ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একসেঞ্চার-এর প্রস্থান

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ৬ আগস্ট ২০১৭

একসেঞ্চার-এর প্রস্থান

তথ্যপ্রযুক্তির জগতের সর্বশেষ আলোচিত বিষয়টি হচ্ছে ১৮ জুলাই ১৭ একসেঞ্চার নামক একটি বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানির লেঅফ ঘোষণা এবং ৩০ নবেম্বর প্রতিষ্ঠানটি পুরোই বন্ধ করে দেয়ার খবর। খবরটি জাতীয় গণমাধ্যমে তেমন গুরুত্ব না পেলেও তথ্যপ্রযুক্তির জগতে বেশ বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কেন এই ঘটনা এবং কি তার প্রতিক্রিয়া সেটি নিয়েও আলোচনা কম হচ্ছে না। নানা জন নানা ধরনের মতামত দিচ্ছেন। যদিও আমি খবরটি প্রতিষ্ঠানটির উর্ধতন কর্তাদের মুখ থেকেই শুনেছি তথাপি দেশের মিডিয়াতে এই বিষয়টি নিয়ে যেসব প্রসঙ্গ এসেছে তার উল্লেখ করতে চাই। ১. প্রথমত বলা হচ্ছে যে, ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি সেবা প্রতিষ্ঠান উইপ্রো বাংলাদেশে আসছে এবং মুন্সি ট্রেডার্স নামে জনবল সংগ্রহ করছে বলে একসেঞ্চার তাড়াহুড়ো করে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিচ্ছে। খবরে বলা হয়, জিপিআইটির ৫১ শতাংশ মালিকানা নিয়ে ২০১৩ সালের ৩ আগস্ট বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে একসেঞ্চার। শুরুর দিকে টেলিনর গ্লোবালের চার প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন, ডিজি মালয়েশিয়া, ডিট্যাক থাইল্যান্ড এবং টেলিনর পাকিস্তানের সেবা দেবার দায়িত্ব পায় একসেঞ্চার। এশিয়ার এই চারটি দেশের সঙ্গে সফল ব্যবসা করার পর টেলিনরের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পরিকল্পনা ছিল একসেঞ্চারের। কিন্তু সম্প্রতি গ্রামীণফোনের আইটি ডিভিশনের সব কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব একসেঞ্চারের বদলে দেওয়া হচ্ছে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম সফটওয়্যার পরিষেবা রফতানিকারী প্রতিষ্ঠান ‘উইপ্রো’কে। ইতোমধ্যেই গ্রামীণফোন উইপ্রোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। একসেঞ্চার বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রায়হান শামসির পক্ষ থেকে সব কর্মীকে পাঠানো টার্মিনেশন লেটারে উইপ্রোর কথা উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ উইপ্রো থেকে জব অফার পেতে পারেন, যে প্রতিষ্ঠানটিকে গ্রামীণফোন নিয়োগ দিয়েছে। ২. একসেঞ্চার থেকে টেলিনর পাকিস্তান-এর ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া, নতুন ব্যবসা না পাওয়া, টেলিনরের অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে না পারা একসেঞ্চার বন্ধের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। এদিকে এরই মধ্যে গত বছর একসেঞ্চারের হাতছাড়া হয়েছে টেলিনর পাকিস্তান। টেলিনর গ্লোবাল থেকে দায়িত্ব পাওয়া চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটির ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া এবং নতুন করে কোন ব্যবসা না হওয়াতে বাংলাদেশে ব্যবসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে একসেঞ্চার। ৩. একসেঞ্চারের চলে যাওয়ার অন্যতম কারণের একটি ইউনিয়ন। নানান ইস্যুতে ইউনিয়নের চাপ নিতে পারছিল না একসেঞ্চার। টেলিকম অপারেটরদের বাংলাদেশ অবকাঠামো থাকলেও একসেঞ্চারের কোনো অবকাঠামো নেই। ফলে টেলিকম অপারেটরে ইউনিয়ন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হলেও একসেঞ্চার ইউনিয়নের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব ছিল না। ফলে তাদের চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সহজ ছিল। ৪. ভারতে একসেঞ্চারের কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য তারা বাংলাদেশ থেকে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এই খবরে বলা হয় যে একসেঞ্চার ভারতে নতুন করে আরও ৪ হাজার লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করার মতো কার্যক্রম বাড়াচ্ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে এই কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের খবরে এটি বলা হয়েছে যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলক বলেছেন যে, একসেঞ্চার চলে গেলে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তির ওপর তেমন কোন প্রভাব পড়বে না। খবরে আরও যারা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তারা কেউ বলেছেন একসেঞ্চার চলে যাবার চাইতে সুখবর হলো উইপ্রোর আসা। আমি ঘটনার পরপরই মিডিয়াকে বলেছি, ‘একসেঞ্চার বাংলাদেশ থেকে চলে গেলে ইমেজের বড় ধরনের একটা সঙ্কট তৈরি হবে। আরও যেসব প্রতিষ্ঠান বা বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায় বা সরাসরি আসতে চায়, তারা দ্বিতীয়বার ভাববে। আমরা যতই সফটওয়্যার ও সেবাপণ্য রফতানি করি না কেন, এই ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হবে।’ আমি যদি সম্পূর্ণ নির্মোহভাবে একসেঞ্চারের বিদায় হওয়াটাকে দেখি তবে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা গুটিয়ে যাবার কারণগুলোর চাইতেও বড় করে দেখব আমাদের দেশের কর্মী, শ্রম অধিদপ্তর তথা সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাকে। আমি কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ খুজে পাইনা যে, কেন কায়িক শ্রমিকদের আইনের আওতায় গড়ে ওঠা ট্রেড ইউনিয়ন মেধাশ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনে কাজ করার অনুমতি পায় কেমন করে। শ্রম অধিদফতর কেন বিবেচনা করবে না যে, এ ধরনের একটি রফতানিমুখী জ্ঞান নির্ভর প্রতিষ্ঠানে হরতাল-ধর্মঘট করার গতানুগতিক ধারা চলতে পারে না? আমি যতটা জানি একসেঞ্চারের ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠানের বিদেশী কর্মকর্তাদেরকে জিম্মি করল, কাজ বন্ধ রাখল এবং গত এপ্রিল মাসে ৭ দিন পুরো প্রতিষ্ঠানের কাজ বন্ধ রাখল। এমনকি লেঅফ ঘোষণার পর এইচএসসির ফলাফলের কাজও বন্ধ করে দিল। ৪ আগস্ট ১৭ এই নিবন্ধটি লেখার সময় পর্যন্ত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠানটির স্বাভাবিক কাজ আটকে রেখেছে বলে আমাকে জানানো হয়েছে। একই দিনে পত্রিকার খবরে দেখেছি যে ইউনিয়ন এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। তারা এটিও জানিয়েছে যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিদেশীরা এরই মাঝে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। একসেঞ্চার মনে করে ট্রেড ইউনিয়ন মোকাবেলায় সরকারের কোন অংশের কোন ধরনের সহায়তা পেল না তারা। শ্রম অধিদফতর কেন কোন ব্যবস্থা নেয়নি- কেন আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনী কোন পদক্ষেপ নেয়নি বা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দফতর কেন খতিয়ে দেখেনি যে এমন পরিবেশে কোন বিদেশী প্রতিষ্ঠান নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারে না, সেই প্রশ্নটি একসেঞ্চার তুলেই রেখেছে। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত কোনভাবেই এই প্রেক্ষিত ও প্রশ্নগুলোকে পাস কাটিয়ে যেতে পারে না। আমি এটি মানতে রাজি নই যে, দেশের ৫৫৬ জন প্রকৌশলীর চাকরি গেল এবং বার্ষিক ১০ মিলিয়ন ডলারের তথ্যপ্রযুক্তি রফতানি বন্ধ হয়ে গেলে এবং তাতে এই খাত কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। হতে পারে, উইপ্রোর মতো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে এলে আমাদের ইমেজের উন্নতি হবে, বৈদেশিক মুদ্রা আয় এমনকি আরও বাড়তে পারে, কিন্তু একসেঞ্চার চলে গেলে আমাদের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না সেটি আমার নিজের কাছে মনে হয় না। ৫৫৬ জন প্রকৌশলীর চাকরি এবং ১০ মিলিয়ন ডলার রফতানি আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে একদমই আচড় কাটবে না সেটি আমি মনে করি না। এই ধারণা পোষণ করার মানে হচ্ছে আমরা উটপাখির মতো বালির নিচে মাথা লুকিয়ে রাখছি। সর্বশেষ খবর অনুসারে একসেঞ্চার ভারতে তাদের কর্মযজ্ঞ বাড়াচ্ছে। এতে অন্তত একটি বিষয় প্রমাণিত যে ভারতে তারা বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়নিজমের মতো চরম অবস্থার মুখোমুখি হয় না। আমি মনে করি বরং বিষয়টির গভীরে যে গভীর ক্ষত রয়েছে তার দিকে তাকাতে হবে। আমি স্মরণ করতে পারি যে, ৬ আগস্ট ১৫ তারিখে অনুষ্ঠিত ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স এর সভায় আমি প্রচলিত কায়িক শ্রমভিত্তিক আইনের পাশাপাশি মেধাভত্তিক শ্রমিকদের জন্য নতুন শ্রম আইন তৈরি করার প্রস্তাব করেছিলাম যা প্রধানমন্ত্রী নিজে অনুমোদন দিয়েছিলেন। দুই বছরেও সেই লক্ষ্যে কোন কার্যকর পদক্ষেপ না নেবার খেসারত দিতে হলো দেশকে। অনেকেই মনে করছেন যে, একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবসা গুটিয়ে নিলে কি আর আসে যায়। সেটির বিপরীতে উইপ্রোকে সান্ত¡না হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। একসেঞ্চার থাকার পর যদি উইপ্রো আসতো তবে সেটি সুসংবাদ হতো। কিন্তু একসেঞ্চার চলে যাওয়ায় সেই আনন্দটা মাটি হয়ে গেছে। আমাদের বোধহয় এটিও মনে রাখা দরকার যে উইপ্রো একসেঞ্চারের কাজ করতেই বাংলাদেশে আসছে। তারা নতুন কোন ব্যবসা আনছে বলে এখনও আমরা জানি না। এমনকি একসেঞ্চারের হাতছাড়া হওয়া ব্যবসাগুলোও তারা পাবে কিনা সেটিও জানা যায়নি। যদি কেবল গ্রামীণ ফোনের কাজ উইপ্রো করে তবে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা পাবার বদলে বৈদেশিক মুদ্রা ভারতে পাঠানোর প্রক্রিয়ায় চলে যাব। অন্যদিকে আমরা উইপ্রোর মতো প্রতিষ্ঠানেও যদি প্রচলিত ট্রেড ইউনিয়ন চালু করতে দেখি তবে ধর্মঘট, হরতাল, ঘেরাও ইত্যাদির কারণে ওরাও পালাবে কিনা সেই নিশ্চয়তা অন্তত আমি পাইনা। আমরা কারও ব্যবসার জন্য পরিবেশ তৈরি করতে চাই বলেই তাদের জন্য শ্রম আইন ও মেধাস্বত্ব আইনগুলোকে ডিজিটাল যুগের উপযোগী করে ভবিষ্যতে যাতে একসেঞ্চারের মতো দুর্ঘটনা করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে চাই। একসেঞ্চার যদি অন্য কারণেও বাংলাদেশ ছেড়ে থাকে তবুও ট্রেড ইউনিয়নের বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ভবিষ্যতে একসেঞ্চারের মতো আরও কোন বিদেশী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের তথাকথিত ট্রেড ইউনিয়নিজমের খপ্পরে পড়তে পারে। সরকারের শ্রম দফতর ট্রেড ইউনিয়ন করার অনুমোদন দিলে তারা যে কতটা ভয়ঙ্কর ও আত্মবিধ্বংসী হতে পারে একসেঞ্চার তার একটি নমুনা মাত্র। আমি নিজে এটি কোনভাবেই বুঝতে পারি না যে, মেধাশ্রমভিত্তিক কাজের জন্য কেন সরকার পৃথক শ্রম আইন করতে পারবে না। বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকগণ যদি একসেঞ্চারের বিদায় থেকে কোন না কোন শিক্ষা গ্রহণ করেন তবে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিদেশী বিনিয়োগ এর আগমনটা ইতিবাচক হবে বলে মনে হয় না। আমরা এরই মাঝে এটিও দেখেছি যে স্যামসাং বাংলাদেশে তাদের যে আরএ্যান্ডডি সেন্টার গেড়ে তুলেছিল সেটির কার্যক্রমও কমিয়ে দিয়েছে। এখন শুরুর সময় থেকে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ কর্মী কাজ করে। যেখানে কর্মীর সংখ্যা শুরু থেকে দ্বিগুণ তিনগুণ হবার কথা সেখানে এমনভাবে এক-তৃতীয়াংশে নেমে যাবার বিষয়টিকে সাধারণভাবে নেয়া যায় না। আমাদের দায়িত্ব হবে স্যামসাং-এর বিষয়টিও খতিয়ে দেখা। একদিকে তারা ইলেকট্রনিক কারখানা তৈরি করছে অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণাকে ছেটে ফেলছে। এই অবস্থাটি থেকেও আমাদের শেখার বিষয় আছে। আমাদের একটু জেনে নেয়া দরকার কেন স্যামসাং ভারতে সম্প্রসারিত হচ্ছে, বাংলাদেশে ফ্রিজের কারখানা করছে-কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণার কাজকে কমিয়ে আনছে। আমাদের কি দক্ষ লোকের অভাব? অথবা আমাদের পরিবেশ কি গবেষণার অনুকূল নয় বা বৈদেশিক মুদ্রা লেনেদেনে কোন সমস্যা রয়েছে কিনা সেটি আমাদেরকে জানতে হবে। আমরা স্বপ্ন দেখব ৫ বিরিয়ন ডলার রফতানির অথচ এর পেছনে সকল প্রকারের অবকাঠামোতে মনোযোগী হব না সেটি হতে পারে না। ঢাকা, ৪ আগস্ট ১৭ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এর জনক [email protected],
×