ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাঈদীর সাজার রায় পুনর্বিবেচনা ॥ আজ ফের শুনানি

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৫ মে ২০১৭

সাঈদীর সাজার রায় পুনর্বিবেচনা ॥  আজ ফের  শুনানি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া সাজার রায় পুনর্বিবেচনার জন্য জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও রাষ্ট্রপক্ষের করা দুটি আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়েছে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে। আজ সোমবার আবারও শুরু হবে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট বেঞ্চ এই আদেশ প্রদান করেছেন। বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হচ্ছেনÑ বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়া, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হুসেইন হায়দার। শুনানির একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, শোনেন, শোনেন, বলা উচিত না, তাও বলতে হয়। মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই হচ্ছে। আমাদের কাছে তথ্য আছে যারা এই কমিটিতে আছে তাদের অনেকেই ডিরেক্টলি পাকিস্তান আমলের লোক। তাদের কেউ কেউ এখন কমিটির চেয়ারম্যান। রবিবার দুপুর ১২টার দিকে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে এ শুনানি শুরু হয়। প্রথমে রাষ্ট্রপক্ষে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানি করতে চাইলে আদালত তাকে পরে শুনানি করতে বলেন। ফলে সাঈদীর পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথমে শুনানি শুরু করেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীর প্রথম দিন প্রায় এক ঘণ্টা শুনানির পর এ মামলার কার্যক্রম সোমবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। এরপর প্রধান বিচারপতি সাঈদীর আইনজীবী এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনকে বলেন, আগে যদি খালাসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে যায়, রিভিউ যদি গ্রহণ করি। খালাস দিলে কি ফাঁসি দিতে পারবো? বিষয় আসে না। মি. হোসেন, আসল রিভিউ তো আপনারটি। এরপর খন্দকার মাহবুব হোসেন শুনানি শুরু করেন। তখন প্রধান বিচারপতি তাকে প্রশ্ন করেন, কয়টা অভিযোগে যাবজ্জীবন? কয়টা অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করতে চান? জবাবে খন্দকার মাহবুব বলেন, তিনটি। ১০, ১৬, ১৯ নম্বর অভিযোগ। এরপর খন্দকার মাহবুব হোসেন তার লিখিত যুক্তিতর্কের কপি আদালতে জমা দেন। এরপর তিনি প্রথমে ১০ নম্বর অভিযোগের ওপর শুনানি শুরু করেন। জমা দিয়ে চার্জ-১০ এ যুক্তিতর্ক শুরু করার কিছু সময় পর প্রধান বিচারপতি বলেন, এখানে তো বললেন না যে সাক্ষীরা জীবিত আছে। এটা ৪১, ৪২, ৪৫ বছর রাজনৈতিক মেরুকরণ, আত্মীয়তা, বিয়ে-টিয়ে করে অনেক পরিবর্তন চলে আসছে। বুড়িগঙ্গার পানি গড়িয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে বাষ্প হয়ে চেরাপুঞ্জি, হিমালয়ে গিয়ে সেখানে বরফ গলে প্রশান্ত মহাসাগরে গিয়ে পড়েছে। খন্দকার মাহবুব হোমেন তার শুনানি অব্যাহত রাখেন। একপর্যায়ে একাত্তরে সাঈদীর যশোরে থাকার প্রসঙ্গ আসে। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে তখন ওয়াজ করার জন্য আপনি পরিবার-পরিজন নিয়ে যশোরে গিয়েছিলেন সে যুক্তি কোনভাবেই বিশ্বাসযোগ্য না। সাধারণত ওয়াজ হয় ধান কাটার পর শীতকালে। আপনি বলেছেন, মে মাসে। মে মাসে তো বর্ষাকাল। এখনও কি এই সময়ে ওয়াজ হয়? এখন তো অনেক উন্নতি হয়েছে, তারপরও কি মার্চ-এপ্রিল কিংবা মে মাসে ওয়াজ হয়? জবাবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, হয়, একটা বৃহৎ পরিসরে, আরেকটি ছোট পরিসরে হয়। তাছাড়া সাঈদী লেখাপড়া করার জন্যই পরিবার নিয়ে সেখানে ঘর ভাড়া করে থাকতেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, না, হয় না। আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। আপনি তো পেশাদার বক্তা। আপনাকে প্রমাণ করতে হবে আপনি ছিলেন না। একজন শুধু ওয়াজ করার জন্য বাসা ভাড়া করে থাকবে? আপনি বিবাহিত, বউ-বাচ্চা আছে। এটা অগ্রহণযোগ্য। শোনেন, শোনেন, বলা উচিত না, তাও বলতে হয়। মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই হচ্ছে। আমাদের কাছে তথ্য আছে, যারা এই কমিটিতে আছে তাদের অনেকেই সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষের লোক। তাদের কেউ কেউ এখন কমিটির চেয়ারম্যান। খন্দকার মাহবুব বলেন, আমি তো সাঈদী হলাম সেদিন, মামলা-টামলা হওয়ার পরে। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি তো তখন দেলাওয়ার হোসেন শিকদার ছিলেন। বলা হচ্ছে, আমাদের সন্দেহ লাগছে, মে মাসের পর আপনি (সাঈদী) এলাকাতে যান, এটা আমাদের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, অনেক মামলাতেই ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। খেয়াল করে দেখবেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে আমরা ফাঁসিও দিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু তা না করে এ্যাভিডেন্স ও অন্যান্য বিষয়ের ওপর বিবেচনা করে এ মামলায় সাজা কমানো হয়েছে। এরপর প্রধান বিচারপতি এ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে জানতে চান রাষ্ট্রপক্ষ শুনানি করবে কি না। জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল সম্মতি জানিয়ে বলেন, আমি তো ফাঁসি চাই। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে রিভিউ ব্যবস্থা ছিল না। আমরা আপীল বিভাগ সেটা দিয়েছি ন্যায়বিচারের স্বার্থে। তাই আমরা চাই না বিচার বিভাগ প্রহসনের হোক। তিনি বলেন, রিভিউ হলেই যে তা খারিজ হয়ে যাবে এমনটা নয়। এ মামলায় আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণসহ সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে আমৃত্যু কারাদ- দিয়েছি। এ রায় দেয়ার আগে আমরা বিচারপতিরা পর্যালোচনা বৈঠক করেছি। এরপর সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আপনারা দেখেছেন এ মামলায় দ্বিধাবিভক্ত রায় হয়েছে। আর আপীল বিভাগ শুনানির পর কাউকে সাজা দেয়, রিভিউতে সেটা পরিবর্তন খুবই দুষ্প্রাপ্য। আপনি বরং এ সাজা কিভাবে বহাল থাকে তারপক্ষে যুক্তি দেখান। এ জন্য আইনের বিভিন্ন ধারা দেখে আসবেন। এরপর এ্যাটর্নি জেনারেল প্রস্তুতির জন্য সময চান। পরে আদালত সোমবার পর্যন্ত তা মুলতবি করেন। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদ-াদেশ দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে আপীল করেন সাঈদী। এ আপীলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপীল বিভাগে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সাঈদীর মৃত্যুদ-ের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদ- দেন। রায়ে তিন বিচারপতি সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদ-, একজন খালাস ও একজন মৃত্যুদ- দেন। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর সুপ্রীমকোর্টের কোর্টের নিজস্ব ওয়েবসাইটে ৬১৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। এরপর গতবছর ১২ জানুয়ারি সাঈদীর মৃত্যুদ- চেয়ে ৩০ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদন দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর একই বছরের ১৭ জানুয়ারি খালাস চেয়ে ৯০ পৃষ্ঠার রিভিউ করেন সাঈদী। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগের এক মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন সাঈদীকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। সেই থেকে তিনি কারাবন্দী। উভয়পক্ষের আইনজীবীর ব্রিফিং এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজ কার্যালয়ে ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ইব্রাহীম কুট্টি ও বিশাবালী হত্যাকা-ের সঙ্গে সাঈদী সরাসরি জড়িত। তবে সুপ্রীমকোর্ট কোর্ট রায়ে বলেছেন, বিশাবালী হত্যাকা-ে সে (সাঈদী) আদেশ দিলেও সে মুখ্য আসামি না। সে সহায়তাকারী। এটার বিরুদ্ধে আমরা রিভিউ করেছি। আমাদের দাবি, সর্বোচ্চ আদালত বলেছে সে অপরাধী। তাই তাকে ফাঁসি দেয়াটাই ছিল বাঞ্ছনীয়। সে ফাঁসির জন্যই আমাদের রিভিউ। হুকুমদাতা হিসেবেই হোক বা সেখানে উপস্থিত থেকে প্ররোচনাকারী হিসেবেই হোক, হত্যাকা-ে সে জড়িত ছিল। তাই তার সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধ মামলায় যে কজনের ফাঁসি হয়েছে তাদের মধ্যে শিরোমণি হলো দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী। খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, তিনটা অভিযোগের ওপর শুনানি করেছি। আমি বলেছি, এ অভিযোগগুলোতে ট্রাইব্যুনাল কোন সাজা দেয়নি। কিন্তু আপীল বিভাগ তিনটিতেই আমৃত্যু কারাদ- সাজা দিয়েছে। আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করেছি, যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপর ভিত্তি করে এ সাজা দেয়া হয়েছে সেটি সঠিক হয়নি। এর পুনর্বিবেচনা দরকার। বিশেষ করে বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা যে রায় দিয়েছেন সেটিও আমরা তুলে ধরেছি।
×