপস্থিত হয়ে বিয়েটি বন্ধ করে দেন। শুক্রবার হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পেয়েছে রিজওয়ানা আক্তার নামে এক মেধাবী স্কুলছাত্রী। সে উপজেলার চুনারুঘাট পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। ওই বিদ্যালয়ে ১০০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে রিজওয়ানার রোল নম্বর ৭। মেধাবী ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও বেশ কিছুদিন ধরে রিজওয়ানা বিদ্যালয়ে যাচ্ছিল না। পরে তার সহপাঠীরা জানতে পারে শুক্রবার দুপুরে চুনারুঘাটের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাকে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। এরপর সহপাঠীদের সাহায্যেই রিজওয়ানা বাল্যবিবাহ থেকে মুক্তি পায়। ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৬’ হওয়ার পর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কিশোরীদের প্রতিবাদী হওয়ার মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা নিজেরাই স্বপ্রণোদিত হয়ে ভেঙ্গে দিচ্ছে বিয়ে। তারা অসময়ের বিয়ে ভাঙ্গার জন্য প্রশাসনের দ্বারস্থ হচ্ছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের গত নয় মাসে ১০০টির বেশি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়েছে। গত বছর মোট ১৭৭টি বাল্যবিবাহ হয়। তখনও পত্রিকায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের বিচ্ছিন্ন ঘটনা উঠে আসে। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে প্রতিরোধের হার বাড়ছে। দুই দশক আগে বাল্যবিবাহের হার ছিল ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ। এখন কমে ৪৩ শতাংশ হয়েছে। এ বিষয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম এনডিসি জনকণ্ঠকে জানান, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাস হওয়ার পর অনেকেই আন্দোলন করেছেন, এ আইনের মাধ্যমে নাকি বাল্যবিবাহ আরও বাড়বে। কিন্তু চিত্র পুরোই পাল্টে যাচ্ছে। আমরা নতুন আইনে শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করেছি। সেই সঙ্গে কোন মা যদি বাল্যবিবাহ দেয়ার চেষ্টা করেন তবে তাকেও শাস্তি দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। বর্তমানে মেয়েরা নিজেরাই প্রতিবাদ করছে, কারণ তারা পড়াশোনা করতে চায়। এখন সব মেয়েই নিজের ভবিষ্যত নিয়ে সচেতন। আমরা ইতোমধ্যেই দেশে সাড়ে ১৩ হাজার কিশোর-কিশোরী ক্লাব গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শুধু মেয়েদের সচেতন হলেই হবে না, পাশাপাশি ছেলেদেরও সচেতন হতে হবে। শুক্রবার সাভার সদর ইউনিয়নের চাঁপাইন এলাকায় আরও এক স্কুলছাত্রীর (১৫) বাল্যবিবাহ পন্ড করা হয়েছে। এদিন দুপুরে সাভার মডেল থানা পুলিশ ওই এলাকায় গিয়ে বিয়েটি বন্ধ করে। জানা গেছে, ওই এলাকার এক স্কুলছাত্রীকে বরিশাল এলাকার জাহাঙ্গীর ইসলাম লিমনের সঙ্গে বিয়ের আয়োজন করে তাদের পরিবার। বিয়ের প্রস্তুতির সময় সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রতিবেশীর মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরে শুক্রবার দুপুরে চাঁপাইন এলাকায় পুলিশ পাঠান। এ সময় স্কুলছাত্রীর বয়স কম হওয়ায় পুলিশ বিয়েটি বন্ধ করে দেয়। ১০৯ জাতীয় টোল ফ্রি হেল্পলাইন নম্বর। নারীর যে কোন সমস্যায় ১০৯-এ ফোন করলেই সাহায্য পাবেন। হেল্পলাইন সার্ভিসের বিষয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদফতরের গবেষক কর্মকর্তা শায়লা ইয়াসমিন জানান, বর্তমানে আমাদের কাছে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করার বিষয়ে বেশি ফোন আসে। অনেক ক্ষেত্রে ভিকটিমের প্রতিবেশী কিংবা তার সহপাঠীরা ফোন করে কবে, কখন ও কোথায় বিয়েটি হবে সে বিষয়ে আমাদের অবহিত করে। আমরা তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্ট এলাকার চেয়ারম্যান, ইউএনও, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা, ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করি। এরপর তারা বিয়ের দিন সবাই উপস্থিত হয়ে বিয়েটি বন্ধ করেন। বর্তমানে সরকারী কর্মকর্তারাও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। বিভিন্ন এলাকার সরকারী প্রতিনিধিরা যে কোন বাল্যবিবাহের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পৌঁছে যাচ্ছেন। সরকার বিশেষ বিধান ছাড়া ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিবাহ নিষিদ্ধ করে আইন পাস করেছে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭-তে বলা হয়েছে, মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর। তবে বাবা-মা ও আদালতের অনুমতিসাপেক্ষে বিশেষ বিবেচনায় ১৮ বছরের নিচেও বিয়ে বৈধ হবে। আর ছেলেদের বিয়ের বয়স ২১ বছর। বর্তমান আইনে বয়সের সীমা একই রেখে, শাস্তির সময়কাল এবং অর্থদ-ের পরিমাণ সর্বোচ্চ দুই বছর এবং লাখ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন আইনে শাস্তির আওতায় কারা আসবে, তার পরিষ্কার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যারা বিয়ে পরিচালনা ও রেজিস্ট্রি করেন তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। বয়স নির্ধারণকারী সনদগুলো নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সহজলভ্য নোটারি পাবলিক দিয়ে আর বয়সের জালিয়াতি করা যাবে না। সরকারের দাবি, এ আইন ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে বাল্যবিবাহমুক্ত করবে।
×