ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা নিয়ে ফেসবুকে মেকিং আর ভুয়া ছবির ছড়াছড়ি!

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা নিয়ে ফেসবুকে মেকিং আর ভুয়া ছবির ছড়াছড়ি!

আরাফাত মুন্না/ এমদাদুল হক তুহিন ॥ দুই রোহিঙ্গা নারীর মাথায় সাদা রঙের কাপড়। হাতের আঙ্গুলগুলো লেগে আছে ঘরের চালে। যেন তারা নিজেদের ঘরের চালা ভাঙ্গছে নিজেরাই! অপর এক ছবিতে রোহিঙ্গা নারীর হাতে রামদা। ঘরের চালে জ¦লছে আগুন! ছবির ভাবভঙ্গিই বলে দেয়Ñ এসব নারী-পুরুষ নিজেই নিজের ঘর পোড়াচ্ছেন। বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে রোহিঙ্গারা নিজেই নিজের ঘর পোড়াচ্ছে বলে বিশ্বে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এমন ছবি উঠাতে ওসব নারী-পুরুষকে বাধ্য করছে। পরে সেসব গণমাধ্যমে পাঠিয়ে ছবির ক্যাপশনে লেখা হচ্ছে, ‘রোহিঙ্গারা নিজের ঘরে আগুন লাগাচ্ছে’! তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি বলছে- ‘ওই দুই ছবিতে ব্যবহৃত এক মহিলা পাশ্বর্বর্তী একটি হিন্দুগ্রাম থেকে এসেছেন। ছবির ওই নারীটি মুসলিম নন।’ ভুয়া এমন বহু ছবি তৈরি করে নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইছে মিয়ানমার। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ছড়িয়ে দেয়া ‘মেকিং ছবি’সহ বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভুল ছবির ছড়াছড়ি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব প্রচারে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশের কট্টরপন্থী ইসলামিক গ্রুপ। মানবতার সর্বোচ্চ বিপর্যয়েরও এই সময়টিতে বাঁশেরকেল্লাসহ একাধিক পেজ থেকে মিথ্যা তথ্য-উপাত্ত প্রচার করা হচ্ছে। এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ক্ষোভে উত্তাল পুরো ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র চলছে নিন্দার ঝড়। ‘মুসলিম হত্যার’ আবেগকে পুঁজি কোন কোন গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক উস্কানিও দিচ্ছে। তবে দেশের অধিকাংশ ফেসবুকারই মিয়ানমারের চলমান এই সহিংসতাকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে দ্রুত ওই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করে দেশটির নাগরিকদের ফেরত নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। একই সঙ্গে সে দেশের নাগরিকদের দ্রুত ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশের সরকারকে আরও উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। রোহিঙ্গা নির্যাতনের শুরু থেকেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভুয়া ছবির ছড়াছড়ি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় জনসাধারণকে সচেতন করতে এক পোস্টে অজন্তা দেব রায় লিখেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ জাতিগত নিপীড়ন হচ্ছে। এটা সত্য কথা। কিন্তু তাই বলে সেটা বোঝানোর জন্য আপনারা যখন পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া নানান ঘটনার ছবিকে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা বলে প্রচার করেন তখন তাতে এই ভুয়া ছবিগুলোর কারণে রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে মানুষের সহমর্মিতা চলে যায়। সুতরাং, রোহিঙ্গাদের স্বার্থেই এসব ভুয়া ছবি প্রচার করে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো ও সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়া বন্ধ করুন।’ একই ধরনের বেশ কয়েকটি ছবি শেয়ার দিতে দেখা গেছে সন্ধীপন বসুকেও। এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যু পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিচ্ছে একটি গোষ্ঠী। বাংলাদেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপর জাতিগত হামলার উস্কানিও দিয়েছে গোষ্ঠীটি। ফেসবুকে তাদের মাত্রাতিরিক্ত প্রচার লক্ষ্য করা গেছে। আহমেদ শাহজাহান নামে এক আইডি থেকে উগ্র সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়া হয়েছে। এক পোস্টে ওই আইডি থেকে লেখা হয়েছে ‘একটা দুইটা বৌদ্ধ ধর ধরিয়া ধরিয়া জবাই কর।’ শাহজাহানের মতো আরও অনেক আইডি থেকে একই রকম পোস্ট লক্ষ্য করা গেছে। ওয়াহিদ হাসান সিন্ধু নামক আইডি থেকে স্বাধীন অন্য একটি দেশের বিরুদ্ধেও উস্কানি দেয়া হচ্ছে। এক ইভেন্ট খুলে (সঙ্গত কারণে নাম উল্লেখ সম্ভব নয়) তিনি এতে নামসর্বস্ব পোর্টালের নিউজ শেয়ার দিয়েছেন। মুহিব খান নামক তথাকথিক মৌলবাদী এক কবির আহ্বান প্রচার করে ওই পোর্টালের খবরে যা উল্লেখ করা হয়েছে, তা স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান পরিপন্থীও। একইভাবে অন্য একটি দেশেরও। ওয়াহিদ হাসান সিন্ধুর মতো আরও বহু ফেসবুকার একই রকম ফাঁদে পা দিয়েছে। এছাড়া কয়েকটি গ্রুপ থেকে মিয়ানমারের পণ্য বর্জনের আহ্বানও এসেছে। ওয়াহিদ হাসান সিন্ধু নামক এক আইডি থেকে লেখা হয়েছে, ‘আজ থেকে বার্মিজ স্যান্ডেল, লুঙ্গি, মাছ, বার্মিজ আচার এবং সকল পণ্য কেনা বন্ধ করুন। এটাও এক ধরনের প্রতিবাদ।’ গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে ‘বার্মিজ পণ্য বর্জন করুন’ নামে একটি ইভেন্টও খোলা হয়েছে। আর ইমরান এইচ সরকার তা শেয়ার দিয়েছেন তার নিজস্ব ফেসবুক ওয়ালে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখন মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাধারণ ফেসবুকারদের অধিকাংশই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার পক্ষে হলেও তাদের দ্রুত প্রত্যাহারের আহ্বানও রয়েছে। কেউ কেউ এক ধাপ এগিয়ে রোহিঙ্গা নারীদের বিয়ে করবে বলেও ঘোষণা দিয়ে বসে! এ প্রসঙ্গে আতিক বাঙ্গাল লিখেছেন, ‘দ্বীনি ভাইদের দ্বীন পালনে রাষ্ট্রীয় বাধা। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশীদের বিবাহ নিষিদ্ধ।’ বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সহানুভূতি দেখাচ্ছে উল্লেখ করে লেখক ইশতিয়াক আহমেদ লিখেছেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সহানুভূতি ও মানবিকতা দেখাচ্ছে। তারপরও যে সকল বাংলাদেশী ভাই বোনেরা অতি আবেগে কাঁদছেন, সরকারের উচিত দুজন করে রোহিঙ্গা তাদের বাসায় মেহমান হিসেবে পাঠানো।’ লেখক মাহতাব হোসেন লিখেছেন, ‘বিশ^জুড়ে অশান্তি সৃষ্টিকারীরাই বরঞ্চ শান্তির বড় বড় পুরস্কার পেয়ে যায়।’ কবি রাকিবুল হায়দার লিখেছেন, ‘আমি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের বিরোধিতা করি, কিন্তু আমার দেশে তাদের স্থায়ী নিবাস গড়তে দেয়ার পক্ষপাতী নই। এক বিহারীদের জ¦ালায় থাকতে পারিনা, এখন আবার রোহিঙ্গা।’ আর সাংবাদিক নঈম নিজাম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘সমালোচনা করার আগে ভাবুন ওরা রোহিঙ্গা নয়, মানুষ।’ বাপ্পাদিত্য বসু লিখেছেন, ‘মায়ানমারকে সাফ বলে দেয়া হোক মানুষ যার, ভূমি তার। হয় তোমার রোহিঙ্গা নাও, না হয় আরাকান আমাদের!’ সাইফুর রহমান লিখেছেন, ‘নির্যাতন বন্ধ না হলে আরাকান রাজ্য দখল করে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ওদেরকে কেউ রাস্তা দেখিয়ে দিলেই তো হয়। ঢাকা তো আর আরাকান নয়।’ মেহেদী হাসান লিখেছেন, ‘আরাকান কি তবে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ফাঁদ?’ শামীম এইচ চৌধুরী লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের ইচ্ছে পূরণ করতেই কি রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা?’ একাধিক ফেসবুকারকে নামসর্বস্ব একটি পোর্টালের ‘আরাকান নয়, কক্সবাজারই হতে পারে কথিত আরাকান রাজ্য’ শীর্ষক একটি খবরও শেয়ার দিতে দেখা গেছে! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোন কোন ব্যক্তিকে রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। তবে ব্যক্তি উদ্যোগে রোহিঙ্গাদের জন্য কোন সাহায্য সংগ্রহ করা যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে সরকার। সরকারীভাবে সাহায্য গ্রহণের জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে খোলা হয়েছে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট। হিউম্যানিটারিয়ান এ্যাসিস্টেন্স টু দ্য মিয়ানমার সিটিজেন ইল্লিগেলি মাইগ্রেটেড (রোহিঙ্গা) নামে একটি এ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। সোনালী ব্যাংক কক্সবাজার শাখার ওই এ্যাকাউন্ট নম্বরটি হচ্ছে ৩৩০২৪৬২৫। এছাড়া ত্রাণ সহায়তা দেয়া যাবে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের দুর্যোগ ও ত্রাণ শাখায়। এমন পোস্টও শেয়ার দিতে দেখা গেছে অনেককে। আর ব্যক্তি উদ্যোগে যারা অর্থ সংগ্রহ করছেন কোন কোন পোস্টে তাদের ‘ধান্ধাবাজ’ আখ্যা দিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে।
×