ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

গণহত্যা স্মরণ দিবস পালন কেন জরুরী

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ১৫ মার্চ ২০১৭

গণহত্যা স্মরণ দিবস পালন কেন জরুরী

॥ পঞ্চম কিস্তি ॥ জুনায়েদের বইটি নিয়ে যেহেতু পার্লামেন্টেও কথা উঠেছে সে বইটি নিয়ে খানিকটা আলোচনা করব। যে কোন দেশে যে কোন নাগরিক বাংলাদেশের বিষয়ে লিখতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কারও কিছু বলার নেই। তার প্রতিবাদ জানানো যায়। কিন্তু সরকারীভাবে যদি অপপ্রচার চালানো হয় তাহলে সরকারীভাবেই তার কঠোর প্রতিবাদ জানানো উচিত। ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সালে জুনায়েদ আহমদ একদল গবেষক নিয়ে এ বিষয়ে কাজ শুরু করেন। ন্যাশনাল ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্টস নামে তার একটি কোম্পানি আছে। বইটি লেখা শেষ হলে ২০১৬ সালে এই কোম্পানির সাবসিডিয়ারি এজেএ বইটি প্রকাশ করে। ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে করাচী কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এই সংস্থার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। আর পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী এর পৃষ্ঠপোষক। তাদের এই অনুষ্ঠান দেখা যাবেÑ যঃঃঢ়:/িি.িধলধঢ়ঁনষরংযবৎং.পড়স-এ। এরপর পৃথিবীর একমাত্র আইনী সন্ত্রাসী সংস্থা আইএসআই ইসলামাবাদে সব বিদেশী দূতাবাস ও সংস্থার কাছে বইটি প্রেরণ করে। বাংলাদেশ দূতাবাসেও তা প্রেরণ করা হয়। সুতরাং ধরে নেয়া যায় পাকিস্তান সরকার পরিকল্পিতভাবে এ বই লিখেয়েছে এবং বিজয় দিবসকে ম্লান করার জন্য ওই দিনই বইটির প্রকাশনা উৎসব করেছে। জুনায়েদ একজন ম্যানেজমেন্ট পরামর্শক, যার সঙ্গে ইতিহাসের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা লক্ষ্য করেছি, যারা কূটনৈতিক সার্ভিসে আছেন তাদের একটি বড় অংশ পাকিস্তানের ব্যাপারে নমনীয়। এটি নাকি কূটনীতি। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা নাকি দরকারি। সম্পর্ক বাতিল করা দূরে থাকুক ডাউনগ্রেডও করা যাবে না। ওই যে বলেছিলাম, বাঙালী পাকিস্তানীর সংখ্যা বেড়েছে এটি তার উদাহরণ। দেশের শীর্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু হলে পাকিস্তানের সংসদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনেক বিষোদ্গার করে কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা সংসদের প্রতিক্রিয়া ছিল কড়ি ও কোমল। সব সময় ভয় এই বুঝি পাকিস্তান চটে গেল। এটা নাকি কূটনীতি। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা আইএসআই বাংলাদেশের বিলুপ্তি চেয়েছে এবং চাইবে। বাংলাদেশ মুজিব ও আওয়ামী লীগের সৃষ্টি এ তত্ত্ব তারা বিশ্বাস করে। এ কারণেই জামায়াত-বিএনপির উত্থানে তারা সব রকমের সহায়তা করেছে। এ কারণে ১৯৭১ সালে খালেদা জিয়ার সঙ্গেও তারা সুসম্পর্ক তৈরি করেছিল, যে কারণে প্রধানমন্ত্রী হয়ে খালেদা পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধানের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি বিরল ঘটনা এবং এ কারণেই বিএনপি-জামায়াত কখনও পাকিস্তানের সমালোচনা করেনি, পাকিস্তানের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালের বিরোধিতা করেছে। জুনায়েদের বইটিতেই প্রথম মিথ্যাচার করা হয়েছে তা নয়। এ মিথ্যাচার শুরু হয় জুলফিকার আলী ভুট্টোর ‘এ গ্রেট ট্র্যাজেডি’ প্রকাশের মাধ্যমে। এরপর রচিত হয় কুতুবউদ্দিন আজিজের ‘ব্লাড এ্যান্ড টিয়ার্স’। তারপর হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট। ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় শর্মিলা বোসের ‘ডেড রেকোনিং : মেমোরিস অব দি নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান।’ ২০১৫ সালে মিয়া আফ্রাসিয়াবের ১৯৭১ : ফ্যাক্টস এ্যান্ড ফিকশন।’ সবগুলো বইয়েরই মূল চেষ্টা ছিল এ বক্তব্য দেয়া যে, ১৯৭১ সালে যা ঘটেছে বলে রটেছে তা অতিরঞ্জিত। গণহত্যা তেমন হয়নি। ধর্ষণ সামান্য, শর্মিলার ভাষায় মাত্র তিন হাজার। এ বইগুলোর দুর্বলতা হলো, সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ তারা ভালভাবে করতে পারেনি। বইগুলো যে লেখানো হয়েছে তাও বোঝা যায়। যেমন কুতুবউদ্দিনের বই। বর্ণনাগুলো অতিরঞ্জিত। শুনেছি এবং এ কথা সর্বজনবিদিত যে, পাকিস্তানী কর্নেলরা শর্মিলাকে সব বিষয়ে তুষ্ট করেছে। তিনি তাদের পছন্দসই বালিকা। আর কর্নেলরাও বালিকার খুব পছন্দের। হামুদুর রহমান সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে একটি বাতাবরণ সৃষ্টি করেছেন যাতে এই গণহত্যার অভিযোগটি কম হয়। কিন্তু হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট কখনও সরকারীভাবে প্রকাশিত হয়নি। কিছু অংশমাত্র প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান লেখক জুনায়েদের বইয়ের দুর্বলতা এই যে, এটি একটি কমিশন ওয়ার্ক- তিনি স্বীকার করেছেন। তিনি পাকি সেনাদের উপদেষ্টা। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় কনসালটেন্সি ফার্ম, যারা ১৯২৫ সাল থেকে ১৩৫০টির বেশি কনসালটেন্সি করেছে এবং এর উৎস যে আইএসআই সেটিও বোঝা যায়। এ কথা বলাও সত্যের অপলাপ হবে না যে, বইটি আইএসআই কমিশনকৃত লোকজন লিখে দিয়েছে যা তার নামে ছাপা হয়েছে এবং তিনি তার বিনিময়ে মোটাসোটা ইনাম পেয়েছেন। বইয়ের প্রধান দুর্বলতা এর টপ টু বটম মিথ্যাচার। কোথাও কোথাও দু’এক লাইন সত্য কথা আছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যেসব তথ্য সত্য হিসেবে বিবেচিত তাও সে বইয়ে মিথ্যা হিসেবে দেখানো হয়েছে। জুনায়েদের ভাষায়, বাংলাদেশ ও ভারত ১৯৭১ সম্পর্কে যে ন্যারেটিভ প্রদান করে আসছে তা নস্যাতের জন্যই বইটি লেখা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ের নাম- ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ এমিড মিথস এ্যান্ড ফেবলস।’ অর্থাৎ উপকথা ও মিথ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের সৃষ্টি। বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে ১৪টি মিথ কাজ করছে। বলা হচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তান শোষণ করেছে পূর্ব পাকিস্তানকে। আসলে তা মিথ্যা। ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়নি। দুই লাখ নারী ধর্ষিতও হয়নি। হিন্দুদের হত্যার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়নি। মুক্তিবাহিনীই হত্যা করেছে বিহারীদের। দ্বিতীয় অধ্যায় : ক্রিয়েশন অব পাকিস্তান বা পাকিস্তানের সৃষ্টি। হিন্দু জাতীয়তাবাদী, কংগ্রেস জাতীয়তাবাদী মুসলিম রাজনীতি ও ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ চায়নি। তাদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল এবং তারই ফল ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বিভাগ। তৃতীয় অধ্যায় : ‘ডিসমেম্বারমেন্ট স্টার্টস’ বা ভাগ হওয়ার প্রক্রিয়া। এ অধ্যায়ের যে বর্ণনা তা তার ‘মিথের’ সঙ্গে খাপ খায় না। এখানে প্রমাণ করতে পারেনি যে, পূর্বাঞ্চলে অসন্তোষ ছিল না। চতুর্থ অধ্যায় : ‘ইন্ডিয়াস ম্যাকিনেশন বা ভারতের ষড়যন্ত্র।’ ভারতই বাংলাদেশকে ভাগ করেছে, সেই পুরনো তত্ত্ব আবার নতুন করে বলা হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায় : ‘দি নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান ইনসার্জেন্সি বা ১৯৭১ সালের বিদ্রোহ। এর মূল প্রতিপাদ্য হলো চলবে...
×