ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

শত বছর ঝুলছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১১ মার্চ ২০১৭

শত বছর ঝুলছে

বিকাশ দত্ত ॥ মাদারীপুর কোর্টে ১৯১২ সালে একটি বাটোয়ারা মামলা দায়ের করেন শচীন মধু। তার জীবদ্দশায় এই মামলার রায় দেখে যেতে পারেননি। এমনকি তার ছেলেও রায় দেখে যেতে পারেননি। তিন পুরুষ গেছে। মামলার ৫ জন আইনজীবীও মারা গেছেন। মামলাটি মাদারীপুর কোর্ট থেকে বর্তমানে হাইকোর্টে এসেছে। দীর্ঘ ১০৫ বছরেও মামলাটির নিষ্পত্তি হয়নি। এই মামলার আইনজীবী জানিয়েছেন, এটিই তার জীবনে সবচেয়ে দীর্ঘায়িত মামলা। একজন দাবিদার মারা গেলে আরেকজন দাবি করে মামলা করেন। যার কারণে মামলাটি শেষ হচ্ছে না। অন্যদিকে ১৯৯৪ সালে পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে দুই মহল্লার মধ্যে মারামারিতে মাহতাব নামে এক ব্যক্তি খুন হন। এ খুনের ঘটনায় মোঃ জাবেদ বাদী হয়ে সূত্রাপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২০০০ সালের ৭ নবেম্বর জনৈক শিপনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অভিযোগপত্র দাখিলের ৫ বছর পর ২০০১ সালে মামলাটি বিচারের জন্য প্রস্তুত হয়। শিপন গ্রেফতারের পর থেকেই কাশিমপুর কারাগারে আটক ছিলেন। বর্তমানে ঢাকার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন। দীর্ঘ ২২ বছর আগের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় ১৭ বছর ধরে বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে কারাগারে থাকা মোঃ শিপনকে সম্প্রতি মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জামিন দিয়েছে হাইকোর্ট। ৪৬২ জন বন্দীর তালিকা থেকে ৫৮ জনের বিষয় উচ্চ আদালতের নজরে আনা হয়। আদালত এই ৫৮ জনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করে। এর মধ্যে শুধু শিপনই নন জামিন পেয়েছেন সেন্টু, চাঁন মিয়া, মকবুল হোসেন, বিল্লাল হোসেন, রাসেল, মোঃ পারভেজ, মাসুদ, লিটন, বাবুসহ ১৬ জন। অন্যদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি ও কয়েকজনকে চিকিৎসা প্রদানের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এই দুটি মামলাই নয়, দেওয়ানি ও ফৌজদারির প্রায় ৩১ লাখ মামলা বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে যুগ যুগ ধরে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। কেন নিষ্পত্তি হচ্ছে না তা অনুসন্ধানে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। দেশের সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার ও আইনজীবীগণ তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। মামলা নিষ্পত্তিতে আইন কমিশন অনেক আগেই আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক স্থায়ী কমিটিতে ২৭ দফা সুপারিশ দিয়েছেন। এ ছাড়া দুর্বল এফআইআর, দুর্বল চার্জশীট, সাক্ষী উপস্থিত না করতে পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতা, বিচারকের অপ্রতুলতা, কিছু আইনজীবীর সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ না করা, হাইকোর্ট থেকে স্টে অর্ডার, রুল দেয়া, সাক্ষী হাজিরে পুলিশ ও এপিপিদের উৎসাহ না থাকা পদ্ধতিগত এই ৭ বাধার কারণে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তিতে যুগের পর যুগ পার হয়ে যাচ্ছে। এই জট দূর করতে বিচারক নিয়োগের পাশাপাশি সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সৎ ও কর্মঠ অবসরপ্রাপ্ত জজদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও পদায়ন করলে পুরাতন বিচারাধীন দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার শুনানি, আপীল ও রিভিশন মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে কিছু আইনজীবীর কর্মকা-কেও দায়ী করা হয়েছে। তাদের কারণে অনেক মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগছে। কিন্তু আইনজীবীগণ এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, পদ্ধতিগত কারণে মামলার দীর্ঘ জট হচ্ছে। সনাতনী পদ্ধতিগত কারণে মামলাজট বেড়ে যাচ্ছে। কারণে অনেক মামলার সংশ্লিষ্ট পক্ষদের মতে নোটিস জারি হয় বছরের পর বছর বিলম্বে। অপরদিকে নোটিস জারি যথাযথ না হওয়ার কারণে পুনরায় নোটিস জারি করতে হয়। সংশ্লিষ্ট সেকশনে নোটিস জারি হয়ে ফেরত আসায় পরে ভুল নথিতে এ বিষয়গুলো উল্লেখ করে নোট প্রদান করা হয় না। জারির তথ্য সেকশনেই পড়ে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে হারিয়েও যায়। এ কারণে মামলা শুনানির জন্য প্রস্তত হতেই দীর্ঘবিলম্ব হয়। পুনরায় মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আদালতের শুনানির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত অনিবার্য হলেও তা করা হয় না। আদালতের এখতিয়ার পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় সেকশনে চলে যায়। নতুন করে তালিকা অন্তর্ভুক্ত করতে শুনানি শেষে দীর্ঘসময় লেগে যায়। ফলে শুধু আইনজীবীদের অভিযুক্ত করা যুক্তিযুক্ত নয়। উচ্চ আদালতসহ নিম্ন আদালতে প্রায় ৩১ লাখ মামলা জটে পড়েছে। এর মধ্যে নিম্ন আদালতে রয়েছে প্রায় ২৮ লাখ মামলা। উচ্চ আদালতে রয়েছে প্রায় ৪ লাখ মামলা। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, দুর্বল এফআইআর, সাক্ষীদের উপস্থিত না করা, দুর্বল চার্জশীট ও বিচারকের স্বল্পতার কারণেই মামলা নিষ্পত্তিতে সময় লাগছে। সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) মোঃ সাব্বির ফয়েজ বলেছেন, মামলা স্বল্প সময়ে নিষ্পত্তি না হওয়ার বড় বাধা সাক্ষীকে উপস্থিত না করা। এছাড়া দেওয়ানি মামলায় আইনজীবীদের বড় ভূমিকা রয়েছে। তারা মামলাটি দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখেন। সিনিয়র আইনজীবী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেছেন, সিভিল মামলার পদ্ধতিগত কারণেই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অন্যদিকে, প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল জানিয়েছেন, মামলাজটের আরেকটি কারণ আমাদের দেশে দ্বান্দ্বিক বা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বিচার প্রক্রিয়া। এখানে দুপক্ষই জিততে চায়। জেতার সম্ভাবনা কম মনে হলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য বা বিচারে বিলম্ব করার জন্য পক্ষগুলো বার বার সময় নেয়, বিলম্ব ঘটানোর জন্য নানা পন্থার আশ্রয় নেয়। মামলা নিষ্পত্তিতে যুগের পর যুগ কেটে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তার দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, আমরা যদি বিদেশের দিকে তাকাই তা হলে কি দেখতে পাই। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০ হাজারে ১ জন বিচারক রয়েছেন। ভারতে ৬৭ হাজারের বিপরীতে ১ জন বিচারক। ওদের টার্গেট ২০ জনের জন্য একজন বিচারপতি নিয়োগ দেয়া। আর আমাদের এখানে ১ লাখ ৪২ হাজারের বিপরীতে একজন বিচারক রয়েছেন। আমাদের বিচারকের সংখ্যা খুবই কম। প্রতিবছর অন্তত ৪ শ’ করে বিচারক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। একটা জজের ডায়রিতে ৫০টি মামলা থাকে। ২টি করতে পারেন। আইনজীবী ওই ৪৮টি মামলার জন্য সময় চাইতেই পারে। মামলাজট থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে জজ নিয়োগ আর তার পাশাপাশি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা দরকার। বিচারক নিয়োগ দিলেই হবে না। এক থেকে দুই বছর তাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ট্রেনিংয়ের কোন বিকল্প নেই। ট্রেনিংয়ে পাস করতে হবে। তা না হলে আবার ট্রেনিং। নিম্ন আদালতে আমাদের জজদের সংখ্যা কম। সারা বিশ্বের তুলনায় আমাদের বিচারকরা বেশি মামলা নিষ্পত্তি করে থাকেন। কিছু লিমিটেশন আছে তার মধ্যে টাইপিস্ট ও কম্পিউটার অন্যতম। সহকারী জজসহ প্রত্যেক বিচারকের জন্য একজন করে দক্ষ স্টেনোগ্রাফার নিয়োগ দিতে হবে। উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, উচ্চ আদালতে যথেষ্ট বিচারপতি আছেন। যেখানে বিচারপতির বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। হাইকোর্টে বিচারপতির সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টা প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তিনি আরও বলেন, দেওয়ানি মামলা বছরের পর বছর পড়ে থাকে। জজ সাহেব রায় শেষ করতে পারেন না। অনেক সময় হাইকোর্ট থেকে স্টে হয়ে থাকে। মামলার ধীরগতি হওয়ার আরেকটা কারণ উচ্চ আদালত থেকে স্টে পাওয়া। এখন সবাই মনে করেন, হাইকোর্টে গেলে স্টে হয়ে যাবে, রুল হয়ে যাবে। এ ছাড়া ৬৪ জেলার জজগণ ঠিকমতো অফিস করেন না। বৃহস্পতিবার হলে তারা ঢাকায় চলে আসেন। এটা বন্ধ করতে হবে। পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকতে হবে। হাইকোর্টেও অনেক জজ আছেন যারা বেলা ১১টায় বাসা থেকে পতাকা উড়িয়ে আসেন। আগের দিন ছিল জজরা কখন আসবেন। সেই সময় দেখে ঘড়ির কাঁটা কারেকশন করে নিত। এখন তার উল্টো হচ্ছে। জজ সাহেব ঠিকমতো উঠেন কি না, এটা দেখার দায়িত্ব প্রধান বিচারপতির। এটা আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের কাজ নয়। সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (বিচার ও প্রশাসন) মোঃ সাব্বির ফয়েজ জনকণ্ঠকে বলেছেন, বর্তমানে প্রায় ৩১ লাখ মামলা রয়েছে। যার মধ্যে উচ্চ আদালতে প্রায় ৪ লাখ। মামলা নিষ্পত্তিতে বড় কারণ সাক্ষী না আসা। পুলিশ ঠিকমতো সাক্ষীদের হাজির করতে পারে না। অন্যদিকে, দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তিতে বড় কারণ আইনজীবী। অনেক আইনজীবী মামলা জিইয়ে রাখেন। ফলে মামলা নিষ্পত্তি হতে যুগের পর যুগ পার হয়ে যায়। এই মুহূর্তে মামলাজট কমাতে নিম্ন আদালতে আরও বিচারক নিয়োগ করা প্রয়োজন। বর্তমানে ১ হাজার ৫০০ বিচারক রয়েছেন। এর দ্বিগুণ নিয়োগ দেয়া উচিত। হাইকোর্টেও বিচারক স্বল্পতা রয়েছে। সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদিন মালিক বলেছেন, আমাদের মূল সমস্যা বের করে সমাধান করতে হবে। তা না হলে সেখানে আছি সেখানে থেকে যাব। নতুন নতুন বিচারক নিয়োগ করে কোনভাবেই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সুপ্রীমকোর্টের লিগ্যাল এইড কমিটি গত বছরের ১৬ নবেম্বর বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক বন্দীদের তালিকা চেয়ে দেশের সকল কারাগারে চিঠি পাঠায়। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত ৭ ডিসেম্বর আইজি প্রিজন বিভিন্ন কারাগারে ৫ থেকে তদূর্ধ সময়ে বিচারাধীন আটক বন্দীদের তালিকা সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটিতে পাঠায়। ওই তালিকায় মোট ৪৬২ জন বন্দী রয়েছেন। এ তালিকা থেকেই দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে যারা আটক আছেন তাদের বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনছেন লিগ্যাল এইড কমিটির আইনজীবী। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও জে বি এম হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চ শিপনকে জামিন দেন। তার মামলাটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য বিচারিক আদালতকে নির্দেশ দেয়। আদালত আদেশে বলে, ‘সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের দায়িত্ব দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং আদালত ব্যর্থ হয়েছে। এটা আমাদের সকলের জন্য লজ্জাকর। এই দায় রাষ্ট্রের এবং বিচারকের।’ হাইকোর্ট আদেশে বলেছে, এই মামলার পিপি মামলা নিষ্পত্তি করতে উদ্যোগ নেবেন। যদি নতুন করে কোন তথ্যপ্রমাণ না পাওয়া যায়, তাহলে যে তথ্যপ্রমাণ আছে তার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করতে বলেছে হাইকোর্ট। ইতোমধ্যে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে কারাগারে আটক ১৬ জনকে জামিন প্রদান করেছে। তারা হলেনÑ ঢাকার শিপন, মতিঝিলের সেন্টু, মাদারীপুরের মকবুল, কুমিল্লার বিল্লাল, নারায়ণগঞ্জের সুমি আক্তার, কুষ্টিয়ার রাসেল শেখ, বাড্ডার সাইদুর রহমান, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মোঃ পারভেজ, মতিঝিলের মাসুদ, নেত্রকোনার লিটন, গাজীপুরের বাবু, যশোরের অপূর্ব দাস, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মোঃ দানা মিয়া, সাতক্ষীরার আসাদুল ওরফে আছা, নারায়ণগজ্ঞের সাজু মিয়া, ঢাকার ইমরান ওরফে ইসমাইল ওরফে মুসা চট্টগ্রামের সত্যাজিত পাল। দুইজন আসামির মামলা ৬০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এরা হলেনÑ ঢাকার শিপন ও চাঁন মিয়া। ১২ জনের মামলা ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারা হলেনÑ মতিঝিলের সেন্টু, মাদারীপুরের মকবুল হোসেন, কুমিল্লার বিল্লাল হোসেন, নারায়ণগঞ্জের শাহনাজ বেগম, গাজীপুরের রাজিয়া সুলতানা, ঢাকার সাইদুর রহমান ও রাজীব হোসেন, মৌলভীবাজারের ফারুক হোসেন, পাবনার কাইলা কালাম, নাটোরের মোঃ আবদুল খালেক, সাতক্ষীরার আসাদুল ওরফে আছা, নারায়ণগজ্ঞের সাজু মিয়া। ৫ জনের মামলা ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারা হলেনÑ ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মোঃ সেলিম মিয়া, হবিগঞ্জের রাজু জগনাথ, সুনামগঞ্জের বসির উদ্দিন, ঝিনাইদহের মোঃ হায়দার আলী, পিরোজপুরের মোঃ রফিকুল ইসলাম রাজা। আইন কমিশনের সুপারিশ ॥ মামলাজট নিরসনে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক অনেক আগেই আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক স্থায়ী কমিটিতে ২৭ দফা সুপারিশ পেশ করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ (১) জরুরী ভিত্তিতে কয়েক ধাপে ৩ হাজার নতুন জজ নিয়োগ। প্রতি জেলা সদরে নতুন এজলাস কক্ষ নির্মাণসহ ভৌত কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সমগ্র বিচার ব্যবস্থাকে ডিজিলাইজেশন করা। সহকারী জজসহ প্রত্যেক বিচারকের জন্য একজন করে দক্ষ স্টেনোগ্রাফার নিয়োগ দিতে হবে। বিচারকদের নিজ হাতে সাক্ষীর জবানবন্দী রেকর্ড করার পরিবর্তে কম্পিউটার টাইপ চালু করা দরকার। (২) একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অধিকাংশ বিচারক সকাল সাড়ে নয়টা এজলাসে উঠেন না এবং অনেকে দ্বিতীয়ার্ধেও উঠেন না। বিচারিক কাজের জন্য নির্ধারিত সময়টুকু যদি বিচারিক কাজে ব্যয় করা নিশ্চিত করা যায় তকে মামলার জট কিছুটা হলেও কমতে বাধ্য। সে ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিবেশে সান্ধ্যকালীন আদালত চালু করার আদৌ প্রয়োজন হবে না। (৩) দেওয়ানি রুলস ও অর্ডারসের ১২৫নং রুল অনুযায়ী এবং ফৌজদারি রুলস ও অর্ডারসের ৩৩নং রুল অনুসারে মামলার চূড়ান্ত শুনানির দিনে সাক্ষী গ্রহণ আরম্ভ হলে সকল সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দিনের পর দিন সাক্ষ্যগ্রহণ চলতে থাকবে। শুধু জরুরী কারণে মামলাটি স্বল্প সময়ের জন্য মুলতবি করা যেতে পারে। অধিকাংশ বিচারকই উল্লেখিত রুলের বিধান অনুসরণ করেন না। (৪) দেওয়ানি রুলস ও অর্ডারসের ৫০০নং অনুয়ায়ী জেলা ও দায়রা জজ ও সমপর্যায়ের জেলা জজদের কর্মস্থল ত্যাগ করতে হলে তাদের অবশ্যই হাইকোর্ট ডিভিশনের রেজিস্ট্রারের কাছে লিখিতভাবে জানাতে হবে। উল্লেখিত বিধানটি ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। লক্ষ করা যাচ্ছে, জেলা জজ পর্যায়ের বেশকিছু বিচারক প্রতি বৃহস্পতিবার কোর্ট আওয়ারে কর্তৃপক্ষের অগোচরে কর্মস্থল ত্যাগ করেন এবং পরের রবিবার দুপুর নাগাদ কর্মস্থলে হাজির হন। এর ফলে বিচারকাজে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্র্রার প্রতি সপ্তাহে জেলা জজদের কাছ থেকে কর্মস্থল ত্যাগের জন্য কদাচিৎ কোন দরখাস্ত পান। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে জেলা জজদের বাসায় টেলিফোন করে খোঁজখবর নিয়ে দৃষ্টান্তমূলকভাবে তাদের শোকজ করলে এ ধরনের অবৈধ কর্মস্থল ত্যাগের ঘটনা কমে যাবে। (৫) দেওয়ানি কার্যবিধি আইনের অর্ডার-৫-এ সমন জারির বিধানসমূহ দেয়া আছে কিন্তু জারিকারক ও নাজিরের অবহেলা ও দুর্নীতির কারণে সময়মতো সমন জারি হয় না। ফলে মামলা শুনানির জন্য প্রস্তুত করতে অস্বাভাবিক বিলম্ব হয়ে থাকে। (৬) মামলার মুলতবির ব্যাপারে বিচারককে কঠোর হতে হবে। মুলতবির কারণ যথার্থ মনে হলে পর্যাপ্ত খরচসহ মুলতবির আবেদন বিবেচনা করা যেতে পারে। (৭) দেওয়ানি মামলা, অর্থঝণ মামলা ও পারিবারিক মামলাসমূহ বিচারের ক্ষেত্রে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) বিধান সংশ্লিষ্ট আইনে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বিচারকেই আপোস-মীমাংসার জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্ত ওই অজুহাতে শুনানি বিলম্বিত করা যাবে না। (৮) আপীল মামলাসহ দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলায় উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানির পর অবশ্যই ৭ দিনের মধ্যে রায় প্রদান করতে হবে। তবে কোন মামলার আকৃতি-প্রকৃতি বড় বা জটিল হলে তা অবশ্যই পরের সপ্তাহের মধ্যে রায় প্রদানে সচেষ্ট হতে হবে। আদালতের বিবেচনায় কোন মামলা মিথ্যা বা হয়রানিমূলক বলে প্রমাণিত হলে তা উপযুক্ত খরচসহ শেষ করতে হবে। (৯) সমাজে প্রভাবশালী লোকের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সকল ধরনের অপরাধের সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলেছে। সাধারণ সাক্ষীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এরূপ প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে প্রায়ই অনীহা প্রকাশ করে। কাজেই সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন অতীব জরুরী। (১০) দেশের ফৌজদারি মামলাসমূহ সৃষ্ট তদন্তের স্বার্থে একটি পৃথক ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি গঠন করা একান্ত দরকার। (১১) মামলাজট জরুরি ভিত্তিতে কমানোর লক্ষ্যে সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সৎ ও কর্মঠ অবসরপ্রাপ্ত জজদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও পদায়ন করলে পুরাতন বিচারাধীন দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার শুনানি, আপীল ও রিভিশন মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। (১২) জেলা ও দায়রা জজ পর্যায়ের পদোন্নতি বা নিয়োগের ক্ষেত্রে সৎ ও কর্মঠ বিচারকেদের সতর্কতার সঙ্গে নির্বাচন করা অপরিহার্য। সুপীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বর্তমানে প্রায় ৪ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ওই নিষ্পত্তির জন্য বর্তমানে ৮৭ জন বিচারপতি কর্মরত আছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যাবে, বিচারকের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মামলার সংখ্যাও সমানতালে বৃদ্ধি পেয়েছে। যা অস্বাভাবিক বলে প্রতীয়মান হয়। উচ্চ আদালতে মামলাজট কমাতে আইন কমিশন বেশকিছু সুপারিশ করেছেন। (১) প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি মনিটরিং সেল থাকবে যা প্রধানত : মামলা দাখিল ও নিষ্পত্তির সংখ্যা কি কি কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা নিরূপণ করে পদক্ষেপ নেবে। (২) সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে বিচারপ্রার্থী জনগণ যাতে কোন টাউট বা দুর্নীতিবাজ কর্মচারীর খপ্পরে না পড়েন তা নিয়ন্ত্রণের জন্য রেজিস্ট্রারকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। (৩) কোন দেওয়ানি, ফৌজদারি মোশন দরখাস্ত বা সিআর পিসির ৫৬১-এ ধারা মতে দরখাস্ত দাখিল করলে বিচারপতিগণ প্রথমেই তার মেরিট যাচাই করবেন। মেরিটবিহীন দরখাস্ত হলে অবশ্যই সরাসরি খারিজ করবেন। (৪) নিম্ন আদালতের কোন বিচাররাধীন মামলার কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে অনিবার্যভাবে নিম্ন আদালত, উচ্চ আদালত ও উভয় আদালতেই মামলার ব্লকেজ সৃষ্টি হয। এ ব্যাপারে বিচারকগণকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। (৫) কোন বেঞ্চের নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা কম হলে প্রধান বিচারপতি সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকে ডেকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন যাতে মামলার নিষ্পত্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। (৬) অবকাশকালীন বেঞ্চের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ব্লকেজ কমানোর পদক্ষেপ নিতে পারেন। (৭) প্রত্যেকটি মোশান এফিডেভিটের তারিখ ও ক্রমানুসারে নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। এতে বেঞ্চ অফিসারদের দৌরাত্ম্যের হাত থেকে আবেদনকারীগণ রেহাই পাবেন। (৮) মোশান শুনানিতে নিরুৎসাহিত করে মামলা নিষ্পত্তির ওপর জোর তাগিদ দিতে হবে। যে বেঞ্চ রুল ইস্যু করেন প্রধান বিচারপতি ওই বেঞ্চকেই ইস্যুকৃত রুলগুলোর শুনানি অন্তে নিষ্পত্তির নির্দেশ প্রদান করা বাঞ্ছনীয়। (৯) যদি প্রকৃত আইনগত কোন কারণ ছাড়াই রুল ইস্যু করা হয়েছে বলে প্রধান বিচারপতির নিকট প্রতীয়মান হয় তা হলে ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে অদক্ষতাজনিত অসদাচারণের জন্য ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। (১০) হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চ অফিসারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। তাদের ক্রমাগাত বদলিসহ কঠিন হাতে মনিটরিংয়ের মধ্যে রাখতে হবে। প্রয়োজনে দুদককে অভিযোগ সম্বন্ধে স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে দিতে হবে। যারা আইন প্রণয়ন করেন যারা আইন প্রয়োগ করেন এবং যারা আইনের গার্ডিয়ান এবং সাধারণ জনগণ একই আইন দ্বারা বাধ্য। এটাকেই রুল অব ’ল বলে।
×