ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে, আবেগঘন আয়োজন

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৩ মার্চ ২০১৭

টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে, আবেগঘন আয়োজন

মোরসালিন মিজান ॥ শিক্ষক। গৃহশিক্ষক। ঘন ঘন পরীক্ষা। ভাল ফল। স্কুলের বাচ্চাদের প্রতিদিনের জীবন বলতে, এই। এভাবেই বেড়ে উঠছে আগামীর নাগরিক। চারপাশের জগৎ সম্পর্কে তাদের অনেকেই কিচ্ছুটি জানে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তো আরও ব্যাপক। বিস্তৃত। কে তার খোঁজ রাখে? কেউ কি রাখে? হ্যাঁ, হতাশার মাঝেও আশার আলো দেখাচ্ছে কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংস্পর্শে এসে সুন্দর বদলে যাচ্ছে কঁচিকাঁচা মন। উদাহরণ হতে পারে মানিকনগর মডেল হাইস্কুলের শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ছেলেমেয়েরা বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস পাঠ করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আছে বিপুল আবেগ। সেই আবেগ আর ইতিহাস চেতনা থেকেই সম্প্রতি তারা তাদের প্রত্যেকের একদিনের টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে তা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণে গঠিত তহবিলে দান করেছে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখার মহতী উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। শহর ঢাকার অতি সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অসাধারণ এই কাজ নামী প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপ্রেরণার হতে পারে। মানিকনগর মডেল হাইস্কুলটি সায়েদাবাদ সংলগ্ন বিশ্বরোডের পাশে অবস্থিত। স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৫ শ’। শিক্ষকরা খুবই সচেতন। ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসের লেখাপড়া বুুঝিয়ে দেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান দান করে থাকেন। বিশেষ গুরুত্ব পায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক পাঠ ও আলোচনা। একই কারণে গত কয়েক বছর আগে স্কুলটি যুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বিভিন্ন কর্মকা-ের সঙ্গে। আগামী ২৬ মার্চ তারা অংশ নেবে বিশেষ পদযাত্রায়। প্রতিবছর ‘শোক থেকে শক্তি : অদম্য পদযাত্রা’ শিরোনামে দীর্ঘ ভ্রমণের আয়োজন করে পর্বতারোহীদের সংগঠন অভিযাত্রী। ২০১৬ সাল থেকে অদম্য পদযাত্রা নিবেদিত হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ তহবিল গঠনের উদ্দেশ্যে। যে কেউ অভিযাত্রীদের সঙ্গে ন্যূনতম এক মাইল হেঁটে এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ তহবিলে ন্যূনতম পাঁচশত টাকা অনুদান প্রদান করে এই পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। সম্প্রতি আয়োজনটির সঙ্গে যুক্ত হওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ তহবিলে অর্থ সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয় স্টুডেন্ট ক্যাবিনেটের সদস্যরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, রুমানা সুমি সুবর্ণা মিরাজ অভিজিৎ প্রিয়া সামিয়া সুমাইয়ারা প্রতিটি ক্লাসে যায়। সহপাঠীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করে। জানতে চায়, তারা জাদুঘর নির্মাণের কাজে সহায়তা করতে চায় কি না? আশার কথা, সবাই একবাক্যে প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। সকল শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা তাদের টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে। গত ১৮ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ তহবিলে দান করা হয় সমুদয় অর্থ। দান এবং গ্রহণের মুহূর্তটিও আশ্চর্য আবেগঘন ছিল। এদিন স্কুলে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধা কমল সিদ্দিকী বীর উত্তম, মুক্তিযোদ্ধা ও জাদুঘরের সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন তারিক আলী প্রমুখ। এসেছিলেন এভারেস্ট শৃঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনকারী দেশের প্রথম নারী পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার ও পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক। প্রথমেই অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে স্কুলের শহীদ মিনারে যান স্কুলের শিক্ষার্থীরা। সেখানে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। পরে স্কুলের সকল শিক্ষার্থী শিক্ষক ও অতিথিরা মিলে জাতীয় সঙ্গীত গান। আবেগভরা কণ্ঠে গাওয়া জাতীয়সঙ্গীত যেন বাজে বুকের ভেতরেও। একই রকম ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় শপথ গ্রহণ। পরে একাধিক মুক্তিযোদ্ধা ও জাদুঘরের সদস্য সচিব শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেন শিক্ষার্থীরা। সবশেষে টিফিনের অর্থ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ তহবিলে এক লাখ টাকা অনুদান প্রদানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আজীবন সদস্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সে অনুযায়ী, অনুষ্ঠানে মানিকনগর মডেল হাইস্কুলকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আজীবন সদস্য ঘোষণা করেন জিয়াউদ্দিন তারিক আলী। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ সম্পর্কে কথা হয় ক্যাবিনেট সদস্য দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রুমানার সঙ্গে। কথা বলার সময় বেশ উচ্ছ্বসিত মনে হয় তাকে। জনকণ্ঠকে সে বলে, স্কুলের পক্ষ থেকে একাধিকবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শন করেছি আমি। তখন অনেক অজানা ইতিহাস জেনেছি। জেনে কখনও হেসেছি। কখনও কেঁদেছি। এভাবে জাদুঘরটিকে নিজের ভাবতে শিখে গিয়েছিলাম। জাদুঘরের তহবিল সংগ্রহ সম্পর্কে ছাত্রীটির সরল ভাষ্যÑ আমরা তো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। কিন্তু গর্ব করে বলতে পারবো, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে কিছুটা হলেও অবদান আমাদের আছে। স্কুল পড়ুয়া একটি মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে সত্যি মন ভরে যায়। আশাবাদী হয়ে ওঠে। স্কুলের শিক্ষক সুপ্রজিত দাসের সঙ্গে কথা বলেও ভীষণ ভাল বোধ হলো। তিনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। পেছনের ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, চার বছর আগে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গিয়ে আমি বিস্মিত হয়ে যাই। কত ইতিহাস এখানে সযতেœ সংরক্ষণ করা হচ্ছে! নিজে ঘুরে দেখি। পরে স্কুলের শিক্ষার্র্থীদের জাদুঘর দেখাতে নিয়ে আসি। এখনও জাদুঘরের আউটরিচ প্রোগ্রামের আওতায় প্রতিবছর স্কুলের শিক্ষার্থীরা জাদুঘর পরিদর্শন করে। তারা জাদুঘর পরিদর্শন শেষে একটি করে প্রদিবেদন জমা দেয়। সেসব প্রতিবেদনে তাদের জাদুঘর দেখার অনুভূতি নানা ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত হয়। এভাবে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানানোর চেষ্টা করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। ফলে মনের আনন্দেই শিক্ষার্থীরা নিজেদের টিফিনের টাকা জাদুঘরে দান করে। সব দেখে খুশি জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সসদ্য সচিব জিয়াউদ্দিন তারিক আলীও। তিনি বলেন, স্কুলের ছেলেমেয়েদের বয়স তো খুব অল্প। এই বয়সে মানিকনগর মডেল হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা মুক্তিযুদ্ধকে জানতে শিখেছে। অনুধাবন করতে শিখেছে এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম তৈরিতে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও একই রকম আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
×