ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সেমিনারে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী

মালয়েশিয়ায় ধরপাকড় বন্ধ হয়েছে, সমস্যা সমাধানে চেষ্টা চলছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৭ জুলাই ২০১৭

মালয়েশিয়ায় ধরপাকড় বন্ধ হয়েছে, সমস্যা সমাধানে চেষ্টা চলছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে সিন্ডিকেট বাংলাদেশ সরকার করেনি। করেছে মালয়েশিয়ার সরকার। বাংলাদেশ সরকার প্রায় ১১শ’ এজেন্সির তালিকা পাঠিয়েছে। কিন্তু তারা সেখানে মাত্র ১০টি জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে কাজ করার অনুমোদন দিয়েছে। ১০টিতে রাজি না হলে তারা মালয়েশিয়ার বাজার আবারও বন্ধ করে দিতে পারে। সবদিক বিবেচনা করেই আমরা রাজি হয়েছি। বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে দূতাবাসের মাধ্যমে আলোচনা করা হচ্ছে। আশা করছি একটা সমাধানে আসা যাবে। রবিবার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে জনশক্তি রফতানি খাতে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন রিপোর্টার্স ফর বাংলাদেশী মাইগ্র্যান্টস (আরবিএম) আয়োজিত ‘মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সেমিনারে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন। সেমিনারে মন্ত্রী জানান, মালয়েশিয়ায় অবৈধ বাংলাদেশী প্রবাসীদের বিরুদ্ধে দেশটির সরকার অভিযান বন্ধ করেছে। কারণ, তাদের দেয়া সময় অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত অবৈধদের বৈধতার জন্য সময় রয়েছে। কিন্তু তারা হঠাৎ করেই অভিযান শুরু করেছে। এরপরই সরকারের পক্ষ থেকে তাদের জানানো হলে, তারা অভিযান বন্ধ করে। আজ সোমবার মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে দূতাবাস আলোচনায় বসবে। আমাদের পদে পদে সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এসব সমস্যা হঠাৎ করেই সমাধান করা সম্ভব হবে না। তবে এসব সমস্যা সমাধানে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। সরকার জাপান ও রাশিয়াসহ আরও বেশ কিছু নতুন শ্রমবাজার খোলার বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে বলে মন্ত্রী জানান। রিপোর্টার্স ফর বাংলাদেশী মাইগ্র্যান্টস (আরবিএম) সভাপতি ফিরোজ মান্নার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মাসউদুল হকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন আরবিএম’র নির্বাহী সদস্য মহসীনুল করিম। বক্তব্য রাখেন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব জাবেদ আহমেদ, বিএমইটির ডিজি সেলিম রেজা, রামরুর নির্বাহী পরিচালক ড. সি আর আবরার, বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী, বায়রার যুগ্ম-মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান, সাবেক বায়রা মহাসচিব রিয়াজুল ইসলাম, ব্র্যাকের হেড অব মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম শরীফুল হাসান, বায়রার সাবেক মহাসচিব মনসুর আহমেদ কালাম ও বায়রার সহ-সভাপতি আবদুল হাই বক্তব্য রাখেন। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব জাবেদ আহমেদ বলেন, অভিবাসন ব্যয় ও মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেট নিয়ে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় আছে। এ নিয়ে আমরা কাজ করছি। তবে অনেক সমস্যার সমাধান একদিনে করা যাবে না। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে সিন্ডিকেট প্রসঙ্গ নিয়ে আদালতে মামলা রয়েছে। তাই আমরা কোন পদক্ষেপ নিতে পারছি না। যেসব বিষয়ে কোন মামলা নেই, আমরা সেসব বিষয় নিয়ে কাজ করছি। অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় কমানোর জন্য সরকার অভিবাসন ব্যয় নিয়ে কাজ করছে। আমাদের অভিবাসন ব্যয় অনেক বেশি। পৃথিবীর অনেক দেশেই অভিবাসন ব্যয় এত বেশি না। তারা যতদূর সম্ভব অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে কর্মী পাঠাতে চেষ্টা করে। যে কারণে নেপালের কর্মীরা এখন বিভিন্ন দেশে বাড়ছে। আমাদেরও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে পড়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন জনশক্তি প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক সেলিম রেজা বলেন, বাংলাদেশের শ্রমবাজার সংকুচিত হচ্ছে না, বরং কর্মী প্রেরণের পরিমাণ বাড়ছে। এর আগে একবছরে আমরা সর্বোচ্চ ৮ লাখ ৭৫ হাজার কর্মী পাঠাতে পেরেছি। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম সাড়ে ছয় মাসে কর্মী পাঠানো হয়েছে ৫ লাখ ৫৪ হাজার। যা বছর শেষে অতীতের রেকর্ড ভেঙ্গে ১০ লাখ অতিক্রম করবে। বিভিন্ন দেশে এখনও ভিসা বিক্রির মতো ঘটনা ঘটায় দেশের অভিবাসন ব্যয় কমানো সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি। নারী পাসপোর্ট না থাকলে পুরুষদের ভিসা পাওয়ার জটিলতা প্রসঙ্গে বায়রার যুগ্ম-মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, সৌদি আরবে পুরুষ কর্মীদের পাঠানোর জন্য নারী পাসপোর্ট বাধ্যতামূলক করে বিদ্যমান নির্দেশনা ইতোমধ্যেই স্থগিত করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে নারী পাসপোর্ট ছাড়াই পুরুষদের ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দেয়া যাবে। এতে দেশটিতে ভবিষ্যতে পুরুষ কর্মীর পাঠানোর সংখ্যা আরও বাড়বে। অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় এবং বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট ব্যবস্থাকে অভিবাসন খাতের বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে রামরুর নির্বাহী পরিচালক ড. সিআর আবরার বলেন, এ ধরনের অবস্থা কাক্সিক্ষত নয়। দেশের শ্রমবাজার বাঁচাতে এ ধরনের সিন্ডিকেট ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। অভিবাসন ব্যয়ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় কর্মীরা গিয়ে বেকার হয়ে পড়ছে। এসব কর্মীদের দূতাবাসের মাধ্যমে সুরক্ষা দিতে হবে। বিভিন্ন দেশের শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময়সীমা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারত, ফিলিপিন্স, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে যেখানে ১৫ দিন থেকে ২৮ দিনের মধ্যেই এ প্রক্রিয়া শেষ হয়, সেখানে বাংলাদেশে লাগে আড়াই মাস থেকে তিন মাস। এ অবস্থা দূর করতে পারলে কর্মীদের দুর্ভোগ কমে আসবে। তিনি বিভিন্ন দেশের কর্মী প্রেরণে অভিবাসন ব্যয় এবং সিন্ডিকেট ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান। সাবেক বায়রা মহাসচিব রিয়াজুল ইসলাম মালয়েশিয়ায় এখন পর্যন্ত মাত্র ১০ হাজার কর্মী পাঠানো হলেও মেডিক্যাল পরীক্ষা হয়েছে ১ লাখ ২ হাজার লোকের। তাদের সবার কাছ থেকে প্রায় ৬ হাজার করে টাকা নেয়া হয়েছে। মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের অভিবাসন ব্যয় ৩৭ হাজার টাকা হলেও এদের কাছ থেকে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা নেয়া হচ্ছে। ব্র্যাকের হেড অব মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম শরীফুল হাসান বলেন, মালয়েশিয়ার নতুন করে কর্মী পাঠানোর চেয়ে অবৈধ বাংলাদেশীদের বৈধতা দেয়া এবং অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রণই এই মুহূর্তে শ্রম খাতের সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। ইউরোপে অবৈধ অভিবাসী যাওয়ার বন্ধ না করলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বিশ্বের প্রায় ১৬০ দেশে বাংলাদেশী কর্মীর বাজার থাকলেও এখন পর্যন্ত মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোই হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার। কিন্ত এই শ্রমবাজার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে অস্থিরতা। একদিকে কোটা বহির্ভূত ও অনুমোদিত কর্মী প্রেরণ আর অন্যদিকে অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়ের কারণে দেশগুলোতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বর্তমানে একেবারেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারী উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টায় সম্প্রতি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুললেও সেখানে কাক্সিক্ষত মাত্রায় কর্মী প্রেরণ সম্ভব হচ্ছে না নানান কারণে। এজন্য একদিকে যেমন সরকারী নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়ের তুলনায় অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণের অভিযোগকে দায়ী করা যায়, অন্যদিকে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের কাছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার জিম্মি হয়ে থাকাও দায়ী। দেশে বর্তমানের সরকারের অনুমোদিত প্রায় এক হাজার ৪শ’ জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান থাকলেও মালয়েশিয়ার একটি প্রভাবশালী চক্রের মাধ্যমে দেশটিতে জনশক্তি রফতানির অনুমোদন পেয়েছে মাত্র ১০ প্রতিষ্ঠান। যদিও সরকার বা ওই সিন্ডিকেটের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের অধীনে আরও প্রায় ২৬০টি জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে সংযুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে এর কোন বাস্তব প্রভাব নেই। ফলে দেশটিতে জনশক্তি রফতানি হতাশাজনকভাবে কমেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে শুরু করে, গত প্রায় সাড়ে ছয় মাসে দেশটিতে এখনও পাঁচ হাজার কর্মীও পাঠানো সম্ভব হয়নি, জিটুজি প্লাস ব্যবস্থায়। অথচ মালয়েশিয়ার সঙ্গে বিদ্যমান চুক্তি অনুযায়ী, এই সময়ে দেশটিতে অন্তত আড়াই লাখ কর্মী পাঠানোর কথা। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সোচ্চার জনশক্তি রফতানিকারকরা সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ অব্যাহত রাখলেও কার্যত : কিছুই করতে পারছেন না, সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত মালয়েশিয়ার প্রভাবশালীদের কারণে। বরং এই চাপের কারণে বাংলাদেশী কর্মী প্রেরণ কমলেও দেশটিতে অন্য দেশের কর্মীরা ঠিকই ঢুকে পড়ছে। বঞ্চিত হচ্ছে দেশের লাখ লাখ বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রত্যাশী নারী ও পুরুষ।
×