ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভুয়া বিল-ভাউচারে টিআরের সিংহভাগ টাকা আত্মসাত

সাঁথিয়ায় ৫০ প্রকল্পে লুটপাট

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ৫ অক্টোবর ২০১৭

সাঁথিয়ায় ৫০ প্রকল্পে  লুটপাট

নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা, ৪ অক্টোবর ॥ সাঁথিয়া উপজেলার নন্দনপুর ইউনিয়নে গত অর্থবছরে ৫০ টি গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ৪৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রকল্প তালিকায় শুধু গোবিন্দপুর গ্রামেই ২৯টি প্রকল্প রয়েছে। এদিকে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা গত জুন ফাইনালে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে বরাদ্দের সিংহভাগ টাকা আত্মসাত করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নন্দনপুর ইউনিয়নের সচেতন নাগরিক সমাজ এ ঘটনার তদন্ত দাবি জানিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগে জানা যায়, সাঁথিয়া উপজেলার নন্দনপুর ইউনিয়নে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচীর আওতায় ৫০টি প্রকল্পের বিপরীতে সাড়ে ৪৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ৩০ জুন। গত ২২ জুন সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার যৌথ স্বাক্ষরে ৫০টি প্রকল্প পিআইসিকে প্রথম কিস্তির অগ্রিম টাকা প্রদান করা হয়। বিভিন্ন নামে নেয়া এসব প্রকল্পের একটি থেকে আরেকটি প্রকল্পের দূরত্ব ২০ থেকে ৩০ গজ। ওই ইউনিয়নের ৫০টি প্রকল্পের মধ্যে শুধু গোবিন্দপুর গ্রামেই রয়েছে ২৯টি প্রকল্প। যার বেশিরভাগই ভুয়া বলে অভিযোগ উঠেছে। নন্দনপুর ইউনিয়নের টিআর প্রকল্পগুলো হচ্ছে গোবিন্দপুর পাকা রাস্তা হতে সাত্তারের বাড়ি পর্যন্ত , গোবিন্দপুর সাত্তারের বাড়ি হতে আনার মুন্সির জমি পর্যন্ত, আনার মুন্সির বাড়ি হতে রইজের বাড়ি পর্যন্ত, রইজের বাড়ি হতে আকবরের বাড়ি পর্যন্ত, আকবরের বাড়ি হতে ইমানের বাড়ি পর্যন্ত, ইমানের বাড়ি হতে হাবিবের বাড়ি পর্যন্ত, হাবিবের বাড়ি হতে ওয়াজেদ বাগছির বাড়ি, ওয়াজেদ বাগছির বাড়ি হতে কাশেম বাগছির বাড়ি, কাশেম বাগছির জমি হতে মজিদের বাড়ি, মজিদের বাড়ি হতে ইউনুছের বাড়ি, ইউনুছের বাড়ি হতে মালেকের বাড়ি, মালেকের বাড়ি হতে উসমানের বাড়ি, উসমানের বাড়ি হতে কালামের বাড়ি, কালামের বাড়ি হতে আক্কাসের বাড়ি, আক্কাছের জমি হতে জনমের বাড়ি, জনমের বাড়ি হতে রিয়াজ ম-লের বাড়ি, রিয়াজ ম-লের জমি হতে আনার মুন্সির বাড়ি, আনার মুন্সির বাড়ি হতে আনার মুন্সির জমি, কৃষ্ণপুর রউফের বাড়ি হতে রনজের বাড়ি পর্যন্ত, রনজের বাড়ির হতে সামসুলের বাড়ি পর্যন্ত, নন্দনপুর পাকা রাস্তা হতে আরিফের বাড়ি, আরিফের বাড়ি হতে সামসুলের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার। চক-নন্দনপুর পাকা রাস্তা হতে জলিলের বাড়ি, বাবুর বাড়ি হতে মোকাদ্দেসের বাড়ি, স্বরপ নজরুলের বাড়ি হতে নজুর বাড়ি, নজরুলের বাড়ি হতে ফজলুর বাড়ি, চক-নন্দনপুর পাকা রাস্তা হতে ইয়াছিনের বাড়ি, রাস্তা সংস্কার, ইয়াছিনের বাড়ি হতে শুকুরের বাড়ি, শুকুরের বাড়ি হতে মোসলেমের বাড়ি, জোরগাছা মাজেদের বাড়ি হতে আনছারের বাড়ি, আনছারের বাড়ি হতে আলতাবের বাড়ি, আলতাবের বাড়ি হতে আশরাফের বাড়ি, জোড়গাছা পাকা রাস্তা হতে মাহাতাবের বাড়ি, রশিদের বাড়ির সামনের রাস্তা, জোড়গাছা পাকা রাস্তা হতে হাসপাতাল, জোরগাছা পাকা রাস্তা হতে শাহীনের পুকুরপার, দারামুদা এতিমখানা হতে মতিন মাস্টারের বাড়ি, দাড়ামুদা কালামের বাড়ি হতে মসজিদ, দাড়ামুদা মসজিদ হতে স্কুল পর্যন্ত। আবার দাড়ামুদা স্কুল হতে দুলালের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার, জোড়গাছা মসজিদ সংস্কার, জোড়গাছা কবরস্থান সংস্কার, জোড়গাছা আব্দুল গনি মাদ্রাসা মাঠ মাটি ভরাট, জোড়গাছা এতিমখানা মাটি ভরাট, স্বরূপ জামে মসজিদ সংস্কার, নন্দনপুর বাজার মসজিদ সংস্কার, নন্দনপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠ মাটি ভরাট, চকনন্দনপুর জামে মসজিদ মাটি ভরাট। অভিযোগে জানা যায়, প্রকল্পের বিপরীতে সাড়ে ৪৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রকল্প কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ৩০ জুন। গত ২২ জুন সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার যৌথ স্বাক্ষরে ৫০টি প্রকল্প পিআইসিকে প্রথম কিস্তির প্রায় ২২ লাখ টাকা অগ্রিম প্রদান করা হয়। ৩০ জুন কাজ শেষ হওয়া তো দূরের কথা এ সময়ে প্রকল্প পিআইসিরা কোন কাজই করেনি। ফলে নিয়ম অনুয়ায়ী প্রকল্পের দ্বিতীয় কিস্তির টাকা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু তা না করে সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে প্রকল্প কাজ সমাপ্ত দেখান এবং ৫০টি প্রকল্পের দ্বিতীয় কিস্তির বরাদ্দ প্রায় ২১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করেন। তবে এই টাকা প্রকল্প পিআইসিদের দেয়া হয়নি। এদিকে এই ঘটনায় ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা প্রকল্প পিআইসিদের কাজ করার জন্য জোর তাগিদ দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, বেশিরভাগ প্রকল্পেই মাটি ভরাট বা সংস্কার কাজ করা হয়নি। কিছু কিছু প্রকল্পে লোক দেখানো নামমাত্র মাটি ফেলে দায়সারাভাবে কাজ শেষ করা হয়েছে। আবার দেখা গেছে, একই রাস্তাকে ৩ ভাগ করে তিনটি প্রকল্প করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে। নন্দনপুর ইউনিয়নে ২৮টি গ্রাম রয়েছে। অথচ ৫০টি প্রকল্পের মধ্যে শুধু গোবিন্দপুর গ্রামেই ২৯টি প্রকল্প দেয়া হয়েছে, যার বেশিরভাগই ভুয়া বলে অভিযোগ উঠেছে। চকনন্দনপুর পাকা রাস্তা হতে জলিলের বাড়ি, বাবুর বাড়ি হতে মোকদ্দেসের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় কোন সংস্কার কাজ করা হয়নি। চকনন্দনপুর জামে মসজিদ মাঠে মাটি ভরাটের কথা ছিল, সেখানে মাটি ভরাট করা হয়নি। ওই ইউনিয়নের চকনন্দনপুর জামে মসজিদের সভাপতি সাবেক ইউপি সদস্য মুক্তিযোদ্ধা দৌলত হোসেন জানান, এ প্রকল্পের ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। মসজিদের জায়গায় কোন মাটি ফেলা হয়নি। চকনন্দনপুর পাকা রাস্তা হতে ইয়াছিনের বাড়ি, ইয়াছিনের বাড়ি হতে শুকুরের বাড়ি, শুকুরের বাড়ি হতে মোসলেমের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের যে প্রকল্প নেয়া হয়েছে সেখানে মাটি ভরাটের কথা ছিল। অথচ মাটি ভরাট করা হয়নি। ওই রাস্তায় সাঁথিয়া উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদফতর থেকে মাটি ফেলে হেরিংবন্ডের কাজ করা হচ্ছে। অথচ এই রাস্তায় টিআরের তিনটি ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে বরাদ্দের সমুদয় টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। সাঁথিয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, টিআর প্রকল্পগুলোর কাজ চলমান রয়েছে। গত ৩০ জুন ফাইনালে টাকা উত্তোলন না করলে ফেরত চলে যেত সে জন্য টাকা উত্তোলন করে পিআইসিদের দেয়া হয়েছে। এখন তাদের কাছ থেকে কাজ বুঝে নেয়া হচ্ছে। এক গ্রামেই ২৯টি প্রকল্প প্রসঙ্গে তিনি জানান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পগুলো অনুমোদন হয়ে এসেছে এখানে আমাদের করার কিছুই নেই। নন্দনপুর ইউপি চেয়ারম্যান লিটন মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস থেকে বরাদ্দের প্রথম কিস্তির সাড়ে ২১ লাখ টাকা পিআইসিদের দেয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা যৌথ স্বাক্ষরে গত ৩০ জুন দ্বিতীয় কিস্তির ২২ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করেছেন। সেই টাকা আজ পর্যন্ত প্রকল্প পিআইসিদের দেয়া হয়নি। এ ব্যাপরে সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহাঙ্গীর আলম নন্দনপুর ইউনিয়নের সচেতন নাগরিক সমাজের লিখিত অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে জানান, প্রকল্পের দ্বিতীয় কিস্তির টাকা ব্যাংক থেকে তুলে রেখে দেয়া হয়েছে। কাজ শেষ হওয়ার পর প্রকল্পগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করে কাজের গুণগত মান দেখে তবেই পিআইসিদের দ্বিতীয় কিস্তির টাকা প্রদান করা হবে।
×