ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাঁধে ক্ষণস্থায়ী জীবন

জলে ভাসা পদ্মের মতো জীবন, বংশপরম্পরায় শুধুই প্রতীক্ষা...

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১০ আগস্ট ২০১৭

জলে ভাসা পদ্মের মতো জীবন, বংশপরম্পরায় শুধুই প্রতীক্ষা...

সমুদ্র হক ॥ ডাকঘরের সিলমোহর ও সরকারী নথি ওদের ঠিকানা ধরে রেখেছে। প্রকৃত ঠিকানা সেই যে কবে হারিয়েছে! নিত্য দিন নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে...। এই বুঝি চর জাগিয়ে ফিরিয়ে দেয় ভূমি। দিন মাস বছর যুগ পেরিয়ে যায়। বংশ পরম্পরায় শুধুই প্রতীক্ষা। মাঝে মধ্যে চর জাগে, কিন্তু তা আর ওদের হয় না। প্রভাবশালীদের রক্তচক্ষু ও লাঠিয়াল শক্তি তা কেড়ে নেয়। প্রভাবশালী হয়ে যায় প্রভু। পছন্দের লোকদের প্রজা বানিয়ে চরে নিয়ে যায়। আশ্রয় দেয় কঠিন শর্তে। ফসল উৎপাদনের পর কিছু রেখে দিতে হবে প্রভুদের। নইলে উচ্ছেদ। ইংরেজ বেনিয়া বিদায় নিয়েছে কবে। প্রভু সামন্তরা ফিরে আসছে নতুন রূপে। যে দৃশ্য আজও চোখে পড়ে নদী তীরে ও চরগ্রামে। বর্ষা মৌসুমে স্বচ্ছ হয়ে ওঠে এই চিত্র। বগুড়ার যমুনা তীরের সারিয়াকান্দি ও ধুনট এলাকায় ভাঙ্গনের থাবার নিদারুণ শিকার লাখো মানুষ। জমি জিরাত বসতভিটা সবই কেড়ে নেয় নদী। জলে ভাসা পদ্মের মতো জীবন হয় তাদের। ভাসতে ভাসতে গিয়ে কোন্ কূলে ঠেকে। প্রথমে ক্ষণস্থায়ী আশ্রয়। একসময় এই ক্ষণস্থায়ী পরিণত হয় চিরস্থায়ী। জীবন থেমে থাকে না। চলে আসে নতুন ভবিষ্যত। পূর্বসুরীদের দেখে শিশু বেলায় বুঝতে পারে নদীর সঙ্গে যুদ্ধে নামতে হবে। এ যেন অস্তিত্বের লড়াই। নদীর সঙ্গে বাস, নদীর জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাধারণ লোকালয়ের মতো নয়। নয় মাস নদীর মধ্যে শুকনো ভূমির ডাঙায়। বর্ষা ডুবিয়ে দিলে সম্বল নিয়ে কাছের বাঁধে আশ্রয়। ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে তিন চার মাস বাঁধের ওপর। খাওয়ার কোন চিন্তা নেই। সরকারী ত্রাণ যা মেলে তা দিয়ে ভালভাবেই চলে যায়। ত্রাণের লোকজন বাঁধের ওপর আশ্রিতদের বেশি প্রাধান্য দেয়। বেসরকারী যে সাহায্য আসে তাও পায় ওরা। এমনও হয়, কিছুদিনের খাবার তারা সংগ্রহে রাখতে পারে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর নিজ ভিটায় ফিরে গেলে এই খাবারে তাদের বেশ কিছুদিন চলে। সারিয়াকান্দিতে ব্রহ্মপুত্র নদের ডান তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের একাংশে ঢাল অংশে স্থায়ীভাবে বাড়ি ঘর তুলে বংশ পরম্পরায় বাস করছে আশ্রিতরা। আরেক অংশ এবং নতুন করে নির্মিত বাঁধে চর ডুবে গেলে আশ্রয় নেয়। তারপর পানি নেমে গেলে ফিরে যায়। যেমন এবার রোহদধ বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছে চন্দনবাইশা, কামালেরপুর ও কুতুবপুর ইউনিয়নের ১৮ গ্রামের মানুষ। এর মধ্যে ভাঙ্গনের কবলে পড়া লোকজন আছে। এদের একজন আজাহার আলী। বললেন, বাপাদাদার দশ বিঘা জমি চিল তা চলে গেছে নদী গর্ভে। সেই থেকে তিনি বাঁধে আশ্রিত। বর্ষা যাদের বসত ভিটা জমি জিরাত কেড়ে নেয় তারা পড়ে বিপাকে। এই ঘাট ওই ঘাট করে কোন ঘাটেই এরা কূল পায় না। শেষ পর্যন্ত নদীর কাছাকাছি কোন এলাকায় পতিত জমিতে আশ্রয় নেয়। তারপর দিনে দিনে ঝুপড়ি ঘর থেকে টিনের চালায় ঘর বানায়। পরিবার পরিজন নিয়ে এরা বংশ পরম্পরায় বাস করতে থাকে। যেমন বগুড়ার ধুনটের চুনিয়াপাড়া, গোসাইবাড়ি চিথুলিয়া গ্রামগুলোতে সারিয়াকান্দির যমুনা ভাঙ্গনের হাজারো মানুষ বহু বছর ধরে আশ্রয় নিয়ে আছে। এদের বেশিরভাগের বসতভিটা জমিজিরাত ছিল সারিয়াকান্দির কামালপুর বোহাইল ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে। চিথুলিয়া গ্রামের একটি এলাকার নতুন নামকরণ হয়েছে চল্লিশপাড়া। যেখানে ভান্ডারবাড়ি, বৈশাখী, কয়াগাড়ি, রাধানগর, বথুয়ারভিটা, রঘুনাথপুর এবং পার্শ্ববর্তী সিরাজগঞ্জের কাজিপুর এলাকার ভাঙ্গনকবলিত লোকজন আশ্রয় নিয়ে আছে। নির্বাচনের সময় এসব আশ্রিতরা তাদের হারানো এলাকায় গিয়ে ভোট প্রদান করে। কারণ তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র পূর্বের ঠিকানাতেই করা আছে। যে ঠিকানা হারিয়ে এখন নদীর মধ্যে। সরকারী নথিপত্র ও পোস্ট অফিসে ঠিকানাগুলো পরিবর্তন হয়নি। তা হওয়ারও নয়। দাগ সিএস খতিয়ান এম আর খতিয়ান সবই নদীর মধ্যে। শুধু মানুষ আছে ডাঙায়। আধ্যাত্মিক গানের মতো ‘পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই আমি তো সেই ঘরের মালিক নই...’। এসব মানুষের জীবন চলে জীবনের গতিতে। জীবনের নিয়মে। তাদের সন্তানরা লেখাপড়া করে। বড় হয়ে গেলে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয়া হয়। বছর ঘুরতেই সংসারে আসে নতুন মানুষ। তারাও এক সময় বড় হয়। ঘরে আসে নাতি নাতনী। ছোটাছুটি করে আঙিনায়। গড়িয়ে পড়ে। মাটির কাছে থাকা, মাটির গন্ধ পাওয়া নদীর ভিতরের নির্মল বাতাস সবই তারা পায়। নদী এদের সব কেড়ে নেয়। জীবন গড়ে নিতে নদীর সঙ্গে লড়াই করে। বহতা নদীর মতো ওদের জীবনও বহতা ....।
×