সাইকেলটা আমাকে থামাতেই হলো। পথের পাশে ভাঙা ঘর। সেই ঘর থেকে শিশুর কান্না ভেসে আসছে। আমি প্রতিদিনই এ রাস্তা দিয়ে জয়পাড়া স্কুলে যাই।
সাইকেল স্ট্যান্ড করে ঘরের ভিতরের যাই আমি। যা ভেবেছিলাম তাই। সেই শিশুটি কাঁদছে। যাকে আমি স্কুলে যাবার সময় দেখি।
‘কি হয়েছে। কাঁদছ কেন?’
‘কি হইছে আবার। দাদির অসুখ। বিছানা থেকে উঠতে পারছে না।’ মেয়েটি বলে। আমি ওর নাম জানতাম, কুসুম। ওরা দুজনেই ভাঙা ঘরটাতে থাকে। কুসুমের বাবা নেই। মাও নেই।
আমি ডাকলাম।
‘চাচি কি ঘুমিয়ে আছেন?’ তিনি আমার কথায় চোখ মেললেন। কোন্ কথা বললেন না। আমি তার কপালে হাত রাখলাম। গা গরম। পুড়ে যাচ্ছে।
বললাম, ‘কুসুম, ডাক্তার ডাকতে হবে।’
‘কেমনে ডাকব। আমি ডাক্তার চিনি নাকি?’
আামি ঘর থেকে বের হই। লাফিয়ে উঠি সাইকেলে। খানেপুর বাজারের দিকে ছুটে যাই। ডাক্তার হোসেন মাহমুদ কেবলই এসে পৌঁছলেন বাজারে।
‘ডাক্তার সাহেব। আপনাকে একটু আমার সঙ্গে যেতে হবে।’
ডাক্তার রাজি হলেন। তার একটি মোটরসাইকেল আছে। বললেন, ‘আপনার সাইকেল বাজারে থাক। আমার বাইকের পিছনে উঠেন।’
খুব দ্রুত চলে এলাম। কুসুমদের বাড়ি। পৌঁছে দেখি কুসুম দািদর মাথায় পানি ঢালছে। কুসুমের বয়স কত আর হবে? নয় বছরের বেশি না।
ডাক্তার রোগী দেখে বললেন, ‘ওনার যা অবস্থা। সদর হাসপাতালে ভর্তি করে দিলে ভাল হয়। বাসায় রাখা ঠিক হবে না।’
ডাক্তারকে আমি ভিজিট দিতে চেষ্টা করলাম। তিনি নিলেন না। হাসলেন। বললেন, ‘থ্যাঙ্কু। চলুন আপনাকে নামিয়ে দেই।’ আমি আবার তার বাইকের পিছনে উঠলাম।
ডাক্তার জানতে চাইলেন, ‘রোগী আপনার কে হয়?’
বিষয়টা আমি খুলে বললাম।
সাইকেল চালিয়ে ফিরে আসতে আসতে ভাবলাম কি করা যায়।
আজ ক্লাস মিস দিতে হবে। ক্লাস নিতে পারব না। আমি কলাকোপা কোকিলপ্যারী স্কুলের ইংরেজীর শিক্ষক। হেড স্যারকে মোবাইলে জানালাম বিষয়টা।
স্যার বললেন, ‘ঠিক আছে।’
কুসুমদের বাড়ির সামনে এসে বেল বাজালাম। ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
‘দাদি কেমন আছেন?’
‘ঘুমাচ্ছে। আপনি তো লোকটা সুবিধার না।’
আমি হেসে ফেলি।
‘কেন, কি করলাম?’
‘আমি ভেবেছি, আপনি আমাদের দুজনের জন্য পাউরুটি আর কলা নিয়ে আসবেন। আমরা তো কাল থেকে না খেয়ে আছি।’
আমি আবার ছুটে গেলাম বাজারের দিকে। কলা আর পাউরুটি নিয়ে ফিরে এলাম। কুসুমের হাতে তুলে দিলাম। কুসুম আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে কলা আর পাউরুটি নিল। বলল, ‘ভাল হইল। বুড়িটা না খেয়ে আছে।’
একটু একটু করে পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে দাদির মুখে দিতে লাগল। আর দাদি আস্তে আস্তে চিবাতে লাগল।
‘তুমি খাবে না?’
কুসুম বলে, ‘দাদিকে আগে খাওয়াই। অসুস্থ মানুষ। আমি তো আর অসুস্থ না।’
আমি ওর কথা শুনে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।
‘স্যার আপনাকে চা বানিয়ে দিই। কিন্তু ঘরে দুধ নাই, চিনি নাই। চা পাতাও নাই।’
‘তাহলে চায়ের কথা বললে যে!’
কুসুম মাথা নেড়ে বলে, ‘ভদ্রতা বলে একটা কথা আছে না।’
কুসুমদের বাড়ির সামনে একটি ভ্যান এসে দাঁড়ায়। ভ্যানের কথা আগেই বলে এসেছিলাম।
ভ্যানের দুজন আর আমি ধরাধরি করে দাদিকে ভ্যানে তুলি। ভ্যানওয়ালা আমাকে জিজ্ঞেস করে,
‘বুড়ি স্যারের কি লাগে?’
‘আমার আত্মীয়।’ আমি বলি।
আমাদের ভ্যান সদর হাসপাতালের দিকে ছুটতে থাকে। ভ্যানের পিছনে পিছনে আমি সাইকেল চালিয়ে ছুটতে থাকি।
দুপুরের মধ্যেই কুসুমের দাদিকে ভর্তি করা হয়। আমি কুসুমকে বলি, ‘আমাকে তো এখন যেতে হবে। তুমি থাক দাদির কাছে। আমি নার্সদের সব বলে দিয়েছি।’
‘আমি একা থাকব?’ কুসুমের চোখে পানি।
আমি একটু সময় নিয়ে বলি, ‘তুমি একা কেন। ডাক্তার আছেন। নার্সরা আছেন। আর তোমার দাদি তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যাবেন। আমি স্কুলে যাবার আগে কালকে চলে আসব।’
কুসুম আমার পাঞ্জাবি শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। আমাকে কিছুতেই ছাড়বে না। হঠাৎই পাঞ্জাবি ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘জান, আপনি মানুষটা খুব একটা ভাল না।’
আমি ওর কথায় হাসি। ওর মাথায় হাত রাখি। ও এক ঝটকায় ওর মাথা থেকে আমার হাত সরিয়ে দেয়।
রাতে আমার ভাল ঘুম হলো না। বারবার স্বপ্ন দেখলাম কুসুমকে। সে আমার পাঞ্জাবি শক্ত করে ধরে আছে।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই চলে গেলাম হাসপাতালে। দেখলাম কুসুম দাদির বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। জানতে চাইলাম, ‘কেমন আছ কুসুম?’
সে কোন উত্তর দিল না।
বেশ কিছুক্ষণ পর বলল, ‘ডাক্তার সাহেব আপনাকে দেখা করতে বলেছেন।’ আমি ডাক্তারের কাছে ছুটে গেলাম।
‘ওনার অবস্থার কোন পরিবর্তন সম্ভব হবে না। যতদিন বাঁচবেন ওভাবেই থাকতে হবে। তারপরও সপ্তাহখানেক আমাদের এখানে থাকুক।’ ডাক্তার জানালেন।
আমি কুসুমের কাছে চলে এলাম। ওর দাদি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কেডা? ডাক্তার নাকি?’
কুসুম এগিয়ে এসে বলল, ‘দাদি উনি মাস্টার।’
দাদি আর কিছু বলল না।
আমি পাঞ্জাবির পকেট থেকে কয়েকটি চকোলেট বের করে ওর হাতে দিলাম। ও নার্সদের দিকে এগিয়ে গেল। বলল, ‘আমার চাচা আপনাদের জন্য চকোলেট নিয়ে আসছে।’ সে সবাইকে চকোলেট বিলিয়ে দিল। নিজের জন্য একটাও রাখল না।
কুসুমকে বলি, ‘যাই। স্কুলে যেতে হবে।’
কুসুমের বড় দুটি চোখ। মায়া ভরা। আমার চোখে চোখ রেখে বলে, আমি গতকাল একটি স্বপ্ন দেখেছি।
‘কি স্বপ্ন?’
‘দেখলাম, আমি আপনার মতো সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছি পড়াতে। আমিও আপনার মতো মাস্টার হয়েছি।’ বলেই সে খিলখিল করে হেসে ওঠে।
বলে, ‘কিন্তু আমি তো পড়লেখাই জানি না। স্কুলেই পড়ি না। মাস্টার হব কীভাবে?’
সাতদিন পর কুসুমের দাদি বাড়ি ফিরে এল। এখন কুসুম প্রতিদিন বাড়ির সামনে বসে থাকে। আমি যখন স্কুলে যাই। সাইকেল থামিয়ে ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলি।
সেদিন সাইকেল থামানোর পরই সে আমার দিকে ছুটে এল। হাতে একটি কঁচি শসা। সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘স্কুলে ক্ষুধা লাগলে এটা খাবেন।’
শসা হাতে নিয়ে আমার চোখ ভিজে উঠল।
স্কুলে গিয়ে কুসুমের ভর্তির ব্যবস্থা করলাম। ক্লাস ওয়ানের বইও সংগ্রহ করলাম।
পরের দিন ওদের বাড়ির সামনে এসে সাইকেল থামালাম। ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
দৌঁড়ে ছুটে এল কুসুম।
বললাম, ‘আমার সাইকেলের পিছনে উঠে বস। তোমাকে আজ থেকে স্কুলে যেতে হবে।’
‘কিন্তু দাদি তো একা থাকতে পারবে না।’
বললাম, ‘পারবে। উনি তো এখন একটু ভাল হয়েছেন।’
কুসুম সাইকেলে উঠে বসল।
আমি সাইকেল চালাতে চালাতে বলি, ‘কুসুম...।’
‘জি।’
‘তুমি এখন ভাবতে থাক। বড় হয়ে তুমি আমার মতো সাইকেল চালিয়ে স্কুলে পড়াতে যাবে।’
হঠাৎ গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। আমরা দুজনে ভিজতে ভিজতে স্কুলে পৌঁছে গেলাম।
অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
শীর্ষ সংবাদ: