ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ধারণ ক্ষমতার বাইরে এ পর্যন্ত এসেছে ৩ লক্ষাধিক, মৃতের সংখ্যা ৪ হাজারের বেশি, মাইন পোঁতা, জ্বালাও-পোড়াও অব্যাহত

সাগরপথেও রোহিঙ্গাদের ঢল ॥ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থামছে না

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সাগরপথেও রোহিঙ্গাদের ঢল ॥ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থামছে না

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ জাতিসংঘসহ বিশ্বের বহু দেশের পক্ষ থেকে চাপ সৃষ্টি করার পরও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাবিরোধী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অব্যাহত রয়েছে। সীমান্ত এলাকাজুড়ে স্থলমাইন পোঁতার পাশাপাশি শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে ওপারের ঢেঁকিবুনিয়ায় আরও দুটি গ্রামে আগুন দিয়েছে সেনা সদস্যরা। এতে রোহিঙ্গাদের আরও কয়েকটি বসতি পুড়ে গেছে। সীমান্তের ওপারে ঘুমধুম এলাকা থেকে এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা গেছে। বর্তমানে স্থলমাইন পোঁতার কারণে শঙ্কিত রোহিঙ্গাদের স্থলপথে অনুপ্রবেশের স্রোত আগের তুলনায় কমলেও বেড়েছে নাফ নদীর মোহনা দিয়ে। ছোট-বড় বিভিন্ন নৌযানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোহিঙ্গারা দলে দলে বাপ-দাদার বসতভিটা ছেড়ে শুধু পালাচ্ছে। সেন্টমার্টিনসংলগ্ন সাগরপথে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নৌকাযোগে পাড়ি দিচ্ছে। এ যেন সাগর যাত্রার ঢল। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের এ প্রক্রিয়ায় গত চারদিনে রোহিঙ্গাবোঝাই চারটি নৌকা ডুবে গিয়ে শুক্রবার পর্যন্ত প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৭। এদের অধিকাংশ নারী ও শিশু। এছাড়া সেন্টমার্টিনের অদূরে সাগর এলাকায় যত্রতত্র লাশের ছড়াছড়ি রয়েছে। সাগরে জোয়ার ভাটার টানে কিছু লাশ বাংলাদেশ উপকূলে আসছে। আর কিছু ভাটার টানে চলে যাচ্ছে অন্যত্র। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ আবারও মালয়েশিয়াসহ অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমাচ্ছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেনা বর্বরতায় রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মৃতের সংখ্যা ৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ উপকূলে ভেসে আসা লাশ প্রতিনিয়ত দাফন হচ্ছে। আর ভাসমান অসংখ্য লাশ পচে গলে সাগরের প্রাণীকুলের পেটে যাচ্ছে। সাগরের লোনা জলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসহায় রোহিঙ্গাদের ক্ষতবিক্ষত দেহ ও শরীরের খন্ডিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। এদিকে, বাংলাদেশে নতুন করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী ও থাইনখালীতে থাকতে বাধ্য করার জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেসির চারটি স্কোয়াড কাজ শুরু করেছে। প্রশাসন আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এদের বিচ্ছিন্নভাবে থাকতে না দিয়ে একই স্থানে থাকার সুযোগ করে দেয়া হবে। অপরদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গাবিরোধী বর্বর আচরণের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় বয়ে চলেছে। নোবেল বিজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী নেতা দেসমন টুটু মিয়ানমারের এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচির কড়া সমালোচনা করে এক খোলা চিঠি দিয়েছেন। খোলা চিঠিতে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা নিধনে সুচির নীরবতা যদি ক্ষমতা সর্বোচ্চে থাকার উদ্দেশ্য হয় মূল্য দিতে হবে চড়া। এদিকে, গত ২৫ আগস্টের রাত থেকে সেনা নেতৃত্বে রোহিঙ্গাবিরোধী যৌথ অভিযান শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারীর রোহিঙ্গার সংখ্যা বেসরকারি পরিসংখ্যানে ৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তবে জাতিসংঘ ও ইউএনএইচসিআরের তথ্য মতে, এ সংখ্যা প্রায় পৌনে ৩ লাখ। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা ঢলে কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু পর্যন্ত একাকার হয়ে আছে। বিশেষ করে উখিয়া ও টেকনাফের বর্তমানে যে জনসংখ্যা রয়েছে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা তাদের তুলনায় ছাড়িয়ে গেছে। প্রশাসনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উখিয়া-টেকনাফের বর্তমান জনসংখ্যা ৩ লাখ ৭৫ হাজার। আগস্টের ঘটনার আগে থেকে এসেছে ৫ লক্ষাধিক। এবার একযোগে এসেছে ৩ লক্ষাধিক। ফলে ওই এলাকায় শরণার্থী ও আশ্রিত হিসেবে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ লক্ষাধিক। এ অবস্থায় উখিয়া টেকনাফ অঞ্চলের বাংলাদেশী নাগরিকদের মাঝে অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় হাটে বাজারে, রাস্তায় রাস্তায় সর্বত্র রোহিঙ্গাদের আধিক্য এত বেশি যে, স্বাভাবিক পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। যানবাহনের ভাড়া থেকে শুরু করে সব পণ্যের মূল্যে উর্ধগতি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি সরকার মানবিক আচরণের নীতি অবলম্বন করায় এখন গোটা কক্সবাজার অঞ্চল রোহিঙ্গা ভারে জর্জরিত। আরও নৌকাডুবি ॥ টেকনাফের সমুদ্র উপকূলে রোহিঙ্গাবোঝাই পৃথক আরও ২টি নৌকাডুবির ঘটনায় ১৩ রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া মরদেহ সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দা এবং জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। টেকনাফ উপকূলে এ পর্যন্ত ৮৭ রোহিঙ্গার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে লেঙ্গুরবিলের লম্বরী পর্যটন ঘাটে ১ নারী এবং ১ শিশুর মরদেহ দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। শুক্রবার সকালে স্থানীয়দের সহায়তায় তাদের দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার ভোরে টেকনাফ সদর তুলাতলী এবং সাবরাং খুরেরমুখ উপকূলে রোহিঙ্গাবাহী দুটি নৌকা ডুবে যায়। টেকনাফ মডেল থানার ওসি মাইন উদ্দিন খান জানান, মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংস অভিযানের মুখে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে রাতদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছে। গত ২৫ আগস্টের পর থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত রোহিঙ্গাবাহী ১৪টি নৌকা নাফ নদী ও সাগরে ডুবে যায় বলে বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়া নিখোঁজ রয়েছে অসংখ্য। এরা কি প্রাণে বেঁচে আছে না কোন গন্তব্যে পৌঁছেছে তার কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে বাংলাদেশ উপকূলে অনেকে সাঁতরিয়ে পৌঁছতেও সক্ষম হয়েছে। সমুদ্র সৈকতে আহাজারি ও কান্নার রোল ॥ নৌকায় করে রোহিঙ্গারা পালাতে গিয়ে ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী হওয়ায় এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। ক্রমাগতভাবে নিখোঁজ হচ্ছে অসংখ্য রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষ যেসব লাশ ভেসে আসছে তাদের নিয়ে স্বজনদের আহাজারি ও কান্নায় সমুদ্র এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে আছে। বৃহস্পতিবার ভোর রাতে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় বদরমোকাম এলাকায় রোহিঙ্গাদের বহন করা নৌকাডুবির ঘটনায় টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে ১১ জনের লাশ উদ্ধার ও দাফন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রাণ বাঁচাতে অতিঝুঁকি নিয়ে ছোট নৌকায় করে পরিবারের সাত সদস্যের সঙ্গে প্রায় ৩৫ জনের মতো রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশে পালিয়ে আসছিলেন রোহিঙ্গা নারী রহিমা বেগম। তাদের সকলের বাড়ি মিয়ানমার মংডু শহরের হাসুরাতা গ্রামে। পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হারিয়ে রহিমা বেগমের আহাজারিতে এলাকার মানুষও কেঁদেছে। নিপীড়নের মাত্রা থেমে নেই ॥ যেসব রোহিঙ্গা এখনও রাখাইন রাজ্যে অবস্থান করছে তাদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতন হত্যা গুম অব্যাহত রয়েছে। ফলে যৌথ বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এরা প্রাণ বাঁচানোর পথ খুঁজছে। কিন্তু নির্দয় সেনা সদস্যদের বর্বরতায় এদের অধিকাংশ অবরুদ্ধ হয়ে আছে। পালাতে চাইলেই চলছে মুর্হুমুহু গুলি। তবে রাতের অন্ধকারে অনেকে ঝোপ জঙ্গল পেরিয়ে স্থলপথের চেয়ে এখন সাগর পথকেই বেছে নিয়েছে। এতে করে তারা শুধু বাংলাদেশ নয়, মালয়েশিয়াসহ নৌকাযোগে যে যেদিকে পারে কূল ধরার চেষ্টা করছে। আরসাবিরোধী অভিযানে টার্গেট বাংলাভাষীরা ॥ আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) সদস্যদের দমন করতে গিয়ে মিয়ানমারের যৌথ বাহিনী বাংলা ভাষাভাষীদের (চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা) টার্গেট করেছে। কেননা, আরসার সদস্যরাও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। আরসার পক্ষ থেকে রাখাইনদের স্বাধিকার আদায়, নাগরিকত্ব প্রদান ও সকল সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্য ভিডিও টেপ ছেড়ে দেয়া হয়েছে। যেহেতু আরসার সদস্যরা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং তাদের ভাষাও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা। সে ক্ষেত্রে মিয়ানমার সামরিক জান্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে দমন-নিপীড়নে নেমেছে। ইতোমধ্যে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী তৎপরতা বন্ধে মিয়ানমারের উদ্যোগের প্রতি বিভিন্ন দেশের সমর্থন থাকলেও নির্বিচারে রোহিঙ্গা নিধনের বিষয়টি মেনে নেয়া হচ্ছে না। ফলে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ভারত, তুরস্ক, ইরান, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউএনএইচসিআরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে গণহারে রোহিঙ্গা হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠেছে। খোদ জাতিসংঘ মহাসচিব ইতোমধ্যে মিয়ানমার সরকারের এহেন বর্বর আচরণ বন্ধের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। যুক্তরাজ্য সরকার বলেছে, তারা রাখাইন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। রাখাইনে গণহত্যা ও দমন-পীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশকারী হয়ে বাংলাদেশে আসার সচিত্র প্রতিবেদন বিশ্ব গণমাধ্যমে ক্রমাগতভাবে প্রচার হতে থাকায় মিয়ানমার এখন অনেকাংশে চাপের মুখে পড়লেও সুচির নেতৃত্বাধীন এনএলডি সরকার ক্ষমতার লোভে সে দেশের সেনাবাহিনীর বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা নিধনের যে নীলনক্সা প্রণয়ন করা হয়েছে তারই বাস্তবায়ন হচ্ছে ক্রমাগতভাবে। নোবেল বিজয়ী আউং সান সুচি এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা বিষয়ে উল্টো কথাই বলে যাচ্ছেন, যা সেনাবাহিনীর শেখানো বুলি বলেই বিভিন্ন সূত্রে দাবি করা হচ্ছে। রোহিঙ্গায় ছেয়ে গেছে সীমান্তবর্তী অঞ্চল ॥ টেকনাফ-উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়িজুড়ে এখন শুধু রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। যে দিকে চোখ পড়ছে সেদিকে কেবল রোহিঙ্গার ঢল। এক কথায় রোহিঙ্গায় ছেয়ে গেছে সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চল। গ্রামে গঞ্জে, রাস্তাঘাটে, পাহাড়ে এবং নদীর ধারে শুধু রোহিঙ্গাদের বিচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। ভয়াবহ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এখানকার জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। হাট-বাজার এবং সড়ক একেবারে রোহিঙ্গাদের দখলে বলা চলে। সড়কের দু’পাশে প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গা অবস্থান করায় দূরপাল্লার যান চলাচলে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিকল্প আর কোন সড়ক ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষার্থীসহ নানান শ্রেণী-পেশার মানুষের মাঝে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিয়েছে। এরপরও রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। রোহিঙ্গার তুলনায় স্থানীয়রা এখন সংখ্যালঘু ॥ গত দুই সপ্তাহে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার স্রোতে টেকনাফ থেকে উখিয়া পর্যন্ত পুরো জনপদ এখন বিপর্যস্ত। এ দুই উপজেলায় যেখানে জনসংখ্যা সর্বোচ্চ তিন লাখ ৭৫ হাজার, সেখানে যুক্ত হয়েছে পুরনো ও নতুন রোহিঙ্গা আট লক্ষাধিক। এরা বন-জঙ্গলের গাছ-গাছালি যেমন সাবাড় করছে, তেমনি নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে খাদ্যসামগ্রী যোগাড় করছে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়। এতে এলাকার সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিপর্যয়কর পরিস্থিতি নেমে এসেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য চড়া। বাঁশের মূল্যও কয়েকগুণ বেশিতে উন্নীত হয়েছে। কারণ অস্থায়ী বসতি গড়ে তুলতে এরা এসব সামগ্রী ক্রয় করছে আর সুযোগ সন্ধানীরা কয়েকগুণ বেশি মূল্যে তা সরবরাহ করছে। চমেকে আহত আরও ৩ রোহিঙ্গা শিশু ॥ আহতাবস্থায় মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী আরও তিন শিশুকে বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরা হলোÑ মোঃ সাদেক (৪), জোবইরা (১০) ও নুর সাদেকা (৫)। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গুলিতে তারা আহত হয় বলে তাদের স্বজনদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এ নিয়ে চমেক হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ জখম অবস্থায় ভর্তিকৃত রোহিঙ্গার সংখ্যা ২০ ছাড়িয়ে গেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে কুয়েতের সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নৃশংসতা গণহত্যার শামিল বলে মন্তব্য করেছে কুয়েতের পার্লামেন্ট সদস্যের একটি দল। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বর্বোরোচিতভাবে হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলের ‘লজ্জাজনক নীরবতা’র মধ্যে তারা এ ধরনের মন্তব্য করেন। কুয়েতের ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলি কর্তৃক আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দেশটির সংসদ সদস্যরা মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য উপসাগরীয় দেশগুলো এবং মুসলিম বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সহিংসতা বন্ধের জন্য মিয়ানমারের সরকারের প্রতি চাপ প্রয়োগের জন্য দ্রুত এবং সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বানও জানান তারা। গণমাধ্যমে প্রচারিত বক্তব্যে পার্লামেন্ট সদস্য আবদুল্লাহ আল ইনেজি বলেছেন, কুয়েতের উচিত মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিকসহ সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং সেখানকার নির্যাতিতদের সহায়তা করা। এছাড়া রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আরও বেশ কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য। সে দেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী খালিদ আল-জারুল্লাহ রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, মিয়ানমারে ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, নিজ দেশে এভাবে পাশবিকতার শিকার হওয়া কখনও কাম্য নয়। এটি বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে জাতিসংঘের আগামী অধিবেশনে উত্থাপন করা হবে। মানবাধিকার সংগঠনের ১০টি প্রস্তাব উত্থাপন ॥ সার্কভুক্ত দেশগুলোর অভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ‘সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন’ বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের নেতারা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থীদের নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসা রোহিঙ্গাদের দুর্দশা পরিস্থিতি পরিদর্শন করেছেন। কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও পার্বত্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে স্থাপিত রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকটি ক্যাম্প-বস্তি পরিদর্শনে নেতৃত্ব দেন সংগঠনটির বাংলাদেশ শাখার কেন্দ্রীয় মহাসচিব অধ্যাপক মাওলানা আবেদ আলী। পর্যবেক্ষক দল বুধ ও বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করে রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর উদ্দেশে ১০টি প্রস্তাব পেশ করেছে। তন্মধ্যে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে রোহিঙ্গাদের ফিঙ্গার প্রিন্টযুক্ত ডাটাবেজ তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। চীন এবং রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা মিয়ানমারের ॥ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত অপরাধের জের হিসেবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যাতে কোন ধরনের অবরোধ আরোপ করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে মিয়ানমার। দেশটির সরকারের পক্ষে বলা হয়েছে, রাখাইনের সহিংসতার জের হিসেবে নিরাপত্তা পরিষদ যাতে কোন ধরনের অবরোধ আরোপের মতো সিদ্ধান্ত নিতে না পারে সে লক্ষ্যে চীন এবং রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক চ্যানেলে আলোচনা শুরু করেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। ইন্দোনেশিয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি ॥ মালদ্বীপ মিয়ানমারের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ইতোমধ্যে ছিন্ন করেছে। মালদ্বীপ সরকার বলেছে, যতদিন রাষ্ট্রীয়ভাবে রোহিঙ্গা হত্যা বন্ধ হবে না, ততদিন সম্পর্ক ছিন্ন থাকবে। ইন্দোনেশিয়ার সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে তাদের সরকারকে মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জোরালো দাবি তোলা হয়েছে। এদিকে, মিয়ানামারের রাজধানী নেপিডোতে এক সংবাদ সম্মেলনে সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থং তুন বলেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী দুই সদস্য চীন এবং রাশিয়ার সঙ্গে তারা যোগাযোগ করছেন যাতে রাখাইনের ঘটনায় নিরাপত্তা পরিষদে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়া হয়। মিয়ানমার পার্লামেন্টে রোহিঙ্গা এমপি ছিলেন ॥ মিয়ানমার সরকার বলে আসছে রাখাইন বা সাবেক আরাকানের রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক নয়। তারা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া। তবে ১৯৪৮ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সে দেশের পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে সুলতান মাহমুদ, আবুল বাশার, আব্দুল গাফ্ফার, জোহরা বেগম প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কেউ কেউ মন্ত্রীও হয়েছিলেন। এমনকি উত্তর আরাকান থেকে (বুচিদং ও মংডু) পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছিলেন বুচিদং-১ থেকে শামসুল আনোয়ার, বুচিদং-২ থেকে মোঃ নুর আহমেদ, মংডু-১ থেকে মোঃ ইব্রাহিম ও মংডু-২ থেকে ফজল আহমেদ। মিয়ানমার সরকারের বক্তব্য নাকচ ॥ মিয়ানমারের সরকারের পক্ষে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে যে বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে তাতে বলা আছে, নাগরিকত্বের সনদ বা সে দেশের নাগরিক হিসেবে কাগজপত্র না থাকলে তারা কাউকে ফিরিয়ে নেবে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা সদস্যদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ১৯৮২ সালে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে। বর্তমান এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচির পিতা তাদের নাগরিকত্ব দিয়েছিলেন। এর আগে আরাকান রাজ্য ছিল স্বাধীন। তাদের স্বাধীনতাও গেছে, নাগরিকত্বও গেছে। জমিজমার কাগজপত্র, জন্মনিবন্ধনপত্রসহ সবকিছুই বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন মিয়ানমার সরকার বলছে নাগরিক হিসেবে প্রমাণ দেখাতে হবে। কিন্তু প্রমাণ হিসেবে যেখানে কিছুই রাখতে দেয়া হয়নি সেখানে সরকারের এ ধরনের বক্তব্য শুধু নিন্দনীয় নয়, বরঞ্চ তারা যাতে তাদের নিজ বসতভিটায় যেতে না পারে সে কৌশলই বেছে নিয়েছে সুচির সরকার। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের অধিকাংশের দাবি, তারা নিজেদের বাপ-দাদার ভিটেবাড়িতে চলে যেতে ইচ্ছুক। শুধু তাই নয়, নাগরিকত্বের পাশাপাশি সব ধরনের মৌলিক অধিকার তাদের দিতে হবে। জঙ্গী-সন্ত্রাসী হিসেবে সাধারণ রোহিঙ্গা নিধন বন্ধ করতে হবে। যারা জঙ্গী কার্যকলাপে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে তাদের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু মিয়ানমার সরকার এখন যা করছে তা এক অর্থে সে দেশ থেকে সমূলে রোহিঙ্গা উৎপাঠন অভিযান ছাড়া আর কিছুই নয়। চট্টগ্রামে বিক্ষোভ ॥ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনের প্রতিবাদে শুক্রবার জুমার নামাজের পর চট্টগ্রামে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নামের দুটি সংগঠন পৃথক পৃথকভাবে এ মিছিল করেছে। মিছিল শেষে আয়োজিত সমাবেশে এ সংগঠনের নেতারা মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে এ্যাকশন শুরু করার জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্বের শক্তিশালী দেশসমূহের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। বাদ জুমা লালদীঘি চত্বরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বিক্ষোভ কর্মসূচী পালিত হয়। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ উত্তর গেটে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। আহলে সুন্নাত ওয়ার জামাতের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন- আল্লামা এমএ মতিন, এ্যাডভোভেট মোসাহেব উদ্দিন বখতিয়ার, আল্লামা আবু সুফিয়ান আল কাদেরি, আল্লামা জুলফিকার আলী চৌধুরী। ইসলামী আন্দোলনের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন- আবুল কাশেম মাতব্বর, ডাঃ ফরিদ খান, ডাঃ রেজাউল করিম, এইচএম মোসলেহ উদ্দিন প্রমুখ।
×