ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রামে পানিতে ক্ষতির পরিমাণ চার শ’ কোটি ছাড়িয়ে যাবে

প্রকাশিত: ০৫:১০, ২ আগস্ট ২০১৭

চট্টগ্রামে পানিতে ক্ষতির পরিমাণ চার শ’ কোটি ছাড়িয়ে যাবে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রাম। এবারের বর্ষা মৌসুমে এ মহানগরী জলজটে যে পরিমাণ ডুবেছে তা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। প্রধান প্রধান বহু সড়কে নৌকাযোগে জন চলাচলের বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোর গুদাম ও আড়তের পণ্যসামগ্রী পানির নিচে ডুবে যে ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ ৪শ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন থেকে দাবি করা হয়েছে। এছাড়া নিম্নাঞ্চলসহ অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকার বসতি এলাকাগুলোও পানির নিচে তলিয়ে যায়। হাঁটু পানি, গলা সমান পানি এবার গ্রাস করেছে এ নগরীকে। এ দুর্যোগের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে জোয়ারের পানি। বৃষ্টি নেই এমন দিনেও জোয়ারের অথৈই পানিতে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ভাসতে থাকে। জলজটে ভয়ানক দুর্যোগের কারণে সিটি মেয়র নগরবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। পাশাপাশি জলজটের প্রধান কারণসমূহের মধ্যে অপর একটি সেবামূলক সংস্থার (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) কর্মকা-কে দায়ীও করেছেন। সব মিলিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে, আর কি পরিমাণ ডুবলে চট্টগ্রাম মহানগরীর মানুষ এ ধরনের দুর্যোগ থেকে ভবিষ্যতে রক্ষা পাবে? অতি ভারি বর্ষণ থেমে যাওয়ার পর এই নগরীর যে চিত্র ভেসে উঠেছে তা রীতিমতো কদর্য চেহারার মতো। নগরবিদসহ বিভিন্ন মহলের নানা দাবির মধ্যে প্রধান বক্তব্য যেটি উঠে এসেছে তা হচ্ছে কর্ণফুলী নদী ভরাট হয়ে চর পড়ে যাওয়া এবং নগরজুড়ে ৪২টি খালের মধ্যে ৩৬টি রীতিমতো বিলীন হয়ে যাওয়ার ঘটনা। আর অপরিকল্পিত নগরায়নতো থামানোই যাচ্ছে না। সেবামূলক সংস্থাগুলো নানা বক্তব্য দিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেদের আত্মরক্ষার পথ বেছে নেয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যায়। কিন্তু দুর্যোগের ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষোভের আগুন নেভাবে কে? চট্টগ্রামের উন্নয়নে নানা প্রকল্প সরকার ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে পুরো নগর পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটলে থাকলে আগামীতে উন্নয়নের সুফল কিভাবে মিলবে তাও বড় ধরনের প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। প্রায় ৪ বছর আগে কর্ণফুলী নদীতে বন্দর কর্তৃপক্ষ যে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প গ্রহণ করেছিল তা অপমৃত্যু হয়েছে। মালয়েশিয়ার একটি কোম্পানি এ ড্রেজিং প্রকল্প শুরু করে ১৬৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছে। পরে হয়েছে মামলা। মামলায় আদালতের স্থগিতাদেশে ঝুলে যায় এ প্রকল্প। পরে বন্দর কর্তৃপক্ষ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করাতে সক্ষম হলেও ঐ কোম্পানিকে কাজ দেয়া থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরপর বলা হয়েছে নৌবাহিনী দিয়ে কর্ণফুলী নদী ড্রেজিং করা হবে। এরই মধ্যে এ নদীর একটি অংশ অর্থাৎ বাকলিয়া থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত সাড়ে ৮ কিলোমিটার ড্রেজিং প্রকল্প প্রস্তাব দেয়ার পর তা অনুমোদিত হয়েছে। উক্ত অংশে ১২টি সøুুইস গেট স্থাপনের কথাও বলা হয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে ১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। স্বাভাবিকভাবে ধরে নেয়া যায় কর্ণফুলী বাকি অংশের ড্রেজিং বন্দর কর্তৃপক্ষই করবে। সবই হবে, হচ্ছে- শুধু আশার বাণী। কার্যক্ষেত্রে এর লেশমাত্র নেই। অপরদিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন গত রবিবার ২ হাজার ৩২৭ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে। ঘোষিত বাজেটে চট্টগ্রামের উন্নয়নে একগুচ্ছ পরিকল্পনা পেশ করা হয়েছে। কিন্তু প্রধান সমস্যা জলজট পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সুনির্দিষ্ট কোন আশার বাণী মিলেনি। এছাড়া বন্দরের কাজ করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। আর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাজ আগামীতে অন্য কেউ করার উদ্যোগ নেবে কি না তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চাউর হয়েছে। এক কথায় চট্টগ্রামকে নিয়ে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। এ নগরী প্রধান খাল চাক্তাইসহ ৩৬টি খাল বছরের পর বছর ভরাট হতে হতে বর্তমানে সমতল ভূমির সঙ্গে মিশে আছে। এছাড়া নদীগুলোর দু’পাড়ে অবৈধ নির্মাণ উচ্ছেদের কথা প্রায় সময় শোনা যায়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এর কোন প্রয়োগ নেই। কোথায় যেন সবকিছু আটকে যায়। এ দুর্ভাগ্য চট্টগ্রামের। কষ্টে নাভিশ্বাস চট্টগ্রামবাসী। গল্পেরও একটি শেষ আছে। কিন্তু চট্টগ্রামকে নিয়ে গল্পের শেষ হয় না। টাকার অংকে হাজার হাজার পরিমাণের কথা রূপকথার গল্পকেও হার মানাচ্ছে। চট্টগ্রামের এ দুঃখ বর্তমান সময়ের নয়। বহু আগে থেকে সৃষ্ট। এখন তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এর প্রমাণ মিলেছে এবারের বর্ষা মৌসুমে। ক্ষুব্ধ জনগণ সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে প্রতিনিয়ত এক হাত নিচ্ছে। সঙ্গে দুষছে সেবা সংস্থাগুলোর কর্ণধারদের। এসব নিয়ে সভা সমাবেশ, সিম্পোজিয়ামের শেষ নেই। সুপারিশ, উপদেশেরও শেষ নেই। পাল্টা বক্তব্যেরও কমতি নেই। কিন্তু কার কথা কে শোনে। কেউ বুঝে গাল মন্দ করছে। আর কেউ না বুঝে আলোচনা-সমালোচনায় লিপ্ত থাকছে। এবারের বর্ষায় কি পরিমাণ যে দুর্যোগ নেমে এসে ক্ষতির সৃষ্টি করেছে তা অবর্ণনীয়। চট্টগ্রামের এ অবস্থার কারণে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যিক কার্যক্রমও ব্যাহত হয়েছে চরমভাবে। বন্দরে কন্টেনারের জট লেগেছে গত ঈদ-উল ফিতরের পর থেকে। সে জটের অবসান হয়নি। বিশেষ করে গার্মেন্টস রফতানিকারকরা মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ। তাদের পক্ষ থেকে বন্দরের অযোগ্য কর্মকর্তাদের অবিলম্বে অপসারণ করে যোগ্যদের হাতে বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার দাবিও জানানো হয়েছে। এ দাবি ধোপে টিকবে কিনা তা বলবে ভবিষ্যত। তবে এ কথা সত্য যে, চট্টগ্রামে সরকারী সেবামূলক বিভিন্ন সংস্থার অভ্যন্তরে এক ধরনের বিপর্যয়কর পরিবেশ বিরাজ করছে। আবার অনেকে নানা কারণে হতাশায় নিমজ্জিত। ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পও অনুমোদিত হয়েছে। সর্বাগ্রে রয়েছে কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ প্রকল্প। এ প্রকল্পের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ মূল কাজ শুরু হওয়ার কথা। এ প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। এক্ষেত্রেও এ ব্যয় আগামীতে যে বাড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু বিশেষজ্ঞ সূত্রে বার বার বলা হচ্ছে এত বড় বড় প্রকল্প সময়োপযোগী। কিন্তু মূল সমস্যায় হাত দেয়া হচ্ছে না কেন। আর যে কারণে এ নগরী অথৈই পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা। জোড়াতালি দিয়ে মেরামতের কাজ চলতে দেখা যায় মাঝে মধ্যে। কিন্তু সফলতা আসার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি যেন যে লাউ সে কদু। নগর পরিকল্পনাবিদদের মধ্যে যেখানে ৪২টি খালের মধ্যে ৩৬টিই অস্তিত্ব হারিয়েছে এবং এ নগরীর প্রাণ কর্ণফুলী নদীতে চরের পর চর সৃষ্টি হয়ে নৌযান চলাচল রীতিমতো বন্ধই হয়ে আছে। বাকি রয়েছে সদরঘাট থেকে কর্নফুলী নদীর মোহনাটুকু। উজান থেকে আসা পলি এখন সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের অপমৃত্যুর পর এ নদীর কিছু অংশ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ আর কিছু অংশ নৌবাহিনী দিয়ে ড্রেজিং করানোর কথা গল্পের মতোই শোনা যায়। বাস্তব পরিস্থিতি তা-ই বলে দিচ্ছে। বর্ষণ পরিস্থিতি চলাকালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সমস্যা উত্তরণের ৫ হাজার ৬শ কোটি টাকার পরিকল্পনা পেশের কথা বলা হয়েছে। এ প্রকল্প কখন অনুমোদিত হবে তার কোন ইয়ত্তা নেই। এ পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কর্ণফুলী নদীর প্রায় ৮ কিলোমিটার এলাকা ড্রেজিং প্রকল্প অনুমোদিতও হয়েছে। কাজও নাকি শুরু হবে। কিন্তু উজান থেকে পলি আসাত থেমে নেই। এ নদীর ওপর পিলারের তিনটি ব্রিজ নির্মাণের পর থেকেই ভরাটের এ চিত্র। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নগর অভ্যন্তরে থাকা খালগুলো একের পর এক ভরাট হতে থাকা। সর্বশেষ এবারের বর্ষা মৌসুমে এর প্রতিফলন ঘটেছে যাহা মহাদুর্যোগকেও ছাড়িয়েছে। এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর পরিস্থিতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বেসরকারী আইসিডির (ইনল্যান্ড কন্টেনার ডিপো) লাইসেন্স বাতিল করতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন। গত ৩১ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত এক সভায় আলোচনায় উঠে আসে যে, বেসরকারি আইসিডিগুলো পণ্য আমদানি-রফতানিতে সহযোগিতা দিচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী এও বলেন, এসব আইসিডি ‘ইউজলেস।’ প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে যে ভয়াবহ কন্টেনার জট পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে তিনি বেসরকারী আইসিডি নিয়ে এমন বক্তব্য দিলেন। আরও আগে চট্টগ্রাম বন্দরের ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বেসরকারী আইসিডি সরানোর নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু এসব নির্দেশ সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে আছে। কন্টেনার পরিবহনে নিয়োজিত লরিগুলো সাধারণ যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে অত্যন্ত পীড়াদায়ক। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত খালি ও পণ্য বোঝাই কন্টেনার লরির লাইন এমন যানজট সৃষ্টি করে যা যান চলাচলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অচলাবস্থার সৃষ্টি করে। এ একটি মাত্র সড়কে বিভিন্ন ফ্লাইটের যাত্রীরা সময়মতো বিমানবন্দরে পৌঁছুতে না পেরে ফ্লাইট মিস করার অহরহ ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে বিদেশী উদ্যোক্তা ও কর্মে নিয়োজিতরা এ নিয়ে ত্যক্ত বিরক্ত। বর্তমানে সেবা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে আশার বাণী শুনেই ক্ষান্ত থাকতে হচ্ছে নগরবাসীকে। জলজটে একাকার হয়ে এ নগরীর দুরবস্থা যেন পাহাড়সম তখন এসব সংস্থার পক্ষ থেকে প্রকল্পের পর প্রকল্প গ্রহণের কথা কেবলই গল্পের মতো শোনায়। গল্প তো গল্পই। সব গল্প বিশ্বাস করা যেমন কঠিন। তেমনি বাস্তবেও তাই হয়ে আসছে। অতীত ঘটনাবলী তাই বলছে। এখানে আরও উল্লেখ্য, কয়েক মাস আগে প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম সফরে এসে বিমানবন্দর এলাকার সড়কের বেহাল দৃশ্য দেখে এতই ক্ষিপ্ত হন যে, তিনি রীতিমতো প্রকাশ্যে সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতি ওয়ার্নিং দিয়ে যান। তিনি এও বলেন, পুনরায় তিনি চট্টগ্রাম আসলে যেন এসব সড়ক, ব্রিজ, কালভার্টের অনুরূপ অবস্থা যেন আর না দেখেন। এর মাস দুয়েকের মধ্যেই ওই সড়কের সবকিছু ইতোমধ্যে ঠিকঠাক হয়ে গেছে।
×