ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২৭ অক্টোবর ২০১৭

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ঢাকার বাইরের একটি ঘটনা। যারপরনাই ন্যক্কারজনক এবং নজিরবিহীন এই ঘটনার জন্ম দিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। কিন্তু ঘটনার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া এত যে, মুহূর্তেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বাদ যায়নি বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকা। রাজধানী শহরের শিক্ষিত উদার অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ যারপরনাই হতবাক। ছিঃ ছিঃ করছেন সবাই। সাম্প্রদায়িকতার রোগে আক্রান্তরা আর কতভাবে তাদের কদর্য চেহারা দেখাবে, জানতে চাইছেন। গত বুধবার বিকেলে অনুষ্ঠিত রাবি চারুকলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে কর্তৃপক্ষের এই কদর্য চেহারা ধরা পড়ে। চরম সাম্প্রদায়িক মানসিকতার পরিচয় দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রশ্নপত্রে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে ধর্মকে টেনে আনা হয়। একটি ধর্মকে বড় করে অন্য ধর্মগুলোকে ছোট করার লক্ষ্য নিয়ে সাজানো হয়েছে প্রশ্নপত্র। ঘটনার প্রমাণ এখন ভেসে বেড়াচ্ছে ফেসবুকে। প্রশ্নটির স্ক্রিনশট দেখে সত্যি নিজের চোখকে বিশ্বাস করা যায় না। চারুকলা অনুষদের অধীন ‘আই’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার একটি প্রশ্ন এরকমÑ ‘পৃথবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থের নাম কী?’ উত্তর খুঁজে নেয়ার জন্য দেয়া হয় চারটি অপশন। অপশনগুলো ছিলÑ (ক) পবিত্র কোরআন শরীফ (খ) পবিত্র বাইবেল (গ) পবিত্র ইঞ্জিল (ঘ) গীতা। এভাবে একটি ধর্মকে অন্য ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। পরীক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী। কিন্তু তাদের একটি-ই উত্তর দিতে বাধ্য করার দুরভিসন্ধি লক্ষ্য করা যায় প্রশ্নপত্রে। এখানেই শেষ নয়, তিনটি ধর্মগ্রন্থের নামের পূর্বে ‘পবিত্র’ শব্দটি যোগ করা হলেও, গীতার বেলায় সেটি করা হয়নি। এভাবে চরম হীনতা দীনতার পরিচয় মেলে। প্রশ্নটি যে সাম্প্রদায়িক রুগ্ন মানসিকতা থেকেই করা হয়েছে তা অন্য একটি প্রশ্ন দেখেও নিশ্চিত হওয়া যায়। সেখানে জানতে চাওয়া হয়েছে, ‘মুসলমান রোহিঙ্গাদের ওপর মায়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সশস্ত্র হামলা চালায় কত তারিখে?’ পরিষ্কার বোঝা যায় এখানে তারিখ জানতে চাওয়াটা মুখ্য নয়। সাম্প্রদায়িক উস্কানির অপচেষ্টা নেয়া হয়েছে। এর আগে কোন কোন স্কুলের পরীক্ষায়, মাদ্রাসার প্রশ্নপত্রে মূর্খ জঙ্গীগোষ্ঠীর ঢুকে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। এবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই পতনের তীব্র সমালোচনা চলছে। ঢাকার প্রবীণ একজন শিক্ষাবিদ তো রাগে কাঁপছিলেন। একটি অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে দেখা। বলছিলেন, সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন করার কাজে কেউ কেউ সরাসরি যুক্ত ছিলেন। বাকিরা নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। ফলে এটি সম্ভব হয়েছে। সবকটাকে চিহ্নিত করে কানে ধরে শহর ঘোরানোর পরামর্শ দেন তিনি। জানতে চান, ওদের ঘার ধরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করার কেউ নেই? বিষয়টি নিয়ে কথা হয় কয়েকজন সংস্কৃতিকর্মীর সঙ্গেও। তাদের একজন দেশের বিশিষ্ট নাট্যকর্মী। বলছিলেন, জঙ্গীবাদবিরোধী অপারেশন বিভিন্ন জায়গায় চালানো হচ্ছে। এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চালানো উচিত। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে রক্ষা করা যাবে না। ওরা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে হলি আর্টিজান বানিয়ে ছাড়বে। সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে ফেসবুকে। বিভিন্ন স্ট্যাটাসে বলা হচ্ছে, কিছুকাল আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকাশনায় ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। মূল দায় তো অবশ্যই ভিসির। কিন্তু দিব্যি চেয়ারে ছিলেন তিনি। রাজশাহীর বেলায় তাই হচ্ছে। সামান্যতম রুচিবোধ মর্যাদাবোধ থাকলে রাবি ভিসির পদত্যাগ করা উচিত বলে মনে করেন তারা। কোন কিছুর খোঁজ রাখবেন না, আবার তিনি ভিসি। কেন? প্রশ্ন তোলা হচ্ছে ফেসবুকে। অবশ্য সমালোচনার বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোন রা নেই। সবাই মুখ লুকাতে ব্যস্ত বলে জানা গেছে। কথা বলেছেন চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। নিজের দায়িত্ব তিনি পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিংবা যা করতে চেয়েছিলেন, করেছেন ঠিকঠাক-ই। এখন বলছেন, ‘এ ধরনের প্রশ্ন রাখা উচিত হয়নি। তবে অনিচ্ছাকৃতভাবে এটি হয়ে গেছে। তাই এই দুইটি প্রশ্নের নম্বর সব পরীক্ষার্থীরা পাবেন বলে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’ হয়ে গেল সমাধান। হয়ে গেল? জানার অপেক্ষায় বহু মানুষ। এবার ঢাকার গণপরিবহন প্রসঙ্গ। কত বলা হচ্ছে! লেখা হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ যাত্রীদের দুর্ভোগ কমছে না মোটেও। লোকাল বাস। সিটিং সার্ভিস বলে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে যাত্রীদের কাছ থেকে। বসার জায়গা নেই। দাঁড়িয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছেন যাত্রীরা। প্রচ- গরমে সিদ্ধ হলেও, কোন ফ্যান চলছে না। ফ্যান নেই। নারীদের দুর্ভোগ আরও বেশি। কে দেবে সমাধান? ফলে দুর্ভোগ বাড়ছে কেবল। বহু বছরের পুরনো ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় বাস দিব্যি চলছে প্রধান প্রধান সড়কে। গত বুধবার আগারগাঁওয়ের রাস্তায় একটি দৃশ্য দেখে তো পিলে চমকে গিয়েছিল। চলন্ত একটি বাসের পেছনের অংশ চোখের সামনে খসে পড়ে গেল! ছিটকে গেল বহুদূর। পেছনে অনেক গাড়ি। কয়েক সেকেন্ড সময় পেয়েছিল। তাই রক্ষা। তা না হলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটি ঢাকার গণপরিবহনের আসল চেহারা। সার্বিক চেহারা। এই চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কারও কিছু করার নেই। আছে? ফ্লাইওভারের কথাটি হোক। বৃহস্পতিবার থেকে চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার। ফ্লাইওভারের যে অংশটি বাংলামোটর এলাকায় এসে শেষ হয়েছে, মূলত সেটির উদ্বোধন করা হয় এদিন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ফ্লাইওভারের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ উপলক্ষে গোটা এলাকা বেশ উৎসবমুখর ছিল। তারও আগে ফ্লাইওভারটি লাল সবুজ রঙে সুন্দর সাজিয়ে নেয়া হয়। তবে যানচলাচলের কিছু সময়ের মধ্যেই অবাক কান্ড চোখে পড়ে। ফ্লাইওভারের বাংলামোটর অংশ থেকে মগবাজার পর্যন্ত দেখা দেয় দীর্ঘ যানজট। যে যানজট কমাতে আকাশ ঢেকে দিয়ে কংক্রিটের জঙ্গল নির্মাণ, সেটি কি তবে ব্যর্থ হলো? না, এখনই বলা যাবে না। আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করার পক্ষে স্থানীয় বাসিন্দারা।
×