ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

এদেশে নারী ও শিশুদের আত্মঘাতী কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৭ মে ২০১৭

এদেশে নারী ও শিশুদের আত্মঘাতী কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এগারো বছরের কোন শিশু যখন নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত, তখন দুরন্ত ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে তাসনিমা আক্তার। বাবার কথা মতো ঘোড়ার দেখভাল করতে গিয়ে নিজেই হয়ে ওঠে দুর্দান্ত এক ঘোড়সওয়ার। ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় সবাইকে পেছনে ফেলে জয় করে নেয় প্রথম স্থানটি। নওগাঁর প্রত্যন্ত অঞ্চলের এ কিশোরীর অশ্বারোহী হয়ে ওঠার বাসনাকে শুরুতে সুনজরে দেখেনি গ্রামবাসী। তবে সব প্রতিবন্ধকতা পেরুনো এ কিশোরী সফল নারীদের একজন হয়ে আলোকিত করে রাখলো মঞ্চ। অপরদিকে অর্থ আর পেশীশক্তির তীব্রতাকে উপেক্ষা করে দেশের রাজনীতিতে নতুন দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী। এ দু’জনের মতো নানা অঙ্গনের আরও আট সফল নারীকে সম্মাননা জানানো হলো এক মঞ্চে। তারা প্রত্যেকেই পুরুষশাসিত সমাজের চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে পরিণত হয়েছেন নারীর সাফল্যগাথার এক একটি উদাহরণ হিসেবে। অদম্য এমন দশ নারীকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে প্রদান করা হলোÑ অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা। পাক্ষিক অনন্যা প্রবর্তিত ২৪তম বারের মতো এ সম্মাননা জানানো হলো আলোচিত দশ নারীকে। ২০১৬ সালের অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা পেয়েছেন অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান (শিক্ষা), ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভী (রাজনীতি), ড. জেবা ইসলাম সিরাজ (বিজ্ঞান-গবেষণা), সাবেরী আলম মোতাহের (অভিনয়), নিশা রানী মালাকার (শোলাশিল্পী), আশরাফুন নাহার মিষ্টি (প্রতিবন্ধী অধিকারকর্মী), বাসন্তী মুরমু (আদিবাসী অধিকার কর্মী), সুরমা জাহিদ (মুক্তিযুদ্ধ-গবেষণা), সাবিনা খাতুন (খেলাধুলা) ও তাসমিনা আক্তার (অদম্য কিশোরী)। শনিবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দশ নারীর হাতে সম্মাননা তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন রাষ্ট্রচিন্তক অধ্যাপক ড. রওনক জাহান এবং কবি ও সংসদ সদস্য কাজী রোজি। স্বাগত বক্তব্য রাখেনÑ পাক্ষিক অনন্যার প্রকাশক ও সম্পাদক তাসমিমা হোসেন। কীর্তিমান এ নারীদের অনন্যা সম্মাননার স্মারক, সনদপত্র প্রদানের পাশাপাশি উত্তরীয় পরিয়ে দেন অতিথিরা। অসুস্থতার কারণে ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভী সম্মাননা গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এ অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করেন সাধনার শিল্পীরা। জঙ্গীবাদের উত্থানে নারীর ব্যবহার করা হচ্ছে উল্লেখ করে মতিয়া চৌধুরী বলেন, সারা পৃথিবীকে তছনছ করে ফেলছে জঙ্গীবাদ। বাংলাদেশেও কোন কোন ক্ষেত্রে নারী ও শিশুদের এতে আত্মঘাতী কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি জঙ্গীরাই ঠিক করে দিচ্ছে, তাদের কেউ নিহত হলে সেই স্ত্রীর বিয়ে হবে কার সঙ্গে। নারীরা কী জঙ্গীবাদের কেবল হাতবদলের হাতিয়ার হবে? এখানে মানবতা, ধর্ম বলে কিছু নেই। এই উন্মাদচিন্তার বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে এক হতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে। অন্তত একটি জায়গায় আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি। রওনক জাহান বলেন, রাজনীতিতে প্রয়োজন হয় অনেক টাকা-পয়সা ও পেশীশক্তির। সেটা নারীদের নেই বলে তারা মূলধারার রাজনীতিতে সেভাবে আসতে পারছেন না। এ প্রতিকূলতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কোন কোন নারী অনন্য অবদান রাখছেন, সেটা গর্বের বিষয়। অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা প্রাপ্ত নারায়ণগঞ্জের মেয়র ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভী তার জ্বলন্ত উদাহরণ। তিনি আরও বলেন, এবার যারা অনন্যা সম্মাননা পেয়েছেন, তাদের সবার একটা বিষয়ে মিল আছে, তাহলো বড় হওয়ার স্বপ্ন। নারীদের সব চ্যালেঞ্জ, প্রতিকূলকতা অতিক্রম করে উঠে আসতে হবে। চ্যালেঞ্জটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। তাসমিমা হোসেন বলেন, নব্বইয়ের দশকে তসলিমা নাসরিনের মাথার দাম যখন ঘোষিত হলো, তখন থেকে ওম্যান অব দ্য ইয়ার সম্মাননা প্রদানের কথা আমরা ভাবি, যা পরে অনন্যা শীর্ষ দশ হয়। আগে সারা বছরের উল্লেখযোগ্য কর্মকা-ের জন্য ১০ জন নারী খুঁজে পাওয়া যেত না। এখন অনেক বেশি সংখ্যক যোগ্য ও কৃতী নারীকে আমরা পাই। আমরা বিশ্বাস করি, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে এ সম্মাননা তাদের আরও অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করবে। প্রাপ্তির অনুভূতি ব্যক্ত করে সবাই সমাজের জন্য কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান বলেন, ছোটবেলায় পরিবার থেকেই বুঝেছিলাম, পড়ালেখা করতে হবে। সেখান থেকেই নিজের গন্তব্যটা ঠিক করে নিলাম। বিজ্ঞানী অধ্যাপক জেবা ইসলাম সিরাজ বলেন, আমরা বিজ্ঞানীরা একটু বেরসিক বটে। কিন্তু জীবনবৈচিত্র্যের মূলে যে ডিএনএ, তা নিয়ে আমার গবেষণা। এ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন অঙ্গনের বৈচিত্র্যময় সফল নারীদের উপস্থিতি চোখে পড়ছে। আজকের এ সম্মাননা জিন গবেষণায় আমাকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করবে। অভিনেত্রী সাবেরী আলম বলেন, কর্মক্ষেত্র থেকে, বিশ্বাসের জায়গা থেকে আমি নতুন প্রজন্মের জন্য যেন কিছু করে যেতে পারি, সেই প্রার্থনা করবেন। তাহলে আমাদের উত্তরসূরিদের পথ চলাটা সুগম হবে। মাগুরার শালিখা উপজেলার শতপাড়া গ্রামের শোলাশিল্পী নিশা রানী মালাকার বলেন, আমি যে এলাকায় থাকি, সেখানে বিদ্যুত নেই। লম্প জ্বালিয়ে কাজ করতে হয়। বিদ্যুত পেলে আমার এ কাজটা আরও ভালো হতো। আশরাফুন নাহার মিষ্টি বলেন, এ সমাজে প্রতিবন্ধীদের প্রতি সুস্থ মানুষের বিদ্রুপের বোঝাটা কমাতে হবে। অসহযোগিতা কিংবা বিদ্রুপ না করে প্রতিবন্ধী মানুষটির চলার পথ সুগম করতে উৎসাহিত করুন। বাসন্তী মুরমু বলেন, এমনিতেই আদিবাসীরা তাদের ন্যায্য অধিকার সবসময় পায় না। তার ওপর সাঁওতালি নারীরা আরও বেশি বঞ্চিত। তাদের ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা গেলে, তাদের বঞ্চিত দশার কিছুটা হলেও অবসান হবে। সুরমা জাহিদ বলেন, আমি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে, একাত্তর সালে সাত বছর থেকে ৭১ বছর পর্যন্ত নির্যাতিত নারীর দেখা পেয়েছি। তাদের করুণ দশার পাশাপাশি দেখেছি যুদ্ধশিশুদের শোচনীয় অবস্থা। এখনও নানা ক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে, সেই বিভীষিকাময় সময়ের শিকার নারীদের বঞ্চনার দৃশ্য দেখতে পাই। জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক সাবিনা খাতুন বলেন, যখন আমি খেলাধুলা করি, তখন চারপাশ থেকে বিদ্রুপ আসত। কিন্তু এ ধরনের কোন কথায় কান দেইনি। সে কারণেই আমি নিজের মতো করে সফল হতে পেরেছি। নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা চকসুবল গ্রামের বিস্ময়কন্যা ঘোড়সওয়ার তাসমিনা আক্তার বলেন, আমি যখন ঘোড়া চালাতাম তখন গ্রামের লোক বাধা দিতো। কিন্তু আমি কাউকে কেয়ার করতাম না। তাদের বলেছি, আমি আমার বাবারটা খাই, আমি আমার খুশি মতো কাজ করব। নিজের এ ইচ্ছা নিয়ে যতদূর যেতে পারি ততদূর এগিয়ে যাব। নারীর চোখে বিশ্ব দেখার প্রত্যয় নিয়ে ১৯৮৮ সালে যাত্রা শুরু করে পাক্ষিক অনন্যা। আর ১৯৯৩ সাল থেকে অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা দেয়া হচ্ছে। প্রতিবছর দেশের দশজন নারীকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার জন্য এ সম্মাননা দেয়া হয়।
×