ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ডলারে উঠবে ॥ সংসদে প্রধানমন্ত্রী

’৪১ সালের মধ্যে দেশের অর্থনীতি হবে আড়াই ট্রিলিয়ন ডলারের

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২২ জুন ২০১৭

’৪১ সালের মধ্যে দেশের অর্থনীতি হবে আড়াই ট্রিলিয়ন ডলারের

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি এশিয়ার আঞ্চলিক অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। আমাদের অনুসৃত উন্মুক্ত অর্থনীতি উপ-আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং ব্যবসা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে উইন-উইন অবস্থান তৈরি করে সাফল্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ আড়াই ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হবে এবং জনপ্রতি মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে টেবিলে উত্থাপিত প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য দিদারুল আলমের প্রশ্নের লিখিত উত্তরে প্রধানমন্ত্রী আরও জানান, দেশে শিল্প বিকাশ ও বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়াতে আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যমান বিনিয়োগ পরিবেশ আরও উন্নত করার লক্ষ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্পে বিভিন্ন পরিসেবা, ভূমির নিশ্চয়তা, প্রতিযোগিতামূলক প্রণোদনা এবং ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রদানসহ বিনিয়োগ বান্ধব আইন ও নীতিমালা করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বেসরকারী খাতকে দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি ধরে স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বেসরকারী খাতের উন্নয়নে আর্থিক নীতিনির্ধারণ ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গঠনে আমাদের সরকারের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। বিদেশী বিনিয়োগ আনতে আমরা ব্যাপক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে আমরা একশত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। যেখানে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ হবে। শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠবে এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। তিনি আরও জানান, ২০২১ সালে আইটি সেক্টরে ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান এবং এ সেক্টর থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করার টার্গেট নিয়ে কালিয়াকৈরে ৩৫৫ একর জমির ওপর পিপিপি’র ভিত্তিতে হাই-টেক পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি)’র অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। একইভাবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)’র সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যসমূহ ২০৩০ সালের মধ্যেই অর্জন করে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী এসডিজি বাস্তবায়নেও রোল মডেল হিসেবে পরিচিত হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারসের (পিডব্লিইসি) ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ২৯তম এবং ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে। যার বর্তমান অবস্থান ৩১তম। ৪৫ বছরে বিদ্যুত উৎপাদন ১৩ হাজার মেগাওয়াট সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মামুনুর রশীদ কিরণের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের মে মাস হতে ২০১৭ পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারের মেয়াদে দেশে মোট ১৩ হাজার ৫৯৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু পুরানো বিদ্যুত কেন্দ্র বিভিন্ন সময়ে অবসরে যাওয়ার কারণে বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে ১৩ হাজার ১৭৯ মেগাওয়াট বিদ্যুত যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ক্যাপটিভসহ ১৫ হাজার ৩৫১ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। বিভিন্ন সরকারের মেয়াদে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার বিদ্যুতের পরিমাণ তুলে ধরেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২-১৯৮১ সালে ২৮৬ মেগাওয়াট, ১৯৮২-১৯৯০ সালে ১ হাজার ৫৮৮ মেগাওয়াট, ১৯৯১ সালের মার্চ-১৯৯৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ৫৮৮ মেগাওয়াট, ১৯৯৬ সালের জুন হতে ২০০১ সালের জুলাই পর্যন্ত ১ হাজার ২০৮ মেগাওয়াট, ২০০১ সালের অক্টোবর হতে ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১ হাজার ২৪০ মেগাওয়াট, ২০০৬ সালের অক্টোবর হতে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৪৬ মেগাওয়াট এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারি হতে ২০০৭ সালের মে পর্যন্ত ৮ হাজার ৩৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার দেশের বিদ্যুত চাহিদা পূরণ ও ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুত সুবিধা নিশ্চিত করার উদ্দেশে প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ পরিকল্পনায় জানুয়ারি ২০১৭ হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৬ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার নতুন বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে কার্যক্রম অব্যাহত আছে। বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গৃহিত পরিকল্পনার অগ্রগতি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী জানান, বর্তমানে সরকারী খাতে ৬ হাজার ৭০৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৬টি এবং বেসরকারী খাতে ৪ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৮টি বিদ্যুত কেন্দ্রসহ মোট ১১ হাজার ৩৬৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৪টি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্রসমূহ ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে চালু হবে বলে আশা করা যায়। তিনি বলেন, সরকারী খাতে ২ হাজার ৭৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৮টি এবং বেসরকারী খাতে ২ হাজার ৮৪৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২৬টি বিদ্যুত কেন্দ্রসহ সর্বমোট ৪ হাজার ৯১৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৪টি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, সরকারী খাতে ৬ হাজার ৪১৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১১টি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনাধীন রয়েছে। আগামী জুলাই ২০১৮ নাগাদ ভারত থেকে আরও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির কার্যক্রম চলছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র হতে ২০২৩ সালের মধ্যে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং ২০২৪ সালের মধ্যে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। প্রতিবছরে দুই লাখ ক্যান্সারে আক্রান্ত সরকারদলীয় সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে প্রতিবছর ২ লাখেরও বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন, আর এই চিকিৎসাও ব্যয়বহুল, বিশেষ করে দরিদ্র, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য চিকিৎসা ব্যয় কষ্টসাধ্য- কথাটি সত্য। তিনি বলেন, ক্যান্সারের ওষুধের বিদেশ নির্ভরতা কমাতে এবং উচ্চমূল্যের ওষুধ সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনার জন্য দেশীয় কোম্পানিগুলোকে ক্যান্সারের ওষুধ প্রস্তুতের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। যাতে ওষুধের ক্রয়মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনা যায়। ক্যান্সারের চিকিৎসা বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে দেশের পুরাতন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে নতুন রেডিওথেরাপি মেশিন সংযোজনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাত থ্রাস্ট সেক্টর তরিকত ফেডারেশনের সংসদ সদস্য এম এ আউয়ালের প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা জানান, বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতকে সরকার থ্রাস্ট সেক্টর হিসেবে ঘোষণা করছে। এ খাতের গুরুত্ব অপরিসীম বিবেচনায় সরকার বিদ্যমান শ্রম বাজার ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন নতুন শ্রম বাজার সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছে। বিগত জোট সরকারের আমলে যেখানে বিশ্বের মাত্র ৯৭টি দেশে কর্মী প্রেরণ করা হতো, সেখানে নতুন আরও ৬৫টি দেশে কর্মী প্রেরণসহ বর্তমানে এই সংখ্যা ১৬২টি দেশে উন্নীত করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। নতুন শ্রম বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহও শ্রম বাজার সম্প্রসারণে কাজ করছে। তিনি জানান, বিশ্বের ১৬২টি দেশে ১ কোটিরও বেশী বাংলাদেশী কর্মী কর্মরত আছেন। বিদেশে যেসব প্রবাসী অবৈধ অবস্থায় আছে তাদের সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনের মাধ্যমে বৈধকরণ, আইনী সহায়তা প্রদান এবং দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মানব পাচার প্রতিরোধ, অবৈধ কর্মীদের বৈধতা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য হ্রাসসহ নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আন্তঃদেশীয় মহাসড়ক নেটওয়ার্ক সরকারদলীয় সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মহাসড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়নের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে মহাসড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি জানান, আন্তঃদেশীয় আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ মহাসড়ক নেটওয়ার্ক সর্বাধিক গুরুত্ব বহন করে। ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধার কারণে পাঁচটি আন্তঃদেশীয়, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক মহাসড়ক নেটওয়ার্ক উদ্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পৃক্ত। তিনি জানান, ২০১৫ সালের ১৫ জুন ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে বিবিআইএন স্বাক্ষরিত হওয়ার ফলে চার দেশের মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি, যাত্রীবাহী যানবাহন এবং পণ্য পরিবহনের জন্য পণ্যবাহী যান চলাচল করতে পারবে। ইতোমধ্যে ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল চুক্তিটি অনুসমর্থন করেছে। আশা করা যায়, ভুটানও সহসাই চুক্তিটি অনুসমর্থন করবে। চার দেশের অনুসমর্থনের পর চুক্তিটি বাস্তবায়ন হবে।
×