ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সীমান্ত ও বিমান বন্দরে রেড এলার্ট

প্রকাশিত: ০৫:১১, ৭ অক্টোবর ২০১৭

সীমান্ত ও বিমান বন্দরে রেড এলার্ট

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রোহিঙ্গা ইস্যুতে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে রেডএলার্ট জারি করা হয়েছে স্থলসীমান্ত ও বিমানবন্দরগুলোতে। বিশেষ কারণ ছাড়া ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী দেশী-বিদেশী নারী-পুরুষের পাকিস্তান, সিরিয়া ও ইরাকে যাতায়াত একপ্রকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে তালিকাভুক্ত পলাতক জঙ্গীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। আর কূটনৈতিক পাড়া হিসেবে পরিচিত রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদিও গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তুরাঁয় জঙ্গীদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর এলাকাটিতে এমনিতেই কড়া নিরাপত্তা রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে এমন তথ্য মিলেছে। সংশ্লিষ্ট এই সূত্রে আরও জানা গেছে, রোহিঙ্গা ইস্যুকে কোন কোন গোষ্ঠী কাজে লাগানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। স্বাধীনতাবিরোধী একটি ইসলামী দল অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোকে উস্কে দিতে নানা প্রচারণা চালাচ্ছে। যেসব দেশ মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে জঙ্গীদের দিয়ে সেসব দেশের নাগরিকদের ওপর হামলা চালানোর জন্য প্ররোচিত করা হচ্ছে। সম্প্রতি মিয়ানমারকে উচিত শিক্ষা দিতে হুমকি দিয়েছে হালের আলোচনায় থাকা ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এ সুযোগে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জঙ্গীগোষ্ঠী আইএসের সান্নিধ্য লাভ এবং দেশে আইএসের তৎপরতা থাকার প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করছে গোষ্ঠীটি। যাতে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ চাপে থাকে। সূত্রটি দীর্ঘদিন ভারতে পলাতক থাকার পর সম্প্রতি দেশে গ্রেফতার হওয়া জেএমবির শীর্ষ নেতা হাতকাটা মাহফুজের বরাত দিয়ে বলছে, দেশে ও দেশের বাইরে পলাতক থাকা জঙ্গীরা গোপনে সক্রিয় রয়েছে। তারা পাকিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় থাকা বাংলাদেশী জঙ্গীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। ইরাক ও সিরিয়ায় থাকা বাংলাদেশী জঙ্গীরা বাংলাদেশে প্রবেশ করে মিয়ানমারের ঘটনার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে কাজ করছে। তবে এমন জিহাদে ইরাক ও সিরিয়ার জঙ্গীদের তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে থাকা বাংলাদেশী এবং দেশ দুটির বিভিন্ন জঙ্গী সদস্যরা। তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে মিয়ানমারের ঘটনার প্রতিশোধ নিতে বড় ধরনের নাশকতা চালাতে চায়। একাজে সহায়তা করছে বাংলাদেশী পাসপোর্ট তৈরি করে পাকিস্তানে জঙ্গী প্রশিক্ষণক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা জঙ্গী আব্দুল করিম টুন্ডা। তার সঙ্গে পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন ছাড়াও দেশটির জামায়াত নেতাদের যোগাযোগ রয়েছে। আব্দুল করিম টুন্ডা মূলত জেএমবির সদস্য। জেএমবির আমীর ও জামায়াতে ইসলামের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা কারাবন্দী মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের জামাই ইজাজ ওরফে কারগিল। এর হাত ধরেই আব্দুল করিম টুন্ডা জেএমবিতে যোগ দিয়ে উচ্চতর জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিতে ২০০৯ সাল থেকে ইজাজের সঙ্গে পাকিস্তানে যায়। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়া জঙ্গীদের ট্রেনিং, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকে আব্দুল করিম টুন্ডা। যাওয়ার পর থেকেই তারা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অবস্থান করে ট্রেনিং নিচ্ছিল। এমন অবস্থার মধ্যেই ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানের পাখতুনখোয়া প্রদেশের পেশোয়ারের সেনাবাহিনী পরিচালিত আর্মি পাবলিক স্কুলে ৬ জঙ্গী সশস্ত্র বোমা হামলা ও গুলি চালায়। জঙ্গীরা স্কুলের ৮ শিক্ষককে জীবন্ত পুড়িয়ে ও গুলি চালিয়ে হত্যা করে। এমন দৃশ্য দেখতে স্কুলটির ১৪২ খুদে শিক্ষার্থীকে বাধ্য করে। শিক্ষকদের হত্যার পর শিক্ষার্থীদের ব্রাশফায়ারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকায় ২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর চার জঙ্গী আব্দুস সালাম, হজরত আলী, মুজিবুর রেহমান ও সাবিল ওরফে ইয়াহিয়ার ফাঁসি কার্যকর করা হয় খাইবার পাখতুনখোয়ার কোহাটে অবস্থিত একটি কারাগারে। হামলার দায় স্বীকার করে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। সংগঠনটির দাবি, উত্তর ওয়াজিরিস্তানে তালেবানের ঘাঁটি জার্ব-ই-আজবে সেনা অভিযানের প্রতিশোধ হিসেবে হামলাটি চালানো হয়। এমন ঘটনার পর থেকে পাকিস্তানে জঙ্গী ঘাঁটিতে সাঁড়াশি অভিযান চলতে থাকে। সেই অভিযানের ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি জেএমবির আমীর জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সদস্য মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের জামাই সাজ্জাত ওরফে ইজাজ ওরফে কারগিল, ইজাজের ভায়রা জেএমবি আমীর সাইদুর রহমানের গ্রেফতারকৃত আরেক জামাই সাখাওয়াতুল কবিরের ভাগ্নি জামাই অভি, গ্রেফতারকৃত জঙ্গী নেতা আব্দুল বাতেনের বোন পাকিস্তানে অবস্থিত ফাতেমার স্বামী সায়েম ও সায়েমের দুলাভাই শামীম নিহত হয়। নিহতরা জঙ্গী ক্যাম্পে অবস্থান করছিল। এরপরেও টুন্ডা পাকিস্তানেই অবস্থান করে বাংলাদেশী জঙ্গীদের ট্রেনিং ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা অদ্যাবধি করে আসছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মূলত টুন্ডা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে অবস্থানরত বাংলাদেশী এবং দেশ দুটির জঙ্গীদের বাংলাদেশে প্রবেশ করানোর চেষ্টা করছে। তারা বাংলাদেশে ঢুকে বড় ধরনের আত্মঘাতী হামলা করে মিয়ানমারের ঘটনার প্রতিশোধ নিতে চায়। সে লক্ষ্যে তারা বাংলাদেশে পলাতক কোন কোন জঙ্গীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। বিদেশ থেকে কোন জঙ্গী যাতে দেশে প্রবেশ করতে না পারে, এজন্য স্থল সীমান্ত ও বিমানবন্দরগুলোতে রেডএলার্ট জারি করা হয়েছে। বিশেষ বয়স ও কারণ ছাড়া পাকিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় যাতায়াত একপ্রকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর দেশে পলাতক থাকা জঙ্গীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। পুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে বিশেষ নির্দেশনা মোতাবেক সারাদেশেই চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের শরণার্থী শিবিরে থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে তাদের সম্পর্কে তথ্য সংরক্ষণের কাজ চলছে। দেশী-বিদেশী জঙ্গীদের যাতায়াত ঠেকাতে স্থল সীমান্তে ও বিমানবন্দরগুলোতে কড়াকড়ি আরোপ রয়েছে। ভারতের তিহার জেলে বন্দী একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় সরাসরি জড়িত দুই আসামি সহোদর মুরসালিন ও মুত্তাকিন যাতে কোন তৎপরতা না চালাতে পারে এজন্য তাদের ওপর বাড়তি নজর রাখছে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন) সংগঠনের সদস্যদের ওপর নজরদারি চালানো হচ্ছে। কূটনৈতিক পাড়ার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের চ্যান্সারী বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন জানান, হলি আর্টিজানে হামলার পর কূটনৈতিক পাড়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি রোহিঙ্গা ইস্যুর নিয়ে নিরাপত্তার দিকটিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। গুলশানে অন্তত ৬ শতাধিক সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। কূটনৈতিক পাড়ায় থাকা ৪৮ দেশের দূতাবাসে নিয়মিত পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য বিদেশী অফিস আদালতেও নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। নিয়মিত দূতাবাসগুলোর সঙ্গে তাদের বৈঠক হচ্ছে।
×