ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বর্মী নিধনযজ্ঞে মিলছে গণকবর

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বর্মী নিধনযজ্ঞে মিলছে গণকবর

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ সেনা বর্বরতায় রাখাইন রাজ্য এখন প্রেতপুরীর রূপ নিয়ে আছে। বিভিন্ন স্থানে গণকবরের সন্ধান মিলছে। ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, সোমবার মংডুর ফকিরাবাজারে পাহাড়ের পাদদেশে ২৮ রোহিঙ্গার গলিত লাশ উদ্ধার হয়েছে। এর আগে মংডুর শহরতলীর একটি পরিত্যক্ত নদী দুটি অংশ থেকে দুটি গণকবরের সন্ধান মেলে। এছাড়া রবিবার তুমব্রু সীমান্তের ওপারে একটি এলাকা থেকে ৮ হাজার রোহিঙ্গা জিরো পয়েন্টে আশ্রয় নিয়েছে। সব মিলে বর্তমানে ২৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা জিরো পয়েন্টে আটকা পড়ে আছে। ফিরে যাবার আশায় তারা এপারে আসছে না। আবার প্রাণ নিয়ে শঙ্কা থাকায় নিজেদের বসতবাড়িতেও ফিরতে ভয় পাচ্ছে। এদিকে, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কাঁটাতারের বেড়ার সংস্কার কাজ দ্রুতগতিতে চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি। এছাড়া বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে মাইন স্থাপনের কাজও প্রায় শেষ করা হয়েছে। জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন এলাকাগুলোতে ইতোমধ্যে এ জাতীয় মাইন স্থাপন করার পর সীমান্ত থেকে রাখাইন রাজ্যমুখী বিভিন্ন সড়কপথেও এ জাতীয় মাইন পোতা হচ্ছে বলে ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক সকল আইন-কানুন উপেক্ষা করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী এ জাতীয় কর্মকা- শুরু করার পর এখন তা প্রায় সমাপ্তির পথে। এদিকে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমনের ঢলও হ্রাস পেয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ফাঁকফোকরে কিছু রোহিঙ্গা পরিবার সীমান্ত অতিক্রম করছে। গত ২৫ আগস্ট রাত থেকে সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী ৬ সহ¯্রাধিক রোহিঙ্গাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝেও ত্রাণ সহায়তা ও বসতি গড়ে তুলতে সেনাবাহিনী কাজ শুরু করার পর ইতোপূর্বেকার তুলনায় বহুগুণে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। তবে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে। সোমবার সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। বিচ্ছিন্নভাবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ এখনও অব্যাহত। তবে সোমবার রাখাইন রাজ্যে জ্বালাও-পোড়াও ও সেনা বর্বরতার নতুন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। অবস্থাদৃষ্টে ধারণা করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার সেনাবাহিনীকে সংযত অবস্থানে নেয়ার তৎপরতা চালাচ্ছে। সেনা কার্যক্রম ॥ সেনা কার্যক্রম শুরু হওয়ায় গত ৩ দিনে রোহিঙ্গা আশ্রয় পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মাঝে সুষ্ঠু ও সমন্বিতভাবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পরিবার প্রতি একটি করে ত্রাণকার্ড দেয়া হবে। দু’এক দিনের মধ্যে এ কার্যক্রম শুরু হবে বলে সেনা সূত্রে জানানো হয়েছে। ত্রাণ বিতরণে সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেয়ার পর এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফের মুছনি শরণার্থী ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর করিম। তিনি জানান, সেনাবাহিনী জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে রবিবার থেকে পুরোদমে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ওবায়দুল কাদের ॥ সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সোমবার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনকালে বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ৫ দফা প্রস্তাব বিশ্বের কাছে পৌঁছে গেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কিছু কুচক্রী মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু সরকার এসবে কান দিচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের প্রতি সরকার মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ত্রাণ পেয়ে খুশি রোহিঙ্গারা ॥ সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর রোহিঙ্গারা প্রয়োজনীয় ত্রাণ পেয়ে খুশি। বিশেষ করে শিশুদের মাঝে আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে আসার পরে অধিকাংশ রোহিঙ্গা শিশু ভিক্ষা করতে শুরু করে। এখন ভিক্ষার বদলে ত্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরছে। টেকনাফের রইক্ষ্যং, উখিয়ার বালুখালী, কুতুপালং ও তাজনিরমারখোলা রোহিঙ্গা শিবির থেকে অসংখ্য শিশুকে সোমবার ত্রাণ নিতে দেখা যায়। দুই গর্তে ২৮ রোহিঙ্গার গলিত লাশ ॥ মিয়ানমারের মংডুতে রোহিঙ্গাদের মৃতদেহ ভর্তি আরও দুটি গর্তে গণকবরের সন্ধান পেয়েছে স্থানীয়রা। এখবর মিয়ানমার প্রশাসনকে জানালে তারা রবিবার বিকেলে ঘটনাস্থলে এসে ২৮ জনের লাশ উদ্ধার করে। এসব রোহিঙ্গাকে হত্যা করে গর্ত দুটিতে মাটিচাপা দিয়েছিল বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গা পল্লী ফকিরাবাজার সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশের দুটি গর্ত থেকে মৃতদেহগুলো উদ্ধার করা হয়। ইতোপূর্বে মংডুতে দুটি গণকবর ও একটি লাশে ভরপুর নদীর খোঁজ পেয়েছিল রোহিঙ্গারা। এইচআইভি আক্রান্ত ২ রোহিঙ্গাকে চমেক হাসপাতালে ॥ এইচআইভি আক্রান্ত ২ রোহিঙ্গাকে চিকিৎসার জন্য রবিবার রাতে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পর থেকে এরা উখিয়া শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থান করছিল। ভর্তিকৃত উভয়ই রোহিঙ্গা নারী। একজনের বয়স ৫০ ও অপরজনের ৬০। পিতৃ-মাতৃহীন শিশুর তালিকা হচ্ছে ॥ মিয়ানমারে সহিংসতায় পিতা-মাতা হারিয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত শিশুর তালিকা করা হচ্ছে। তালিকাভুক্ত শিশুর জন্য কল্যাণকর ও মানবিক পদক্ষেপ নেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। প্রাথমিকভাবে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধনের মাধ্যমে এদের একটি পরিচয়পত্র দেয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। নাগরিকত্ব নয়, জন্ম সনদ ॥ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া যেসব রোহিঙ্গা নারীর গর্ভ থেকে শিশু জন্ম নেবে তাদের জন্ম সনদ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু নাগরিকত্ব দেয়া হবে না। রাস্তা তৈরিতে ইউএনএইচসিআরএ’র ৩৫ কোটি টাকা ॥ রোহিঙ্গাদের জন্য অস্থায়ী আবাস নির্মাণে সরকার যে ২ হাজার একর জমি বালুখালীতে বরাদ্দ দিয়েছে তাতে সংযোগ সড়ক ও যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য ইউএনএইচসিআরএ’র পক্ষ থেকে ৩৫ কোটি টাকা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের নতুন ক্যাম্পে শেল্টার নির্মাণও করা হবে।
×