ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গী হারুনকে ধরতে গোয়েন্দারা মাঠে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৫ মে ২০১৭

মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গী হারুনকে ধরতে গোয়েন্দারা মাঠে

শংকুর কুমার দে ॥ জামা’আতুল মুসলেমিন জঙ্গী সংগঠনের বাংলাদেশ শাখার আমির মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গী নেতা রেজওয়ান হারুনকে গ্রেফতার করতে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা। চারদিন আগে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের চোখে ফাঁকি দিয়ে দেশের ভেতরে ঢুকে লাপাত্তা হয়ে গেছে। তার সঙ্গে জঙ্গী তৎপতায় জড়িত আরও অন্তত এক ডজন শীর্ষ জঙ্গী নেতারও খোঁজ করা হচ্ছে। জঙ্গী নেতা রেজওয়ান হারুন গত ১১ মে যুক্তরাজ্য থেকে এমিরেটসের ফ্লাইটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের চোখে ফাঁকি দিয়ে দেশে ঢুকে উধাও হয়ে গেছে। এই ঘটনায় রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে জঙ্গী নেতা রেজওয়ান হারুন দেশে এসে আত্মগোপন করেছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেছেন, রেজওয়ান চারদিন আগে যে দেশে এসেছে, তা সিসিটিভির ফুটেজে ধরা পড়েছে। সে দুটি বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করছে। তা হলোÑ বিএইচ-০৬৩৪১৩৭ ও এই-৬০১৬৯৩৩ নম্বরের। দুটি পাসপোর্টের মেয়াদ রয়েছে। রেজওয়ান হারুনের ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তি রয়েছে, যারা এরই মধ্যে জঙ্গী দলে জড়িয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে লেকহেড গ্রামার স্কুলের সাবেক শিক্ষক ফারজাদ হক তুরাজ। দীর্ঘদিন ধরে সে নিখোঁজ রয়েছে। রেজওয়ানের ঘনিষ্ঠদের তালিকায় আছে লেকহেড গ্রামার স্কুলের সাবেক শিক্ষক তেহজীব করিম ও রাজীব করিম। রাজীব করিম বর্তমানে যুক্তরাজ্যের কারাগারে রয়েছে। ঘনিষ্ঠদের তালিকায় আরও রয়েছে লেকহেড গ্রামার স্কুলের সাবেক শিক্ষক তাসনুভা হায়দার, ইয়াছিন তালুকদার, ব্লগার রাজীব হত্যা মামলায় অভিযুক্ত রেদওয়ানুল আজাদ রানা, লেকহেড গ্রামার স্কুলের সাবেক শিক্ষক মহিউদ্দিন শরীফ, ইফতেখার আহমেদ সনি, আরিফুর রহমান, লেকহেড গ্রামার স্কুলের সাবেক অধ্যক্ষ জেনিফার আহমেদ, মনিরুজ্জামান মাসুদ, তেহজীব করিমের স্ত্রী সিরাত করিম ও ড. রেজাউর রাজ্জাক। জঙ্গী সম্পৃক্ততার অভিযোগে দীর্ঘদিন ধরে রেজওয়ান হারুনকে খুঁজছিল একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এত দিন দেশের বাইরে থাকায় তাকে গ্রেফতার করা যাচ্ছিল না। চারদিন আগে সকাল ৮টার দিকে যুক্তরাজ্য থেকে সে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দেশে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এত নিরাপত্তা নিরাপত্তা তল্লাশি ফাঁকি দিয়ে কিভাবে রেজওয়ান দেশে ঢুকল তা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। চারদিন আগে দেশে এসে কোথায় লুকিয়েছে, তার হদিস করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, জঙ্গী নেতা রেজওয়ান হারুন কয়েক বছর ধরে উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের জঙ্গীবাদের পথে নিতে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছিল। তার সঙ্গে জামা’আতুল মুসলেমিনের আমির জর্ডানের নাগরিক আবু ইসা আল রাফাইয়ের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। যুক্তরাজ্যে চলে যায় এই জঙ্গী নেতা। ২০০২ সাল থেকে আলকায়েদার আদর্শে বিশ্বাসী রেজওয়ান বাংলাদেশী কিছু তরুণকে টার্গেট করে জঙ্গীবাদের পথে আনার চেষ্টা চালিয়ে কথিত জিহাদে অংশ নিতে তাদের উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ১৩টি জেলায় জামা’আতুল মুসলেমিনের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করা হয়। জঙ্গী তৎপরতার জন্য ২০০৫ সালে ওই সংগঠনকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। পরে সংগঠনের সদস্যরা রিসার্চ সেন্টার ফর ইউনিটি ডেভেলপমেন্টের (আরসিইউডি) নামে একটি এনজিও খুলে তার আড়ালে জঙ্গীবাদী কার্যক্রম শুরু করে তারা। তখন ড. রেজাউল রাজ্জাক জামা’আতুল মুসলেমিনের আমির হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করে। ওইসময় রেজওয়ান জামা’আতুল মুসলেমিনের সঙ্গে জড়িত হয়। রাজধানীতে তার নিজেদের বাড়িতে চলে উগ্রপন্থী তৎপরতা। এ ছাড়া বনানীতে একটি কার্যালয়ে সাঙ্গপাঙ্গকে নিয়ে সে প্রায়ই গোপন কার্যক্রম চালায়। সেখানে যাতায়াত ছিল আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের (এবিটি) প্রধান মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানিরও। পরে ধানম-ির লেকহেড গ্রামার স্কুলেও গোপনে উগ্রবাদী তৎপরতা শুরু করে রেজওয়ান। ওই স্কুলে যাতায়াত ছিল হিযবুত তাহরীর আদর্শে বিশ্বাসী অধ্যাপক গোলাম মাওলার। ২০০৬ সালে ধানম-ির ৬/এ সড়কে প্রতিষ্ঠিত হওয়া লেকহেড গ্রামার স্কুলের বিরুদ্ধে জঙ্গী তৎপরতায় ইন্ধন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এই স্কুলের বনানী ও গুলশানে আরও দুটি শাখা রয়েছে। প্রতিষ্ঠাকালীন এই স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন জেনিফার আহমেদ। সে দেশে হিযবুত তাহরীরের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম মাওলার স্ত্রী। জেনিফার নিজেও হিযবুতের সঙ্গে যুক্ত ছিল। লেকহেড গ্রামার স্কুল তৈরির মূল উদ্যোক্তা ছিলেন জেনিফার আহমেদের বাবা লতিফ আহমেদ। ২০০৯ সালে অধ্যক্ষের পদ থেকে সরে দাঁড়ায় জেনিফার। পরে লেকহেড গ্রামার স্কুলের দায়িত্ব নেন হারুন-অর-রশীদ। হারুন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কর্ণধার। এই হারুন-অর-রশিদের ছেলেই রেজওয়ান হারুন। রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত মেজর (অব) জাহিদুল ইসলামকে ওই স্কুলে প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদে চাকরি দেয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালে আহমেদ ওয়াদুদ জুম্মান ওরফে সাইফুল নামে এবিটির এক জঙ্গীকে মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। সে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে লেকহেড গ্রামার স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে। সে আলকায়েদার সাময়িকী ‘ইন্সপায়ার’-এর পঞ্চম খ বাংলায় অনুবাদ করার দায়িত্ব পালন করার অভিযোগ রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, লেকহেড গ্রামার স্কুলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজওয়ান হারুনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও। গত ২৩ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক চিঠিতে ওই অনুরোধ জানায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। লেকহেড গ্রামার স্কুলের পরিচালনার পূর্ণ দায়িত্ব নেন হারুন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের কর্ণধার হারুন-অর-রশিদ ও তার ছেলে রেজোয়ান হারুন। শুরু থেকেই এই স্কুলে এমন শিক্ষকরা কর্মরত ছিলেন, যাদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে জঙ্গী তৎপরতায় যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। নেপথ্যে থেকে তাদের সাংগঠনিক কাজকর্ম সম্পাদন করতেন রেজোয়ান হারুন। বেশিরভাগ সময় লন্ডনে থাকলেও চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি থেকে প্রকাশ্য চলাফেরা বন্ধ করে আত্মগোপন চলে যান তিনি। রেজোয়ান হারুনের লেকহেড গ্রামার স্কুলে আলোচিত যুক্তরাষ্ট্রগামী ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ উড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে গ্রেফতার হওয়া রাজীব করিম, তার ভাই তেহজীব করিম ও তেহজীবের স্ত্রী সিরাত করিম শিক্ষক ছিলেন। ২০১০ সালে ইয়মেনে আলকায়েদাবিরোধী অভিযোনে গ্রেফতার হয়েছিলেন তেহজীব করিম। তেহজীবের সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া মাইনুদ্দিন শরীফও এই স্কুলে শিক্ষকতার করতেন। এছাড়া পরিবারসহ সিরিয়ায় চলে যাওয়া মাইনুদ্দিনের ভাই রেজোয়ান শরীফও এই লেকহেডের শিক্ষক ছিলেন। রেজোয়ান হারুনের সঙ্গে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের আধ্যাত্মিক নেতা কারাবন্দী জসিমউদ্দিন রাহমানী, আনসারুল্লাহর আরেক শীর্ষ নেতা রেজওয়ানুল আজাদ রানা, পাকিস্তানে গ্রেফতার হওয়া বাংলাদেশী জঙ্গী ইফতেখার আহমেদ সনি, জঙ্গী কার্যক্রমের সঙ্গে অভিযুক্ত ও নিখোঁজ হওয়া ফারজাদ হক তুরাজ, জুবায়েদুর রহমান, তাসনুভা হায়দার, ইয়াসিন তালুকদার, আরিফুর রহমানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকা সবাই বিভিন্ন সময়ে রেজোয়ান হারুনের লেকহেড গ্রামার স্কুলে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকতা করেছেন। রেজোয়ান হারুন ব্রিটেনে থাকা অবস্থায় জামা’আতুল মুসলেমিন নেতা আবু ইসা আল রাফাই (জর্ডান থেকে ব্রিটেনে বসবাসকারী) এর মাধ্যমে জঙ্গীবাদে মোটিভেটেড হয়। ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশে সে জামা’আতুল মুসলেমিন সংগঠিত করার কাজ শুরু করে। আলকায়েদার অনুসারী জামা’আতুল মুসলেমিন বাংলাদেশে উচ্চবিত্ত তরুদের দলে ভেড়ানো শুরু করে। ২০০৫ সালে ব্ল্যাকলিস্টেড হওয়ার পর তারা আরসিইউডি (রিসার্স সেন্টার ফর ইউনিটি ডেভেলপমেন্ট) ছদ্মবেশে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। সর্বশেষ জামা’আতুল মুসলেমিনের আমির ছিলেন একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রেজাউর রাজ্জাক। রেজোয়ান হারুন ও রেজাউর রাজ্জাক মিলে আরসিইউডি পরিচালনার নামে জঙ্গী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গত বছরের ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার পর ড. রেজাউর রাজ্জাক মালয়েশিয়া পালিয়ে যান। এমনকি গুলশান হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের প্রশিক্ষণদাতা সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলামও লেকহেড গ্রামার স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতেন। নব্য জেএমবির শীর্ষ জঙ্গী নেতা ও সামরিক প্রশিক্ষক এই মেজর জাহিদ গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রূপনগরে জঙ্গীবিরোধী এক অভিযানে মারা যায়। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, জামা’আতুল মুসলেমিনের যুক্তরাজ্য শাখার আমির জর্দান বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের নাগরিক আবু ইসা আল রাফাইয়ের অনুসারী রেজওয়ান হারুন বড় ধরনের কোন নাশকতার পরিকল্পনা নিয়েই দেশের ভেতরে প্রবেশ করেছে বলে মনে হচ্ছে। রেজোয়ান হারুন তার নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে দেশে ঢুকে পড়ার পেছনে জঙ্গী সংগ্রহ, জঙ্গী অর্থায়ন ও জঙ্গী তৎপরতার কোন বার্তা নিয়ে প্রবেশ করার নেপথ্যে অদৃশ্য শক্তির মদদ থাকতে পারে। মোস্ট ওয়ান্টেড এই ধরনের বড় মাপের ব্ল্যাকলিস্টেড জঙ্গী নেতার বিমানবন্দরের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যদের সকলের চোখে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ার ঘটনায় বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। আতঙ্ক ও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, রেজোয়ান হারুন একা এসেছে না তার সঙ্গে আরও অনেকেই প্রবেশ করেছে তাদের খুঁজে বের করতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ব্যাপক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গোয়েন্দা সংস্থা অভিযান পরিচালনা করছেন।
×