ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মৌলভীবাজার কাঁচাবাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা চরম অনিশ্চয়তায়

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ১৪ অক্টোবর ২০১৭

মৌলভীবাজার কাঁচাবাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা চরম অনিশ্চয়তায়

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার কাঁচাবাজারের তিন শতাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জীবন-জীবিকায় চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন মালিকানাধীন মৌলভীবাজার কাঁচাবাজার মার্কেট ভুয়া দলিল দেখিয়ে অবৈধভাবে জমি বিক্রি করে দিচ্ছে দালাল চক্র। বর্তমান মার্কেটের প্রতিকাঠা জমি বিক্রি হচ্ছে ৭৫ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে ভোজ্যতেল ও চিনি ব্যবসায়ী মাহফুজ আলম গত ২০ জুন আড়াই কাঠা জমি কিনেছেন। জমি বিক্রি প্রতিরোধে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন সম্প্রতি কঠোর নির্দেশনা দিয়ে ওই মার্কেটের সামনে সাইন বোর্ড টানিয়ে দিয়েছেন। মেয়রের নির্দেশ থাকার পরও কিন্তু দালাল চক্রের তৎপরতা থামেনি। এখনও গোপনে জমি বিক্রির পাঁয়তারা চলছে। বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ দিয়ে মেয়রের নির্দেশনায় বলা হয়েছে ‘মৌলভীবাজার, কাঁচাবাজারের এই জমির মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। কাঁচাবাজারের এই জমি যারা অবৈধভাবে বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত তাদেরকে বেচাকেনা না করার জন্য সাবধান করে দেয়া হলো। জানা গেছে, মাহফুজ আলমের কেনা জমিটি তেজগাঁও ভূমি অফিসে এই জমি রেজিস্ট্রি ৩৫১৯ নম্বরে দলিল করা হয়েছে। জমি কেনা বাবদ তিনি ১ কোটি ৪৩ লাখ ১২ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। অভিযোগ আছে, সরকারী মার্কেট হওয়া সত্ত্বেও মার্কেটটি পুরোপুরি ভোগদখলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পুরান ঢাকার দুধ ব্যবসায়ী হাজি বশির। তিনি জমির ভুয়া দলিল বের করে জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান। মৌলভীবাজার ব্যবসায়ীরা জানান, গুটিকয়েক অসাধু ব্যক্তি মার্কেটটির ভুয়া কাগজপত্র করে বিক্রি করার পাঁয়তারা করছে। একটি সরকারী মার্কেট চোখের সামনে বিক্রি করার নামে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। আর যারা জমি কিনছেন তারাও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। ইতোমধ্যে দু’একজন জমি কিনেছেন। আর তাই এ ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। তারা বলছেন, কর্তৃপক্ষ যদি মার্কেটটি বিক্রি করে দেয় তাহলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এটি করতে পারে। অথবা সিটি কর্পোরেশনের অন্যান্য মার্কেট যেভাবে পরিচালনা করা হয়, এটিও সেভাবে পরিচালনা করা হোক। অন্যথায় এই মার্কেট ঘিরে পুরান ঢাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া ভূমিদস্যু চক্রটি জেলা প্রশাসক অফিসের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশের কারণে মার্কেটটি সিটি কর্পোরেশন বুঝে নিতে পারছে না। এ কারণে মার্কেটটি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য আটবার তাগাদাপত্র দেয়ার পরও তা আমলে নেয়নি জেলা প্রশাসক অফিস। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদের সময় মৌলভীবাজারের ৫৩ শতাংশ জমি এ্যাকোয়ার করা হয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নামে। জমি এ্যাকোয়ার করার পর মালিকদের মধ্যে সাড়ে ৭৮ লাখ টাকা পরিশোধ করে সিটি কর্পোরেশন। মালিক না পাওয়ায় বাকি ২৩ লাখ টাকা আর পরিশোধ করা হয়নি। পরবর্তীতে মামলা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ২ শতাংশ জমি ছেড়ে দেয়া হয়। এই জমির প্রকৃত মালিক ছিলেন পুরান ঢাকার বাসিন্দা এমদাদ বেপারি গং। এ্যাকোয়ার করার পর সিটি কর্পোরেশনের নামে মার্কেটটি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ঢাকা জেলা প্রশাসক বরাবর ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার চিঠি দিয়েছে সিটি কর্পোরেশনের সম্পদ বিভাগ। সর্বশেষ গত দুই মাস আগেও মার্কেট বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ৮নং তাগাদাপত্র দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পদ কর্মকর্তা মোঃ কামরুল ইসলাম সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, মৌলভীবাজার কাঁচাবাজার মার্কেটটি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মার্কেট। আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে ৫৩ শতাংশ জমি এ্যাকোয়ার করে ক্ষতিগ্রস্ত পার্টিকে টাকা পরিশোধ করে জায়গাটুকু সিটি কর্পোরেশনের নামে নেয়া হয়। ইতোমধ্যে এই জায়গা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ডিসি বরাবর কয়েকদফা আবেদন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ৩০ বছর আগে এই জমি বাবদ সরকার ১ কোটি ১ লাখ টাকা পরিশোধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরবর্তীতে জমির মালিক বা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ৭৮ লাখ টাকা জমির মূল্য বাবদ পরিশোধ করা হয়। বাকি জমিদাতাদের পাওয়া না যাওয়ায় ২৩ লাখ টাকা আর পরিশোধ করা হয়নি। যেহেতু সিটি কর্পোরেশন জমির মালিকানা বাবদ টাকা পরিশোধ করেছে তাই মার্কেটটি সিটি কপেূারেশনেরই। এই মার্কেটের একটি ইটও কারও বিক্রি করার কোন সুযোগ ে নেই। তিনি বলেন, শীঘ্রই মার্কেটটি সিটি কর্পোরেশন তার নিয়ন্ত্রণে নেবে। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক জমি কেনাবেচার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সতর্ক করে বলেন, এ ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকুন। সরকারী সম্পত্তি কারও বিক্রি করার ক্ষমতা নেই। তাই যারা না বুঝে এ ধরনের কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছেন শীঘ্রই তাদের চূড়ান্ত পরিণতি ভোগ করতে হবে। জানা গেছে, তিন দশক আগে কেনা সিটি কর্পোরেশনের এই মার্কেটের জমির দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ গুণ। সরকারী এই সম্পত্তির ওপর তথা মার্কেটে বর্তমানে প্রায় ৩ শতাধিক দোকান রয়েছে। মাছ, মাংস সবজিসহ সবই পাওয়া যায় এই মার্কেটে। পুরান ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে এই মার্কেটেই ওই এলাকার অধিকাংশ মানুষ দৈনন্দিন বাজার করে থাকেন। কিন্তু এসব দিক বিবেচনায় না নিয়েই ভূমিদস্যু হাজি বশিরের কারসাজিতে ভুয়া দলিলের মাধ্যমে মার্কেটটির জমি বেচাকেনা করে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। এতে করে যারা সারা জীবনের কষ্টার্জিত পয়সা দিয়ে জমি কিনছেন তারা বড় ধরনের প্রতারণার শিকার হয়ে রাস্তার ফকির হতে পারেন। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন মেয়র সাঈদ খোকনের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী সচিব কবির মাহমুদ জনকণ্ঠকে বলেন, এই মার্কেট সিটি কর্পোরেশনের। এটি দখল বা জমি বিক্রি করার কোন সুযোগ নেই। শীঘ্রই সিটি কর্পোরেশন মার্কেটটি বুঝে নেবে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে মেয়র মহোদয় অবগত আছেন। ইতোমধ্যে ঢাকা জেলা প্রশাসককেও এ ব্যাপারে অবহিত করা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। এদিকে, মৌলভীবাজারের ভোগ্যপণ্যের পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই মার্কেটের ওপরই তাদের জীবন-জীবিকা নির্ভর করছে। তাই এই মার্কেট যাতে কোনভাবেই দখল না হয় সেদিকে নজর দেয়ার দাবি জানান তারা। তারা বলছেন, যদি সিটি কর্পোরেশন এখানে বড় মার্কেট করে তাহলে নিচে যাতে কাঁচাবাজার থাকে সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে। অন্যথায় এই মার্কেটের ৩ শতাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে রাস্তায় নামতে হবে। মৌলভীবাজারের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, মার্কেটটি ডেভেলপ করেও নিচে কাঁচা মার্কেট রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া হাইরাইজ বিল্ডিং করে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে দোকান বরাদ্দ দিলে সিটি কর্পোরেশন বড় অঙ্কের রাজস্ব পাবে। বাড়বে সিটি কর্পোরেশনের আয়ও। জমি বিক্রি সংক্রান্ত ব্যাপারে জানতে চাইলে দুধ ব্যবসায়ী হাজি বশির জানান, মৌলভীবাজার সিটি কর্পোরেশন মার্কেটটি কোন সরকারী জায়গা না। এটা ব্যক্তিমালিকানার একটি মার্কেট। এই জমির মালিক নিয়মিত জমি বাবদ ট্যাক্স ও কর দিয়ে আসছে দীর্ঘদিন যাবত। তাহলে এটা কিভাবে সরকারের জমি হলো সেটা আমার বোধগম্য নয়।
×