ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উপহার দিলেন সেঞ্চুরিয়ান ওয়ার্নারের উইকেট

জন্মদিনে জ্বলে উঠলেন মুস্তাফিজ

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

জন্মদিনে জ্বলে উঠলেন মুস্তাফিজ

স্পোর্টস রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে ॥ বিশেষ একটি দিন তার জন্য। বাংলাদেশ দলের জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তৃতীয়দিনে চাপে থাকবেন বাংলাদেশের বোলাররা শুধু ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার তখনও উইকেটে টিকে থাকার কারণে। এ বাঁহাতি স্বভাবে বিধ্বংসী হওয়াটাই সেই আতঙ্ককে বাড়িয়ে দিচ্ছিল স্বাগতিকদের। দ্রুত অসিদের গুটিয়ে দেয়ার অগ্নিপরীক্ষা! তবে ধীরলয়ে ব্যাটিংয়ের অভূতপূর্ব নিদর্শন দেখিয়ে আগের দিনই ওয়ার্নার বিস্ময় সৃষ্টি করার পর সেটা ধরে রেখে ক্যারিয়ারের ২০তম সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে নিজেকে মেলতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু সকালে খেলার আড়াই ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া এবং ১৬ ওভার হতেই নতুন বল পেয়ে ঝলসে ওঠেন মুস্তাফিজ। ২২ বছরে পা রাখা এ বাঁহাতি পেসার ফিরিয়ে দেন ১২৩ রান করা ওয়ার্নারকে। ২০১৬ আইপিএলে এই ওয়ার্নারের নেতৃত্বেই খেলেছিলেন মুস্তাফিজ। ষষ্ঠ অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান হিসেবে এশিয়ায় টানা দুই টেস্টে শতক হাঁকানো ব্যাটসম্যান হয়ে আরও বড় আতঙ্কে পরিণত হচ্ছিলেন তিনি। জন্মদিনে নিজের জন্য তো বটেই দলকেও বড় উপহার দিলেন মুস্তাফিজ। এরপর মাঝে বিরতি দিয়ে দিনের দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে ম্যাথু ওয়েডকে ফিরিয়ে জন্মদিনটা বেশ উপভোগ্যই করতে পেরেছেন তিনি। প্রায় আড়াই বছর আগে ক্যারিয়ারের শুরু করা এ মেধাবী পেসার একটা সময় সারাবিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। ইন সুইঙ্গার, আউট সুইঙ্গার যেমন ছিল তার চেয়ে বেশি তিনি বিশ্বের সব ব্যাটসম্যানকে আতঙ্কিত করেছিলেন ভয়ানক অফকাটার ও স্লোয়ার বলে। নাম কামিয়েছিলেন ‘কাটার মাস্টার’Ñ কিন্তু গত বছর ইনজুরিতে বাঁ কাঁধে অস্ত্রোপচার করানোয় ৫ মাস ছিলেন বাইরে। এরপর ক্রিকেটে ফেরার পর পুরনো সেই মুস্তাফিজকে ধারালো রূপে খুঁজে পাওয়া যায়নি। লাইন-লেন্থে যেমন অগোছালো হয়ে ওঠেন তেমনি সেই বিভীষিকাময় কাটারগুলো ঠিকমতো করতে পারেননি। বোলিং নৈপুণ্যে ধারাবাহিক মুস্তাফিজ নিজের সঙ্গেই সংগ্রাম করছিলেন। এমনকি এবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মিরপুর টেস্টে ঐতিহাসিক জয়ে কোন ভূমিকাই রাখতে পারেননি কপর্দকহীন মুস্তাফিজ। দাপুটে স্পিনারদের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছিলেন প্রথম ইনিংসে ৮ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১ ওভার বোলিং করা এ বাঁহাতি। তবে চট্টগ্রাম টেস্টে তার ওপর আস্থা রাখা ছাড়া কোন উপায় ছিল না বাংলাদেশ দলের। কারণ, স্পিনাররা কোন ধরনের প্রভাব ফেলতে পারছিলেন না অসি ব্যাটসম্যানদের ওপরে। অথচ দিনের দ্বিতীয় ওভারে নিজে প্রথমবার বল হাতে নিয়েই ওপেনার ম্যাট রেনশকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মুস্তাফিজ। লেগ স্ট্যাম্পের কিছুটা বাইরে থাকা বলটিকে গ্ল্যান্স করতে গিয়ে মুশফিকুর রহীমের দুর্দান্ত ক্যাচে ফিরে গিয়েছিলেন এ ওপেনার। এরপর দিনভরই বাংলাদেশী বোলারদের ঘাম ঝরাতে হয়েছে আরেকটি উইকেট পেতে। বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলাম অবশ্য অসি অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মুস্তাফিজও আর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেননি। ১০ ওভার বোলিং করে ৪৫ রান দিয়েছিলেন শুধু রেনশর উইকেটটি ঝুলিতে পুরে। তৃতীয়দিনে অনেক ধরনের চাপ ছিল স্বাগতিকদের ওপরে। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ধীরতম অর্ধশতক হাঁকালেও ওয়ার্নার ৮৮ রান নিয়ে ব্যাট করছিলেন। যত দ্রুত তাকে এবং অসিদের অলআউট করা যায় ততই টাইগারদের জন্য মঙ্গল। কিন্তু সেটার কোন ধরনের ছাপই দেখাতে পারেননি পুরনো বলে বাংলাদেশের স্পিনাররা। তারা আগের দিনের মতোই ছিলেন ভোঁতা ছুরি। শুরুতেই দুই ঘণ্টা বৃষ্টি হওয়ায় উইকেট আর্দ্র ও সিক্ত হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতি পেসারদের জন্য বেশ সহায়ক। কিন্তু তখনও নতুন বল নেয়ার সময় হয়নি বাংলাদেশ দলের। সুযোগটা মিলেছে দিনের ১৬ ওভার পার হয়ে। নতুন বলে ৮০তম ওভারটি করেন সাকিব আল হাসান। এরপরই আক্রমণে আসেন মুস্তাফিজ। প্রথম ওভার থেকেই নতুন বলে যেন জেগে ওঠেন ফিজ। ভড়কে দেন সেঞ্চুরিয়ান ওয়ার্নারকে। অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে এর আগে বব সিম্পসন, এ্যালান বোর্ডারম ডেমিয়েন মার্টিন, মাইক হাসি (দুইবার) ও মাইকেল ক্লার্ক এশিয়ার মাটিতে টেস্টে টানা দুই শতক হাঁকানোর কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। মিরপুর টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরি করা ওয়ার্নার এবার সেই কীর্তির ভাগীদার হয়েছে সাগরিকাতেও শতক হাঁকিয়ে। তবে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ধীর সেঞ্চুরি ছিল এটি তার। যে ২০ সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন তিনি এর মধ্যে ৬টিরই স্ট্রাইক রেট ছিল ১০০-এর ওপর, ৮টির স্ট্রাইক রেট ছিল ৮০-এর ওপর। কিন্তু এবার তিনি ২০৯ বলে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন, সবচেয়ে কম চার হাঁকিয়ে (৫টি)। আবার আগের ১৯ সেঞ্চুরির মধ্যে এবারেরটিই সবচেয়ে বেশি ৩১৩ মিনিট খেলে করেছেন তিনি। এর আগে তার ধীরতম সেঞ্চুরিই ছিল মাত্র ১৫৪ বলে ২০১৪ সালে এ্যাডিলেডে ভারতের বিরুদ্ধে। সাগরিকায় ১৯৩ বলে ৯৯ রানে পৌঁছার পর অফস্পিনার নাসির হোসেনের ১৫ বল ডট খেলেছেন ওয়ার্নার, অবশেষে চার হাঁকিয়ে শতক পূর্ণ করেন। সেই ধীরস্থির ওয়ার্নারকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দেন মুস্তাফিজ। নতুন বলে ইনিংসের চতুর্থ ও দিনে নিজের দ্বিতীয় ওভারেই একটি উইকেট পেতে পারতেন তিনি। গ্লেন ম্যাক্সওয়েল গালিতে সহজ ক্যাচ দিয়েছিলেন, কিন্তু মেহেদি হাসান মিরাজ সেটা ফেলে দেন। তবে ৮৮তম ওভারে (দিনে নিজের চতুর্থ ওভার) বল হাতে নিয়েই ওয়ার্নারকে শিকার করেন তিনি। ২৩৪ বলে ৭ চারে ১২৩ রান করার পর মুস্তাফিজের দারুণ এক বাউন্সারে পুল করতে গিয়ে লেগ গালিতে ইমরুল কায়েসের কাছে ক্যাচ চলে যায়। তিনবারের প্রচেষ্টায় সেটা তালুবন্দী করলে তিনটি সহজ জীবন ফিরে পাওয়া ওয়ার্নার এ যাত্রা সাজঘরের পথে হাঁটা দেন। বাংলাদেশকে স্বস্তি এনে দেন মুস্তাফিজ। শুরু তিনিই করেছিলেন, আবার তিনিই দীর্ঘস্থায়ী ওয়ার্নারের প্রতিরোধ ভেঙ্গে ফেলেন। তার সঙ্গেই ২০১৬ সালের আইপিএলে চ্যাম্পিয়ন সানরাইজার্স হায়দরাবাদে খেলেছেন মুস্তাফিজ। সেবার অধিনায়ক ওয়ার্নার বারবার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন এ বাঁহাতির বোলিংয়ে। এবার তার কাছেই ক্যারিয়ারে প্রথমবার উইকেট দিয়ে আসলেন। জন্মদিনের উপহারটা পেয়ে যান মুস্তাফিজ, দলকেও করেন ভারমুক্ত। কিন্তু ৯০তম ওভারে দুর্দান্ত বোলিং করলেও মুস্তাফিজকে আর বল দেননি অধিনায়ক মুশফিক। দারুণ বল করতে থাকা এ পেসারকে আর বোলিং না দেয়াটা মুশফিকের রক্ষণশীল মনোভাব এবং অদ্ভুত সিদ্ধান্তটি দারুণ আশ্চর্য করে! তবে ১০৬তম ওভারে ফিরে এসেই আবার আঘাত হানেন দারুণ এক রিভার্স সুইংয়ে ম্যাথু ওয়েডকে এলবিডব্লিউ করে। ইনিংসে বাংলাদেশের সফলতম বোলার হয়ে যান মুস্তাফিজ। এখন পর্যন্ত তিনি ২০ ওভার বোলিং করে ২ মেডেনসহ ৮৪ রান দিয়ে নিয়েছেন ৩ উইকেট। মিরপুর টেস্টে ব্যর্থ হলেও সময়মতোই বল হাতে জ্বলে উঠেছেন দ্য ফিজ।
×