ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নওয়াজ যেভাবে ফাঁসলেন

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ২৯ জুলাই ২০১৭

নওয়াজ যেভাবে ফাঁসলেন

পানামাভিত্তিক আইনী প্রতিষ্ঠান মোওস্যাক ফনসেকার এক কোটি দশ লাখ নথি ফাঁস হওয়ার পর বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে কাগুজে কোম্পানি হিসেবে পরিচিত অফশোর কোম্পানির সম্পর্কের কথাও প্রকাশ হয়ে গেছে। পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পরিবারের সদস্যরা তাদের মধ্যে অন্যতম। পরবর্তীতে বেসামরিক ও সামরিক সংস্থার সদস্যদের নিয়ে গঠিত কমিটি নওয়াজের বিরুদ্ধে তদন্তে নামলে তিনি দোষী প্রমাণিত হন। খবর বিবিসি অনলাইনের। গত বছরের এপ্রিলে এসব নথি ফাঁস হয়েছে। সেখান থেকে জানা যায়, নওয়াজ শরিফের তিন সন্তান মরিয়াম, হাসান ও হুসেনও অফশোর কোম্পানির মালিক। পারিবারিক সম্পদের বিবরণীতে সেই কোম্পানির কথা গোপন রাখা হয়েছিল। ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপে তাঁর পরিবারের মালিকানাধীন এ পর্যন্ত তিনটি কোম্পানি শনাক্ত করা হয়েছে। সেগুলো হলো, নেসকল লিমিটেড, নিলসেন এন্টারপ্রাইজ ও হ্যাঙ্গন প্রোপার্টি হোল্ডিংস লিমিটেড। ১৯৯৩, ১৯৯৪ ও ২০০৭ সালে এসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়। বিদেশে সম্পদ ক্রয়ে এসব কোম্পানির মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। বিশেষভাবে ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনের মেফেয়ার এলাকায় পার্ক লেনে এ্যাপার্টমেন্ট কিনতে এ তিন কোম্পানির মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়েছে। অবৈধ পথে সম্পদ অর্জন করে তা বিদেশে পাচার করতে এবং কর এড়াতে এসব কোম্পানিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও নওয়াজ শরিফ ও তার পরিবার শুরু থেকেই সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তাঁরা সুপ্রীমকোর্টকে বলেছিলেন, কাতারের ক্ষমতাসীন পরিবারের মালিকানাধীন কোম্পানি থেকে বিনিয়োগ নিয়ে তারা লন্ডনের সম্পত্তি ক্রয় করেন। তবে তথ্য ফাঁস হওয়ার পর থেকেই তাঁর দলের শীর্ষ নেতারা আতঙ্কের ভেতরে রয়েছেন। দীর্ঘ এক বছরের প্রক্রিয়ার পর নওয়াজকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করতে দেশটির উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত এসেছে। এ সময়ে আদালত কয়েক হাজার পাতার নথি ঘাঁটাঘাটি করেছেন। দুই পক্ষের আইনজীবীদের ব্যাপকভাবে শুনানিতে অংশ নিতে হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে আদালত তাদের যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি শুনেছেন। পানামা পেপারস এমন সময়ে ফাঁস হয়েছিল যখন নওয়াজ সবে বিরোধী নেতা ইমরান খানের ইসলামাবাদ অবরোধ থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছেন। ২০১৪ সালে পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতা ইমরান খান ইসলামাবাদ চার মাস অবরোধ করে রাখলে রাজধানী প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল। তখন মনে করা হয়েছিল, নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকটি অংশের সমর্থনে ইমরান খানের এ অবরোধ। যাতে সেনাবাহিনীকে বাদ দিয়ে নওয়াজ স্বাধীনভাবে অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতির ওপর কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন, সেজন্য তেহরিক নেতাকে দিয়ে তাঁকে চাপে রাখা হয়েছে। কিন্তু পানামা পেপার ফাঁস হলে নওয়াজ সরকার ফের চাপে পড়ে। ইমরান খানসহ বেশ কয়েকটি ছোট রাজনৈতিক দল তাঁর পদত্যাগ দাবি করতে শুরু করে। এমনকি তারা আবারও ইসলামাবাদ অচল করে দেয়ার হুমকি দেয়। এরপর বিরোধী দলগুলো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নওয়াজ শরীফকে অযোগ্য ঘোষণা করতে আদালতে মামলা দায়ের করে। কিন্তু গত জুনে তাঁর বিরুদ্ধে যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ না পেয়ে প্রথমে আদালত তাঁকে খালাস দিয়ে দেয়। পরবর্তীতে গত বছরের অক্টোবরে সুপ্রীমকোর্ট পাঁচ সদস্যের একটি বেঞ্চ গঠন করে শুনানি গ্রহণ শুরু করে। এরপর সামরিক ও বেসামরিক তদন্ত সংস্থা থেকে সদস্য নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে তাদের হাতে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয় আদালত। তদন্ত শেষ করতে দুই মাস সময় নিয়েছিল কমিটি। যদিও সমালোকরা বলেন, পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রে তদন্ত করতে তিন মাস খুবই অল্প সময়। এত বিশাল একটি তদন্ত এত কম সময়ে শেষ করা সম্ভব না বলেও তাঁরা সন্দেহ পোষণ করেন। এমনকি পাঁচ বিচারকের মধ্যে প্রধান বিচারপতিসহ দুইজনকে নিয়েও তারা প্রশ্ন তোলেন। আসিফ আলী জারদারি ও ইমরান খানসহ বিরোধী দলের নেতারা সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগেরও দাবি জানিয়েছিলেন। অনেকের মতে, সুপ্রীমকোর্ট এখন দুর্নীতির অভিযোগে ধরপাকড় শুরু করার নির্দেশ দেবেন। গণতন্ত্রের জন্য তা ভাল লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু কেউ কেউ ভিন্ন কিছুও ভাবছেন। তারা এই মামলায় দেশটির শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর কারসাজি দেখতে পাচ্ছেন। তাদের ধারণা, সামরিক বাহিনী বেসামরিক সরকারের সিদ্ধান্তকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। দেশটির দীর্ঘ ইতিহাসে যা দেখা গেছে। নওয়াজ পরিবারের বিরুদ্ধে এ মামলার পনেরো মাসের শুনানিতে বহু বিতর্কের জন্ম হয়েছে। মামলাটি ছিল ফৌজদারি আদালতে। কিন্তু সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ প্রথমে মামলাটির শুনানি করতে অস্বীকার করেছে। পরবর্তীতে তারা কেবল মামলা শুনানি করতেই রাজি হননি, এক নজিরবিহীন পদক্ষেপও নিয়েছেন। তা হলো, আদালত নিজেরাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যাতে অধিকাংশ সদস্যই সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের। নওয়াজ শরীফ হলেন পাকিস্তানের আঠারোতম প্রধানমন্ত্রী। আর একটি বছর পার করে দিতে পারলেই তিনি পাকিস্তানের ইতিহাসে পূর্ণ মেয়াদ শেষ করা প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেকর্ড গড়তে পারতেন। কিন্তু তার জন্য সেই সুযোগ রইল না। দেশটির প্রতিষ্ঠার পর থেকে একজন প্রধানমন্ত্রীও তাদের পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। সুপ্রীমকোর্টের রায় ঘোষণার পর বিরোধীদলীয় সদস্যদের আদালতের বাইরে আনন্দোৎসব ও মিষ্টি বিতরণ করতে দেখা গেছে।
×